মুক্তিযোদ্ধার মা

এইখানে শুয়ে শুয়ে আকাশ দেখা যায় অনেক দূর। কালাম একমনে তাকিয়ে থাকে আকাশের দিকে। আকাশ যে কত রঙের খেলা দেখায়। কখনো নীল, কখনো সাদা, কখনো ছাইছাই।

আনোয়ারা সৈয়দ হকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 Nov 2019, 09:32 AM
Updated : 6 Nov 2019, 09:32 AM

আর যখন আকাশে রঙধনু ওঠে, তখন তো কথাই নেই।

কালাম শেখ বিছানা ছেড়ে উঠতে পারে না, কারণ হাঁটুর উপর থেকে তার দুটো পা-ই কাটা। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে সে যখন কিশোর তখন গেরিলা যুদ্ধে অংশ নেবার সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গোলার আঘাতে সে পা দুটো হারায়।

যুদ্ধ একসময় শেষ হয়।

কিন্তু কালাম শেখ তার পা আর ফেরত পায় না। যুদ্ধ শেষে গ্রামের সকলে ফিরে এলে কালাম শেখও ফিরে আসে। তখন গ্রাম ভেঙে মানুষ আসে তাকে দেখতে। দূর দূর গ্রাম থেকেও আসে। তারা তার কাছে যুদ্ধের কাহিনী শোনে, যুদ্ধে তার বীরত্বের কথা শোনে প্রশংসা করে।

তার কথা শহরে কাগজেও একবার বের হয়, দিন যাবার সাথে সাথে সব কিছু ঝিমিয়ে আসে।

এখন আর কেউ কালাম শেখের বাড়িতে আসে না। কেউ আগের মতো খবরও করে না। তার নিজের গ্রামের মানুষজনও অন্যান্য কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

কেউ কেউ গ্রাম ছেড়ে শহরে জীবিকা অর্জনেও চলে যায়। 

কালাম শেখ পড়ে থাকে গ্রামে। তার নিজের বাড়িতে। ছনের বেড়া দেওয়া গোলপাতায় ছাওয়া কালাম শেখের ছোট একটা জীর্ণ বাড়ি। সেখানে থাকে শুধু কালাম আর তার বুড়ো মা।

অর্ধাহার অনাহারে বিছানায় শুয়ে থেকে থেকে কালামের শরীর ক্ষীণ হয়ে গেছে। পাশ ফিরতে পারে না। আগে কালামের ছোটবোন তার দেখাশোনা করত, কিন্তু তার বিয়ে হয়ে যায় বলে সে আজকাল বেশি বাড়ি আসতে পারে না।

কালাম বিছানায় শুয়ে শুয়ে মাকে নানা রকম প্রশ্ন করে। ‘মা আজ কত তারিখ? ‘মা আজ কি বার ?’ ‘মা আমগাছে বোল এসেছে নাকি?’ ‘মা কালা বুধির বাচ্চা হবে কবে?’ এইসব।

সেদিন যখন কালামের মা কালামের বিছানার পাশে এসে বসে, কালাম তার মাকে জিজ্ঞেস করে ‘মা আজ কত তারিখ ?’

মা বলে ‘আজ পৌষ মাসের দুই তারিখ।’

কালাম সেকথা শুনে আঙুল শুণে হিসেব করে।

মা জিজ্ঞেস করে, ‘কি গুণিস রে কালাম?’

কালাম বলে ‘গুণে দেখি, বিজয় দিবসের আর কত দেরি। একাত্তর সালে এই দিনে আমি কোথায় ছিলাম, জানিস মা?’

মা জানে সে কোথায় ছিল। তবু জিজ্ঞেস করে, ‘কোথায়?’

‘নাগপুরে। টাংগাইলের কাছে। কাদের সিদ্দিকীর দলে। আমার কমান্ডার আমারে খুব বিশ্বাস করত। আমার সাহসের প্রশংসা করত খুব। আঠারো বছরের যোয়ান তাগড়া ছিলাম তো। কেউ যে কাম করতে ডর পাইত, আমি আগাইয়া যাইতাম সে কাজে। একদিন তো…

এই বলে কালাম তার মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোর কাহিনী বর্ণনা করে। কালামের বুড়ি মা সেসব কথা শুনে মাথা নেড়ে চুপ করে থাকে। মাঝে মাঝে সে তাই ছেলের কথা শুনে রাগ করে আজকাল। বলে; ‘বারবার তরে কইছিলাম, ওরে কালাম, যাস্ না, মুক্তিযুদ্ধে যাস্ না, ও সব বড় লোকের পোলাপানগোর কাম। তা তুই শুনলি না। আজ তুই ভাল থাকলে, আমারে এইভাবে খাটতে হয়, এইরকম থাকে আমাগো বাড়ি ঘরের অবস্থা, এইরকম ফকিরের লাহান চলতে হয় আমারে?’

কালাম বুড়ি মায়ের এইসব হা হুতাশের কথা রাতদিন শোনে। আগে এসব শুনে রাগ করত, এখন আর করে না। আগে কত ভাল ভাল কথা বলে মাকে বোঝাত। দেশ কাকে বলে, দেশের প্রতি ভালবাসা কাকে বলে। তার মা লেখাপড়া জানে না, কালামের মতো ইস্কুলে ক্লাশ টেন পর্যন্ত পড়েনি, মাকে সে তার নিজের বুদ্ধিমত পরিস্থিতি বোঝাবার চেষ্টা করত।

এখন আর এসব কিছুই করে না কালাম। কারণ সে জানে, কোন ভাল কথাতেই মায়ের মন আজকাল ভেজে না। মা বুড়ো হয়ে গেছে, তবু এখনো তাকে উদয়াস্ত খাটতে হয়। কালামের বিয়েও সে কারো সাথে দিতে পারেনি।

মা নিজে নিজেই হাঁস মুরগী ও ছাগল পালে। গরু রাখার ক্ষমতা নেই। ছোট একটা ক্ষেত আছে। সেই ক্ষেতে ছোলা, মাসকলাই বোনে। কায়ক্লেশে দিন চলে যায় তাদের।

প্রথম দিকে কিছু কিছু লোক তাদের সাহায্য করত, এখন আর করে না।

বিজয় দিবস এগিয়ে আসে, যেমন প্রতিবার আসে। কালাম বিছানায় শুয়ে শুয়ে টের পায় চারদিকে একটা সাজ সাজ রব পড়েছে। মক্তব্যে, পাঠশালায়, চেয়ারম্যানের বাড়িতে উৎসবের ঢেউ লেগেছে। কালাম উৎসুক চোখে জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকে, ঘাড় উঁচু করে রাস্তা দেখে, অনেক রাত পর্যন্ত রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু কেউ তার বাড়িতে আসে না।

রাতের বেলা কালাম শূন্য দৃষ্টিতে তার ঘরের ছোট জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকে বাইরে। অনেক রাত পর্যন্ত তাকিয়ে থাকে। মা তার ঘরের মেঝেতেই ছেঁড়া কাঁথা ফেলে ঘুমোয়। তাদের একটাই ঘর। ঘুমের মধ্যে বুড়ি মা কাঁদে। কালাম শোনে আর জেগে জেগে অন্ধকারে আকাশ দেখে।

বিজয় দিবসের দিন খুব ভোরবেলা ওঠে কালামের মা। দেখে কালাম জেগে উঠে বালিশে হেলান দিয়ে বসে আছে। বুড়ি মা পানি এনে কালামের হাত মুখ ধুয়ে দেয়। গুড় দিয়ে মুড়ি মাখিয়ে খেতে দেয়। কালামের কেন জানি আজ মুখে রুচি নেই। সে বারবার জানালা দিয়ে পথের দিকে তাকায়।

মনে হয়, আজ কেউ না কেউ নিশ্চয় তার বাড়িতে আসবে, এসে তার কুশল জিজ্ঞেস করবে। এমনও হতে পারে কেউ হয়ত খুশি হয়ে তাকে একটা বিজয় দিবসের গান গেয়ে শোনাবে। অথবা হতে পারে টাউন হল থেকে একটা হুইল চেয়ার ভাড়া করে নিয়ে যাবে তাকে চেয়ারম্যানের বাড়িতে। অনেক লোকজনের মাঝে সকলে তাকে জিজ্ঞেস করবে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার কথা, তার গেরিলা জীবনের বীরত্বের কথা। পাড়ার ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা হা করে তার কথা শুনবে, ভয়ে শিউরে উঠবে। বুড়োরা নিজেদের স্মৃতি রোমন্থন করবে।

বেলা পড়ে যায়। কেউ কালামের বাড়িতে আসে না। কালাম মুখে কিছু প্রকাশ না করলেও সতৃষ্ণ চোখে বারবার তার বাড়ির সামনের পথটার দিকে তাকিয়ে থাকে। দেখে রঙ বেরঙের জামা কাপড় পরে গ্রামের ছেলেমেয়রা দল বেঁধে কোথায় যেন যায়, নিশ্চয় আজ ইস্কুলে কেবল ফাংশান হবে। যোয়ান ছেলেরা ফর্সা জামা কাপড় পরে, চুল আঁচড়ে হন্ হন্ করে হেঁটে যায় রাস্তায় তার বাড়ি পার হয়ে দ্রুতপদে। কেউ কেউ সাইকেল চালিয়ে যায়। সাইকেলের মাথায় ছোট পকেট রেডিও বাঁধা থাকে, সেই রেডিওতে গান হয়, ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি।’

কালাম কান পেতে শোনে। দূরে বন্দুক ফোটানোর আওয়াজ হয়। কালাম চমকে ওঠে। পরক্ষণেই বোঝে, এ আওয়াজের অর্থ হচ্ছে আনন্দের। বিজয়ের আনন্দ।

কালাম চুপ করে অর্থহীন দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে থাকে শূন্যে।

সন্ধ্যে হয়ে আসে। রাত নামে। আজ সকালে সেই যে কালামের মা তাকে নাস্তা খাইয়ে ঘর ছেড়ে গেছে, তারপর থেকে মায়ের সাড়া শব্দ পায়নি কালাম। কালাম জানে কেন, আজ হচ্ছে কালামের মার চুল ছেড়ে পা মেলে দিয়ে বসে কান্নার দিন। ‘ওরে বাজান রে, বাজান, নিজের একি ক্ষেতি করলি রে তুই, বাজান’, এই বলে বিলাপ করার দিন।

বিজয় দিবসে সবাই যখন হাসে, কালাম শেখের মা সেদিন পা মেলে দিয়ে কাঁদে। রাতের বেলা কালাম বালিশে ভর দিয়ে চুপ করে বসে থাকে। তার দোরগোড়ায় টিমটিম করে হারিকেন জ্বলে একটা। এমন সময় দেখে তার মা ঘরে ঢুকছে। মা ঘর ঢুকে হ্যারিকেনের সলতে বড় করে। সেই আলোয় মাকে দেখে অবাক হযে যায় কালাম।

মা আজ নুতন একটা শাড়ি পেয়েছে। সিল্কের সরু পাড় কোরা শাড়ি। মা ঘরে ঢুকে কালামকে কোন সম্বোধন না করে পশ্চিম দিকে এগিয়ে গিয়ে টিনের তোরঙ্গ খুলে কাঁথা বের করে একটা। নকশী কাঁথা। এই কাঁথাটা মায়ের খুব প্রিয় জিনিস, কালাম তা জানে। অনেক রাত জেগে বসে মা এই কাঁথাটা বুনেছে। কাঁথাটা এনে কালামের মা কালামের পায়ের কাছে বিছানার উপরে যত্ন করে পাতে। তারপর ঘরের তাক থেকে পেড়ে আনে কাঁধ উঁচু কাঁসার থালা একটা, সেই সাথে লম্বা সবুজ কাচের গেলাস ও কলাই করা ফুল তোলা বাটি।

এগুলো পানি দিয়ে ধুয়ে সে কালামের সামনে রাখে। এরপর সে রান্নাঘরে যায়। রান্নাঘর থেকে সে নিয়ে আসে হাঁড়ি পাতিল।

কালামের সামনে মাটিতে হাঁড়ি পাতিল রেখে সেখান থেকে গরম ধোঁয়া ওড়ানো সুগন্ধী পোলাও বেড়ে সে সাজিয়ে দেয় কাঁসার থালায়। মুরগীর কোরমা দেয় কলাই করা বাটি ভরে। পেঁয়াজ কুচি, শশা আর গাছের লেবু পেড়ে যত্ন করে মাখিয়ে তৈরি করে সালাদ। অন্য একটা বাটিতে ভর্তি করে দেয় সে ঘন দুধের ক্ষীর।

এরপর মমতা ভরে সব এগিয়ে দেয় সে কালামের দিকে।

কালামের মুখে কথা সরে না। তারা এক বেলা খায় ভর্তা, ভাজি, শাক। আর ভাত হচ্ছে তাদের দৈনন্দিন খাদ্য। সে ভাবে মায়ের কি মাথা খারাপ হয়ে গেল?

কোনরকমের ঢোঁক গিলে সে বলে ‘এ কি মা?’

অজস্র রেখাবহুল মুখ তুলে কালামের বুড়ি মা এবার কালামের দিকে তাকায়। তার চোখের তারা দু’টো অনেক কান্নার পর এবার চিকচিক করে জ্বলে।

মা বলে, ‘আমার ছাবাল বীর মুক্তিযোদ্ধা। আমার ছাবালের আমি ভাত ডাইল খাওয়ামু আজ? দ্যাশের পিসিডেন আজ যা খাইবে, আমার কালামও তাই খাইবে। দ্যাশের লোক ভোললেও মুক্তিযোদ্ধার মা কি তার ছাবালরে ভোলতে পারে, বাজান?’

কিডস পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com। সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!