চিনাদী বিলের যে গল্পটি আগে কেউ শোনেনি

নৌকোটি যখন দুলছিল তখন সবাই আনন্দে হইচই করছিল। নৌকার নড়াচড়া আর হেলাদোলার মাঝে বিরাট আনন্দ খুঁজে পেলো তারা।

বিএম বরকতউল্লাহবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 Sept 2019, 09:08 AM
Updated : 16 Sept 2019, 07:47 AM

বাইশজন কিশোরকে নিয়ে নৌকোটি তরতর করে এগিয়ে চলেছে চিনাদী বিলের বুকে। তারা বনভোজন করবে নৌকায় চড়ে। প্যাকেট খাবার নিয়ে হৈ-হুল্লোড় করে নৌকা ভ্রমণে বেরিয়েছে কিশোরেরা। বর্ষার জলে পরিপূর্ণ বিলের বিস্তীর্ণ পানিতে নৌকোতে ছুটে চলার আনন্দই আলাদা।

ছেলেরা আনন্দে চিৎকার করে নৌকোতে লাফালাফি করতে লাগল। তাদের আনন্দ মুহূর্তে কান্নায় পরিণত হলো যখন নৌকোটি একদিকে কাত হয়ে গেল। নৌকোটি তলিয়ে যাচ্ছে। কিশোররা যে যার মতো লাফিয়ে পড়ে সাঁতরে পারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

তাদের চিৎকার চেঁচামেচি শুনে অভিভাবকরা তড়িঘড়ি করে কোন্দা কোষা যে যা হাতের কাছে পেয়েছে তাই নিয়ে ছুটে গেছে নৌকোটির দিকে। ততক্ষণে সব শেষ। নৌকোটি পানিতে তলিয়ে গেছে। কিশোরের দল বিলের পূর্ব পারে গিয়ে উঠে একজন আরেকজনকে খোঁজাখুঁজি করতে লাগল।

সবাই বাড়ি ফিরে গেল। কিন্তু একজনের সন্ধান পাওয়া গেলো না। তার নাম মাইনদ্দিন। সে সাঁতার জানে না। অভিভাবক ও পাড়ার ছোট-বড় সবাই তন্ন তন্ন করে খুঁজলো। কোথাও পাওয়া গেলো না তাকে।

পরের দিন ভোরে একটি লাশ ভেসে ওঠেছে চিনাদী বিলের বুকে। মাইনদ্দিনের লাশ। চিনাদী বিলের নিস্তব্ধ জলে মাইনদ্দিনের সলিল সমাধি হয়ে গেলো।

দুই.

ছেলে হারানোর শোকে মা-বাবা দিশেহারা। সাঁতার না জানার কারণে তার ছেলের অকাল মৃত্যু হয়েছে। যারা সাঁতার জানে তারা নদীর অথই পানিতে সাঁতার কেটে পারে উঠতে পেরেছে। এই শোকের ভেতর বাবার মাথায় একটি চমৎকার চিন্তা খেলা করে গেলো। সে আর কারও সন্তানকে এভাবে অথই পানিতে হারিয়ে যেতে দেবে না- এই তার পণ।

তিন.

মাইনদ্দিনের বাবা সাঁতার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খুলে ফেললেন। ছেলেকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য নাম দিলেন ‘মাইনদ্দিন সাঁতার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র’।বিলপাড়ের মানুষ এমনিতেই সাঁতার জানে। কিন্তু সেই সাঁতার জানার জ্ঞান কোন নিয়মসিদ্ধ জ্ঞান নয়। গভীর পানিতে কিভাবে দীর্ঘ সময় ভেসে থাকা যায়, স্রোতের মধ্যে কিভাবে নিজেকে রক্ষা করতে হয়, লঞ্চ বা নৌকা ডুবে গেলে কিভাবে সাঁতরে কুলে উঠতে হয়, পানিতে তলিয়ে গেলে কিভাবে দীর্ঘসময় শ্বাস ধরে রাখা যায়, সাঁতারের জন্য শারীরিক যোগ্যতা অর্জনের জন্য শরীরচর্চা ইত্যাদি নানা কৌশল আর বিষয়-আশয় আছে সাঁতার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে।

চার.

মাইনদ্দিনের বাবা এলাকার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিশু-কিশোরদের সাঁতার শেখার ব্যাপারে সচেতনতার জন্য প্রচার অভিযান শুরু করে দিলেন। শুধু মুখে বলে কয়ে নয়; লিফলেট বিতরণ, ব্যানার, ফেস্টুন করে, সেমিনারের আয়োজন করে তিনি রীতিমত হইচই ফেলে দিয়েছেন এলাকায়। নদীমাতৃক এই বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষকে যে সাঁতার শিখতে হবে এ বিষয়ে তার একটি সংক্ষিপ্ত বক্তব্য আছে। সন্তানহারা পিতার এ বক্তব্য মানুষের হৃদয় স্পর্শ করে।

অন্য দশটি খেলার মতোই এটি নিছক একটি খেলা নয়। সাঁতার উত্তম ব্যায়াম আর নদীমাতৃক বাংলাদেশের মানুষের জীবনরক্ষারও খেলা এটি। সাঁতার শেখার জন্য দূর-দুরান্ত থেকে শিশু-কিশোররা ছুটে আসে মাইনদ্দিন সাঁতার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে সাঁতার শেখার জন্য। এখানে আছে পেশাদার সাঁতার প্রশিক্ষক। দেখতে দেখতে মাইনদ্দিন সাঁতার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র একটি বিনোদন ও আকর্ষণীয় সাঁতার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে রূপ নিল।

অভিভাবকেরা তাদের ছোট ছোট শিশুদের নিয়ে চলে আসেন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে। শিশুরা চিনাদী বিলের নিস্তব্ধ স্বচ্ছ পানিতে যখন সাঁতার কাটে তখন তাদের পিতা-মাতারা খুব আনন্দ পায় এবং স্বস্তিবোধ করে। চিনাদী বিল এখন আর নিস্তব্ধ বিল নয়। শিশু-কিশোরদের হাত ও পায়ের তাড়নে প্রতিনিয়ত ঢেউ খেলে যায় পানিতে আর কুলে কুলে চুমু খায় ঢেউগুলো।

এভাবে এলাকার শত শত শিশু-কিশোর সাঁতার শিখে বিভিন্ন স্থানে প্রতিযোগিতায় পুরস্কার নিয়ে আসে। গর্বে বুক ভরে যায় মাইনদ্দিনের বাবা-মার। তারা এসব শিশু-কিশোরদের মাঝে খুঁজে পান তাদের হারিয়ে যাওয়া মাইনদ্দিনকে।

পাঁচ.

১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবসে এলাকায় মহৎ কাজের স্বীকৃতি হিসেবে একটি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে সেরা পুরস্কার দেওয়া হলো ‘মাইনদ্দিন সাঁতার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রকে’। সন্তানহারা মাইনদ্দিনের মা ও বাবা পুরস্কার নিয়ে আনন্দ-অশ্রু মুছতে মুছতে বাড়ি ফিরলেন।

কিডস পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com। সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!