মেঘের দেশের রাজকন্যা

দুনিয়ার সব থেকে রূপবতী মেয়েটার নাম মেঘবতী। থাকে সে মেঘের দেশে, মেঘ রাজ্যের রাজকন্যা সে। তার রূপের ছটায় আলোকিত হয়ে থাকে গোটা মেঘের পাড়া।

আহমাদ স্বাধীনআহমাদ স্বাধীন
Published : 8 Sept 2019, 10:04 AM
Updated : 8 Sept 2019, 10:04 AM

মেঘবতীর মন ভালো থাকলে মেঘেরা নানা রঙে রাঙিয়ে তোলে নিজেদের। লাল, নীল, হলুদ, সবুজ, কমলা, আরো কত রঙ যে আছে মেঘেদের তার শেষ নেই। কিন্তু যখন মেঘবতীর মন খারাপ হয়, তখন সব মেঘেরা হয়ে যায় ছাই রঙের। আর যদি কখনো মেঘবতী রেগে যায় তখন মেঘের রঙ হয়ে যায় কালো, আর শুরু হয় মেঘের গর্জন।

মেঘের ঘর্ষণে ঘর্ষণে পৃথিবীতে নেমে আসে বজ্রপাত।

অথচ মেঘবতী কখনো চায় না বজ্রপাত হোক। তাই সহজে রাগে না। কিন্তু কখনো কখনো তাকে রাগতে হয়। মেঘবতী হাসলে হেসে ওঠে আকাশ, প্রজাপতি, ফুল ও পাখিরা। আর কাঁদলে মেঘেরা ঝরতে থাকে বৃষ্টি হয়ে। মেঘবতী খুব সুন্দর করে ছবি আঁকতে পারে। ও সারাদিন সখিদের নিয়ে মেঘরাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে বেড়ায় আর ছবি আঁকে। নানান রকম ছবি। শহরের ছবি, গ্রামের ছবি, মানুষের ছবি, প্রাণীদের ছবি,  আরো কত ছবি তার শেষ নেই।

মেঘরাজ্যের রাজার সেই ছবি খুব ভালো লাগে। তাই  রাজকন্যাকে অনেক ভালোবাসে তার বাবা। এছাড়া মেঘের দেশের সকলেই মেঘবতীকে ভালোবাসে। আর রাজকন্যাও তার বাবাকে ও মেঘরাজ্যবাসিদের ভালোবাসে অনেক বেশি। সব থেকে রূপবতী মেঘবতীকে নিয়ে মেঘের দেশের সবার দিন বেশ সুখে শান্তিতেই কাটছিলো।

কিন্তু হঠাৎ করেই এলো একটা বিপদ। রাজকন্যা মেঘবতী তার সখীদের নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিলো মেঘে মেঘে। আঁকছিলো পাখির ছবি। এসময় মেঘের পালকের উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছিলো প্রকাণ্ড এক জাদুর পাখি। সে ছিলো মূলত এক দুষ্ট জাদুকর। সে যখন তখন যেমন খুশি তেমন রূপ ধরতে পারতো। নাম তার সিংবুজিমান।

সিংবুজিমান এতোই দুষ্ট আর খারাপ জাদুকর ছিলো যে সবাই ওকে ভয় পেতো। সে কখনোই কারো ভালো করতো না। নিজের ক্ষমতার দম্ভ দেখাতে সব সময় সে মানুষের ক্ষতি করতো। রাজকন্যা মেঘবতী দেখলো তার মাথার উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে প্রকাণ্ড এক পাখি। পাখিটাকে রাজকন্যার খুব ভালো লাগলো, তাই ডেকে বলল- ও পাখি ভাই, এতো ব্যস্ত হয়ে কোথায় যাও? দাড়াঁও তো একটু। মেঘের গায়ে তোমার একটা ছবি আঁকি।

মেঘবতীর ডাক শুনে চমকে গেল জাদুকর সিংবুজিমান। তাকিয়ে দেখলো মেঘের উপর দাঁড়িয়ে আছে পরির মতো এক রাজকন্যা। জাদুকর সিংবুজিমান রাজকন্যা মেঘবতীকে পছন্দ করে ফেললো। তার রূপের আলোয় দিশাহারা হয়ে গেল সে। তাই বেশিক্ষণ আর পাখি রূপে থাকতে পারলো না। সিংবুজিমান তার নিজের কদাকার চেহারার মানুষ রূপে ফিরে এলো।

একটা প্রকাণ্ড পাখিকে হঠাৎ বিশ্রী রকম চেহারার মানুষ রূপে দেখতে পেয়ে মেঘবতী ভীষণ চমকে গেলো। আর ওর সখীরা সবাই ভয় পেয়ে গেলো। মেঘবতী অবাক হয়ে জানতে চাইলো, কে তুমি? আমি এই দুনিয়ার  সব থেকে বড় জাদুকর সিংবুজিমান। আমি পাখি হয়ে প্রায়ই বিভিন্ন রাজ্য ভ্রমণ করি। আর যেখান থেকে আমার যা পছন্দ হয় সেখান থেকে সেটা নিয়ে যাই। এখন এই মেঘের রাজ্যে এসে তোমাকে আমার দারুণ পছন্দ হয়েছে রাজকন্যা। আমি তোমায় বিয়ে করতে চাই। বললো জাদুকর।

মেঘবতী এ কথা শুনেই আৎকে উঠলো। বললো- এটা কখনোই হতে পারে না। আমি তোমার মতো একটা দুষ্ট জাদুকরকে কখনো বিয়ে করতে রাজি হবো না। তাছাড়া তুমি দেখতেও ভারি বিশ্রী। মেঘবতীর কথায় সিংবুজিমান হাসতে হাসতে বললো- আমার যা পছন্দ হয় আমি সেটা অবশ্যই নিয়ে নেই। তোমাকেও আমি তো আমি নিয়ে যাবই, ততক্ষণে তুমি ছবি এঁকে বেড়াও রাজকন্যা। আমি আবার আসবো।

রাজকন্যা মেঘবতী খুব ভয় পেয়ে গেলো। তাই আজ আর ছবি আঁকতে পারলো না। ওর মন খারাপ হয়ে গেলো। আকাশের সব রঙ হয়ে গেলো ছাই রঙের। মেঘবতী ফিরে এলো রাজ প্রাসাদে। এসে রাজা ও রানীকে বললো জাদুকর সিংবুজিমানের কথা। তখন রাজকন্যার বাবা মেঘরাজা বললো, তুমি একদম ভয় পেয়ো না রাজকন্যা। তোমাকে আমি এমন সুরক্ষিত রাখবো যে ঐ জাদুকর সিংবুজিমান খুঁজেও পাবে না। তাছাড়া ওই বদমাইস জাদুকর এই প্রাসাদের আশপাশে আসলেই ওকে মেরে ফেলবে আমার মেঘরাজ্যের সেনারা।

রাজকন্যা মেঘবতীকে লুকিয়ে রাখা হলো প্রসাদের গোপন ঘরে। আর প্রসাদের ভেতরে ও বাইরে বসানো হলো অনেক পাহারা। যেন সিংবুজিমান কোনভাবেই প্রসাদে প্রবেশ করতে না পারে। এইভাবে পাহারা আর ভয়ের মধ্যে দিয়ে কেটে গেলো কয়েক দিন। এক দুপুর বেলা খাওয়া শেষ করে সবাই যে যার ঝিমুচ্ছলো। এসময় কোথা থেকে যেন আকাশ কালো করে এলো এক দৈত্য পাখি। এসে বসলো রাজপ্রসাদের ছাদে। পাখিটাকে দেখেই প্রহরীরা তীর ছুড়ে মারতে লাগলো। কিন্তু সামান্য ছোট তীরের আঘাতে দৈত্য পাখির কিছুই হোলো না। সে আরো আক্রোশে ধেয়ে আসলো প্রহরীদের দিকে। এসেই মুখ দিয়ে ছুটিয়ে দিলো আগুনের হলকা।

সেই আগুনের ভয়ে দৌড়ে পালাতে লাগলো রাজার প্রহরীরা। তাই প্রসাদ হয়ে যায় অরক্ষিত। বাইরে বেড়িয়ে আসে রাজা। তখন জাদুকর সিংবুজিমান পাখি থেকে রূপ বদলে মানুষ হয়ে যায়। রাজাকে বলে- যদি প্রাণে বাঁচতে চাও আর বাঁচাতে চাও তোমার রাজ্যবাসিকে, তবে মেঘবতীকে তুলে দাও আমার হাতে। আমি ওকে বিয়ে করবো। রাজা বলল- তোর মতো এক শয়তান কুৎসিত জাদুকরের হাতে আমার মেয়েকে কখনোই বিয়ে দেবো না। এই বলে কোমরের খাঁজ থেকে রাজা যেই তলোয়ার বের করলো, তখনই সিংবুজিমান তার জাদুর ছড়ি দিয়ে রাজাকে পাথরের মূর্তি বানিয়ে দিলো। 

এসময় দৌড়ে ছুটে এলো রাজার মন্ত্রী, তাকেও পাথরের মূর্তি বানিয়ে দিলো। ছুটে এলো সেনাপতি, ছুটে এলো রাজ সভাসদরা, ছুটে এলো মেঘের রানী, সবাইকেই জাদু দিয়ে পাথরের মূর্তি বানিয়ে রাখলো সিংবুজিমান। সব শেষে ভেতরের গোপন কক্ষ থেকে বেড়িয়ে আসলো রাজকন্যা মেঘবতী। তাকে দেখেই জাদুকর সিংবুজিমান জাদু দিয়ে তৈরি করলো এক কালো রঙের উড়ন্ত ঘোড়া। মেঘবতীকে নিয়ে সেই ঘোড়ায় চড়ে উড়ে যেতে লাগলো পৃথিবীর দিকে। 

পৃথিবীর এক কালো পাহাড়ের চূড়ায় ছিলো সিংবুজিমানের আস্তানা। জাদুকর মেঘবতীকে নিয়ে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই, যেতে যেতে যখন মেঘের দেশের সীমানা প্রায় পেরিয়ে গেলো তখন সে দেখলো একটা অবাক ঘটনা ঘটছে। রাজকন্যা মেঘবতীর শরীর বরফের মতো গলে গলে যাচ্ছে! এমনটা কেন হচ্ছে?

ভাবতে লাগলো সিংবুজিমান। ভাবতে ভাবতেই খুঁজে পেলো সমাধান। রাজকন্যা মেঘবতী মেঘের দেশের মেয়ে। এই মেঘের দেশের শীতল পরিবেশেই টিকে থাকবে। আর পৃথিবীর তাপ এখানকার চেয়ে অনেক বেশি। তাই পৃথিবীতে আসলেই সে গলে যাবে।  এই সহজ হিসাবটা বুঝতে কেন যে তার এতো দেরি হলো, সিংবুজিমান নিজেকে গালাগাল করে আবার ফিরে চলল মেঘের রাজ্যে।

মেঘের রাজ্যে ফিরে এসে মেঘবতীকে নিয়ে পৌঁছলো একটা অনেক উঁচু মেঘের পাহাড়ে। ততক্ষণে মেঘবতীর গলে যাওয়া শরীর আবার ঠিক হয়ে গেছে। সাদা ধবধবে সেই মেঘের পাহাড়ে পৌছে জাদুকর সিংবুজিমান জাদু দিয়ে তৈরি করলো একটা বিশাল রাজপ্রাসাদ। মেঘের পালক দিয়ে তৈরি করা সেই প্রসাদে একটা ঘর তৈরি করলো খুব মজবুত করে। সেই ঘরে এনে বন্দি করে রাখলো রাজকন্যা মেঘবতীকে।

রাজকন্যাকে বন্দি করে বললো- তুমি যেদিন আমাকে বিয়ে করতে রাজি হবে, সেদিনই মুক্তি মিলবে এই বন্দি দশা থেকে। আমি প্রতি সপ্তাহে একবার করে তোমায় দেখতে আসবো। তুমি তোমার ইচ্ছে তখনি আমাকে জানিয়ে দিতে পারবে। মনে রেখো রাজকন্যা, তোমার  রাজি হওয়া বা না হওয়ার মাঝেই তোমার মুক্তি।  এই বলে একটা বিশাল আকারের পাখি হয়ে উড়ে যায় সিংবুজিমান।

প্রচণ্ড রাগে, অভিমানে রাজকন্যা মেঘবতীর বুক ভেঙে যায়। আর কাঁদতে শুরু করে মেঘবতী। মেঘবতীর কান্নায় শুরু হয় বৃষ্টি। মেঘবতীর কষ্টে মেঘের পাহাড় গলে গলে বৃষ্টি হয়ে ঝরে পরে পৃথিবীর বুকে। মেঘবতীর কান্নাও থামে না, পৃথিবীতে বৃষ্টি পরাও বন্ধ হয় না। বৃষ্টির পানিতে ডুবে যায় শহর, গ্রাম, পথ ঘাট। নষ্ট হয় ফসলি জমি। বাড়তে থাকে পৃথিবীর মানুষের দুর্ভোগ। পৃথিবীর সব মানুষেরা ভাবতে থাকে কেন এতো বৃষ্টি হচ্ছে, আর এই বৃষ্টি বন্ধ করার উপায়ই বা কী!

পৃথিবীতে ছিলো একটা বিশাল শহর। সেই শহরের দায়িত্বে ছিলেন একজন দয়ালু রাজা। তাকে সবাই দয়ালু রাজা বলে ডাকতো। প্রজাদের দুঃখ কষ্ট তিনি কখনো সহ্য করতে পারতেন না। তিনি সকলের বিপদে সাহায্য করতেন। আর অপরাধীকে দিতেন কঠিন শাস্তি ।

সেই রাজার ছিলো একমাত্র ছেলে। তার নাম শাহজাদা শুভনীল। সেও ছিলো বাবার মতোই দয়ালু আর অনেক বড় মনের একজন। অন্যদের শুভ হোক এটাই ছিলো তার মূল উদ্দেশ্য। গরীব দুঃখী সকলের বিপদে এগিয়ে যেতো। এই শহরের সকলেই বেশ সুখে শান্তিতে বসবাস করতো। কিন্তু লাগাতার বর্ষণে তাদের শাস্তি আর থাকলো না। শহরের রাস্তা ঘাট সব ডুবে যেতে লাগলো। এরকম বৃষ্টি হতে থাকলে আর কয়েক দিনের মধ্যেই বাড়িঘর ডুবে যাবে। তখন বেঁচে থাকাই মুস্কিল হবে। শহরের গণ্যমান্য লোক রাজদরবারে গেল সাহায্যের জন্য। সকলে গিয়ে দয়ালু রাজাকে বলল এই বৃষ্টির দুর্যোগ থেকে উদ্ধার করতে। রাজা বলল- তোমরা চিন্তা করো না।  আমি কোন না কোন ব্যবস্থা বের করবোই। এটা বলে রাজ জোতিষীকে ডাকা হলো।

রাজার আদেশে রাজ জোতিষী ধ্যানে বসলেন। ধ্যান ভেঙে তিনি জানালেন যে মেঘের দেশের রাজকন্যার ঘোর বিপদ। তিনি বন্দি হয়ে আছেন একটা মেঘ দিয়ে তৈরি বরফের প্রাসাদে। সে ওখানে বন্দি হয়ে দিনরাত কাঁদছে। এই কান্নার জন্য আমাদের পৃথিবীতে অনবরত বৃষ্টি।তাকে বন্দি করেছে জাদুকর সিংবুজিমান। সিংবুজিমানকে পরাস্ত করে রাজকন্যা মেঘবতীকে উদ্ধার করতে পারলেই থামবে এই বৃষ্টি। এছাড়া বৃষ্টি বন্ধ করার আর কোন উপায় নেই।

রাজা জানতে চাইলেন, কেমন করে ওই শক্তিশালী জাদুকর সিংবুজিমানকে পরাস্ত করা যায়। কে পারবে এই কাজ? জোতিষ বললেন- শুধুমাত্র নিঃষ্পাপ কোন রাজকুমার পারবে সিংবুজিমানকে হারিয়ে রাজকন্যা মেঘবতীকে উদ্ধার করতে। যদিও তাকে পেরোতে হবে অনেক বিপদ, তবে এছাড়া আর কোন পথ নেই এই দুর্যোগ থেকে উদ্ধারের। দয়ালু রাজা ডেকে পাঠালেন শাহজাদা শুভনীলকে। আর বললেন, তুমি নিশ্চই পারবে রাজকন্যা মেঘবতীকে উদ্ধার করতে। কারণ আমি জানি যে তুমিই নিষ্পাপ রাজকুমার। শাহজাদা শুভনীল বিনা বাক্যব্যয়েই রাজি হলো মেঘেররাজ্যে যেতে। কারণ পৃথিবীর এই ঘোর বিপদে তাকে তো এগিয়ে আসতেই হবে। শুভনীল বাবা-মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মেঘের দেশের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেল।

শুভনীল তার তেজী সাদা ঘোড়ায় চড়ে ছুটছে। জল জঙ্গল পাহাড় পর্বত ডিঙিয়ে কতদিন যে গেলো তার হিসাব কেউ রাখলো না। যেতে যেতে একটা বনের পাশে নদীর তীর ঘেষে চলছিলো শাহজাদা। হঠাৎ দেখলো একটা বাচ্চা হরিণের পা ধরে নদীতে টেনে নিয়ে যাচ্ছে একটা কুমির। শাহজাদা ঘোড়া থেকে নেমে তলোয়ার দিয়ে কুমিরটাকে ঠেলে দূরে সরিয়ে দিলো। বেঁচে গেলো হরিণ ছানা। মা হরিণটা দৌড়ে এসে তার ছানাটাকে জ্যান্ত দেখতে পেয়ে কিযে খুশি হলো, শাহজাদা শুভনীলকে হরিণী নিজের মাথার একটা ধারালো শিং উপহার দিয়ে বলল- তোমার এ উপকার আমি কখনো ভুলবো না। আমার এই উপহারটা নিজের কাছে রাখো, যখন তোমার তরবারি তোমার কোন কাজে আসবে না তখন এটাকে ব্যবহার করো, নিশ্চই  কাজে লাগবে। এই বলে হরিণ ছানাকে নিয়ে চলে গেলো।

এরপর শাহজাদা একটা গভীর বনভূমি দিয়ে যেতে যেতে দেখতে পেলো একজন দরবেশ একটা গাছের নিচে বসে ক্ষুধায় কাতরাচ্ছে। শুভনীল ঘোড়া থামিয়ে এগিয়ে গেলো তার দিকে। জানতে চাইলো কী হয়েছে। বুড়ো দরবেশ বলল সে কয়েকদিন না খেয়ে ক্ষুধায় কষ্ট পাচ্ছে। শাহজাদার কাছে কেবল একদিনের খাবার ছিলো। আর সে নিজেও না খেয়ে ছিলো দুদিন, কারণ সে তো জানে না যে মেঘের রাজ্যে যেতে আর কতদিন লাগবে। তাই সে খাবার বাঁচিয়ে অল্প করে খায়। এখন এই বুড়ো দরবেশকে ক্ষুধার্ত দেখে খুব মায়া হলো। তাই কিছু না ভেবেই খাবারটা দিয়ে দিলো তাকে।

বুড়ো দরবেশ তৃপ্তি নিয়ে সবটা খাবার খেয়ে নিলো। তারপর শাহজাদার কাছে জানতে চাইলো সে কোথায় যাবে। শাহজাদা শুভনীল সব কথা খুলে বলল তাকে। সব শুনে দরবেশ বলল তুমি অনেক ভালো মানুষ। তোমার জয় হবে। তোমাকে দিয়ে এই পৃথিবীর মানুষের মঙ্গল হবে। কিন্তু শাহজাদা এই পায়ে হাঁটা ঘোড়ায় চড়ে তো তুমি মেঘের দেশে যেতে পারবে না। তোমার তো পঙ্খীরাজ লাগবে। শাহজাদা বলল আমার তো পঙ্খীরাজ নেই। দরবেশ বলল কিচ্ছু চিন্তা করো না। আমি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।

এই বলে দরবেশ তার হাতের ইশারায় কাকে যেন ডাকলো, আর ছুটে এলো একটা প্রকাণ্ড রাজহাঁস। সাদা রঙের প্রকাণ্ড রাজহাঁসটাকে দেখিয়ে দরবেশ বলল তুমি এই রাজহংসের পিঠে চড়ে পৌঁছে যাও মেঘের দেশে। উদ্ধার করো রাজকন্যা মেঘবতীকে। তাহলে পৃথিবীবাসিও মুক্তি পাবে এই বৃষ্টির দুর্যোগ থেকে। শাহজাদা শুভনীল দরবেশকে ধন্যবাদ জানিয়ে উঠে বসে রাজহাঁসের পিঠে। রাজহাঁস শাহজাদাকে নিয়ে উড়াল দেয় আকাশে।

আকাশে উড়ে যেতে যেতে শাহজাদা শুভনীল এর ক্লান্তিতে চোখ বন্ধ হয়ে আসে, এই আকাশপথে ঘুমিয়ে গেলে বিপদ হতে পারে। তাই শাহজাদা শুভনীল জেগে থাকার জন্য গান ধরে, এই আকাশ পথেই উড়ে যাচ্ছিলো একদল নীল পরি। শাহজাদার গানের সুরে মুগ্ধ হয়ে নীল পরির দল তাকে ঘিরে উড়তে লাগলো। এতোগুলো নীল পরিকে দেখে শুভনীল জানতে চাইলো ওরা কেন ওকে ঘিরে উড়ে আসছে, পরির দল বলল- তোমার গানের সুরে মুগ্ধ আমরা, কে গো তুমি, এই রাঁজহংসের পিঠে চড়ে গাইতে গাইতে কোথায় যাও?

শাহজাদা শুভনীল পরিদের কাছে নিজের পরিচয় দিয়ে খুলে বলল সব কথা। শুনে পরির দল সব শুনে বলল- তুমি ভীষণ ভালো মানুষ, আর যাচ্ছো অনেক ভালো কাজ করতে, তাই তোমাকে আমাদের একটা পালক উপহার দিচ্ছি, এটা সাথে রাখলে তোমার উপর কোন জাদুর প্রভাব কাজ করবে না, তাছাড়া অন্যের উপর করা জাদুর প্রভাব কাটাতেও এটা কাজে আসবে। তোমার মঙ্গল হোক, এই বলে চলে গেল পরির দল। আর শাহ্জাদা যেতে লাগলো মেঘের দেশে। যেতে যেতে আকাশের নিচে একেবারে মেঘেদের কাছে চলে গেলো শাহ্জাদা শুভনীল।

গিয়ে দেখলো সেখানে একটা বিরাট অংশজুড়ে মেঘেরা বৃষ্টি হয়ে অনবরত ঝরেই যাচ্ছে, আর একটা অংশে মেঘেরা জমে পাথর হয়ে আছে। শাহজাদা বুঝে গেলো যে এই পাথর হয়ে যাওয়া অংশটাই রাজকন্যা মেঘবতীদের রাজ্যের প্রসাদ ছিলো। যা যাদুকর সিংবুজিমান পাথরে পরিণত করে দিয়েছে। এখানেই হয়তো পাথর হয়ে আছে মেঘবতীর পরিবার। শাহ্জাদা শুভনীল থামলো এসে সেই পাথর হওয়া মেঘের উপর। রাজহাঁসের পিঠ থেকে নেমে শাহজাদা দেখতে পেলো ওর ধারনাই ঠিক। বিশাল মেঘের রাজপ্রসাদ পাথর হয়ে আছে, মেঘের সৈনিক, রাজা রানি সব পাথরের মূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

শাহ্জাদা শুভনীল পরিদের দেওয়া পালকটা বের করে ছুঁইয়ে দিলো রাজপ্রসাদের দেয়ালে। সাথে সাথে ঝলমল করে উঠলো রাজপ্রসাদ। আবার আগের মতো হয়ে উঠলো। এরপর শাহ্জাদা পালকটা ছুঁয়ে দিলো রাজা রানি আর সৈনিকদের শরীরে। সবাই আবার মানুষ হয়ে গেলো আগের মতো। রাজা আর রানি মানুষ হয়ে কিযে খুশি হলো তা আর বলার মতো না। তারপর খুঁজলো তাদের রাজকন্যা মেঘবতীকে। শাহ্জাদা শুভনীল নিজের পরিচয় দিয়ে জানালো যে রাজকন্যা বন্দি হয়ে আছে জাদুকর সিংবুজিমানের তৈরি করা উঁচু প্রাচীরঘেরা মেঘের প্রসাদে। তবে যেখানেই থাক আমি ওকে উদ্ধার করেই নিয়ে আসবো।

মেঘরাজা আর মেঘরানি শুভনীলকে প্রাণভরে আশীর্বাদ করলো। আর যাবার সময় মেঘবতীর ব্যবহার করা একটা নীলরঙের মুক্তোর মালা দিয়ে দিলো শাহ্জাদার হাতে, যেন রাজকন্যা শাহজাদাকে বিশ্বাস করতে পারে। শাহ্জাদা আর দেরি না করে রওয়ানা হয়ে গেলো মেঘবতীকে উদ্ধার করতে। রাজহাঁসের পিঠে চড়ে উড়তে উড়তে আকাশের আর এক প্রান্তে পৌঁছলো শাহ্জাদা। আর সেখানে দেখতে পেলো অনেক উঁচু প্রাচীর ঘেরা একটা বাড়ি, যে বাড়িতেই বন্দি আছে রাজকন্যা মেঘবতী। বাড়িটার চারপাশে ঘুরেও প্রবেশ করার কোন দরজা পেল না শাহ্জাদা।

বেশ কয়েকবার চেষ্টা করে পরিদের দেয়া পালকটা দেয়ালে ছোঁয়াতেই দেখতে পেল দরজা, যা জাদুর মায়ায় অদৃশ্য করে রাখা ছিলো। দরজার প্রবেশ করতেই দুজন ভয়ানক প্রহরী বাধা দিলো শাহ্জাদাকে। তখন শাহ্জাদা তার ধারালো তরবারি বের করে ওদের সাথে লড়াইয়ে নামলো, লড়াইটা বেশিক্ষণ করতে হলো না, শাহ্জাদা শাই শাই করে  একদম টুকরো করে দিলো প্রহরীদুটোর মাথা। আর প্রবেশ করলো বাড়ির ভেতরে।

প্রবেশ করেই শুনতে পেলো রাজকন্যার কান্নার আওয়াজ। শাহ্জাদা দৌড়ে এগিয়ে গেলো বন্দি রাজকন্যার কাছে। রাজকন্যা কে বলল- কেঁদো না মেয়ে, আমি তোমাকে উদ্ধার করতে এসেছি। রাজকন্যা মেঘবতী বলল, বিশ্বাস করি না, এখানে জাদুকর ছাড়া কারো প্রবেশ করা অসম্ভব, তুমি ছল করে আমাকে বিয়ে করতে এসেছো, এবার শাহ্জাদা রাজকন্যার বাবার দেয়া নীলমুক্তোর মালাটা বের করে দেখালো মেঘবতীকে। তারপর নিজের পরিচয় দিয়ে সব কথা খুলে বলল।

রাজকন্যা বুঝতে পারলো যে শাহ্জাদা তাকে সত্যিই উদ্ধার করতে পারবে। আর অনবরত কান্না করে বৃষ্টি ঝরিয়ে পৃথিবীর মানুষের যে ক্ষতি করেছে, সে ব্যপারেও সে অনুতপ্ত হলো। আর এটাও বলল যে, রাজকন্যা আর এভাবে কাঁদবে না। ওরা যখন কথা বলছিলো তখন উড়ে এসে হাজির হলো জাদুকর সিংবুজিমান। এসে শাহজাদাকে দেখেই রাগে চিৎকার করে এগিয়ে এলো মারতে। শাহ্জাদা খুব দ্রুততার সাথে সরে গেলো। জাদুকরের তলোয়ারের আঘাতে পাথর কেটে দুই টুকরো হয়ে গেলো।

জাদুকর আরো ক্ষেপে গেলো। এবার জাদুকর জাদুর ছড়ি দিয়ে শাহ্জাদাকে জব্দ করতে চাইলো, কিন্তু কোন জাদুই শাহ্জাদার উপর কাজ করছে না দেখে জাদুকর ভীষণ অবাক হলো। শাহ্জাদার কাছে যেহেতু পরিদের দেওয়া পালক আছে সেহেতু কোন জাদুই কাজ করবে না তার উপর। এই সময় শাহজাদা তলোয়ার নিয়ে ঝাপিয়ে পরলো জাদুকরের উপর।

শাহ্জাদার হঠাৎ আক্রমণে অপ্রস্তুত ছিলো জাদুকর, তাই তরবারি এসে বিধঁলো বুকে। শাহ্জাদা এবার হাফ ছেড়ে বাঁচলো। দৌড়ে গেলো রাজকন্যা মেঘবতীর কাছে, কিন্তু এগোতে পারলো না। জাদুকর আবার উঠে দাঁড়াল, আর পেছন থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো শাহ্জাদাকে। জাদুকরের বুকে তলোয়ারের আঘাত মুহূর্তেই মিলিয়ে গেলো। শাহ্জাদা বুঝতে পারলো যে জাদুকর সহজে মরবে না। দুজন তলোয়ার নিয়ে আবার লড়াইয়ে নামলো।

তুমুল লড়াই করতে করতে জাদুকরের তলোয়ারের আঘাতে শাহ্জাদার তলোয়ার গেলো ভেঙে। শাহ্জাদা মাটিতে পরে গেলে জাদুকর তার বুকে তলোয়ারে ফলা ঢুকিয়ে দিবে প্রায়, এসময় শাহ্জাদার মনে পরলো হরিণের দেয়া শিংয়ের কথা। শিংটা বের করেই বসিয়ে দিলো জাদুকরের তলপেট। জাদুকর চিৎকার দিয়ে পেছনে সরে গেলো। এবার আর বাঁচার সুযোগ পেলো না জাদুকর সিংবুজিমান।

শাহ্জাদা দেখলো জাদুকরের শরীর থেকে গলগল করে সব রক্ত বেরিয়ে গেলো। আর নিথর হয়ে পরে থাকলো লাশটা। এরপর শাহ্জাদা শুভনীল রাজকন্যা মেঘবতীকে নিয়ে ওর রাজহাঁসের পিঠে চড়ে পৌঁছে গেলো মেঘরাজ্যের রাজপ্রসাদে। রাজকন্যাকে ফিরে পেয়ে সারা মেঘরাজ্যে আনন্দের বন্যা বয়ে গেলো। শাহ্জাদা শুভনীলকে সবাই বীর বাহাদুর খেতাব দিলো। তারপর পৃথিবীর সব মানুষ ও মেঘরাজ্যবাসি সবাই সুখে শান্তিতে বসবাস করতে লাগলো।

এই লেখকের আরও লেখা:

কিডস পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com । সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!