তরীর বোতল বাগান

তরীর রুমের সঙ্গে একটা ছোট বারান্দা আছে। বারান্দার গ্রিলে অনেকগুলো বোতল বাঁধা। কোনটাতে ফুলের গাছ, কোনটাতে পাতাবাহার, কোনটাতে আবার সবজির গাছও আছে। তরী এটাকে তার বোতল বাগান বলে।

কল্যাণী সেনবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 August 2019, 07:05 AM
Updated : 20 August 2019, 07:05 AM

বাড়িতে কোন কোল্ড ড্রিংক্সের বোতল এলেই সেটি তার দখলে চলে যায়। খালি বোতলটিকে সে প্রথমে পেট বরাবর কেটে ফেলে। তারপর তাতে চারটি ছিদ্র করে তারের সাহায্যে বারান্দার গ্রিলের সঙ্গে বেঁধে দেয়। এবার তাতে মাটি ভরে লাগিয়ে দেয় গাছ। এখন পর্যন্ত প্রায় বিশটির মতো গাছ আছে তার বারান্দায়।

বাড়ির কোনকিছু তরী ফেলতে দেয় না। ফেলে দেয়া জিনিসগুলো দিয়ে সে সুন্দর সুন্দর শোপিস বানিয়ে ফেলে। তরীর মা যদি কখনো তার ঘরে ঢোকে, প্রতিবার চিৎকার করতে করতে বেরিয়ে আসে। এতো অগোছালো মেয়েটা! পড়ার টেবিলটা অসংখ্য রঙিন কাগজ, ভাঙা রং পেন্সিল, কলমের শিস, টিস্যু পেপারের রোলার ইত্যাদি হাবিজাবি জিনিস দিয়ে ঠাসা। বইপত্রগুলো দেখলে মনে হয় এখনি হুড়মুড় করে পড়ে যাবে।

বিছানাটাও সেইরকম অগোছালো। কাপড়গুলো চেয়ারের উপর স্তুপ করে রাখা। প্রতিদিন স্কুলে যাওয়ার সময় সালোয়ার পেলে ওড়না পাবে না, ওড়না যদি পাওয়া যায় তখন আবার বেল্ট খুঁজে পাওয়া যাবে না। অনেক খুঁজে ধ্বংসস্তুপের মধ্য থেকে যখন সব বের করা হয় তখন সেগুলো এমন কুচকানো অবস্থায় থাকে যে ইস্ত্রি না করে পরার উপায় থাকে না। কিন্তু ঘরের দক্ষিণ দিকটায় চোখ গেলে মনটা ভাল হয়ে যায়। ঘরের এই একটি অংশ পরিপাটি করে সাজানো। দেয়ালের সাথে ফিট করা শেল্ফটি তরীর নিজের হাতে বানানো সব জিনিস দিয়ে সাজানো।

আইসক্রিমের কাঠি দিয়ে বানানো ফটোফ্রেমে তাদের বাবা-মেয়ের হাস্যোজ্জ্বল ছবিটি এতো প্রাণবন্ত যে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। আইসক্রিমের কাপ আর ওয়ান-টাইম-ইউজ চামচ দিয়ে তরী একটি ফুলগাছ বানিয়ে মায়ের জন্মদিনে উপহার দিয়েছিল। সেটি এতো অপূর্ব, দেখে মনে হয় টবে একটি সত্যিকারের ফুল ফুটে আছে। দিয়াশলাইয়ের বাক্স দিয়ে বানানো পালকিটা দেখলে মনে হবে আড়ং থেকে কিনে আনা হয়েছে। তরীর মোবাইল ধরা নিষেধ। তবু মাঝে মাঝে লুকিয়ে মায়ের মোবাইলে এসব বানানো দেখে সে। অবশ্য মা দেখে ফেললে বকুনিও খায়। তরী লেখাপড়ায় ভালই। ১ম, ২য় না হলেও প্রথম দশজনের মধ্যেই থাকে। তাই মাঝে মাঝে মা একটু আধটু দেখতেও দেয়।

তরী রোজ সকালে তার বোতল বাগানের গাছগুলোতে পানি দেয়। সারাদিন প্রচুর রোদ, বাতাস পায় গাছগুলো। তরীর স্কুলতো দুপুরে, বাসায় আসতে আসতে বিকেল হয়ে যায়। রোজ সন্ধ্যায় তরী গাছদের সঙ্গে কথা বলে। গান গেয়ে শোনায়। সে বইয়ে পড়েছে গাছেরা মানুষের কথা বুঝতে পারে। গাছের সঙ্গে কথা বললে তারা খুশি হয়, তখন গাছে অনেক ফুল ফোটে। তার বেলী গাছটি ফুলে ফুলে সাদা হয়ে থাকে। সাদা আর নীল অপরাজিতাগুলো দেখতে ভারি সুন্দর দেখায়। নাইন-ও-ক্লক ফুলগুলো জামরঙের বলের মতো ফুটে থাকে। এছাড়া গোলাপ, গাঁদা, নয়নতারা, কসমস, ক্যাকটাস গাছেও খুব সুন্দর ফুল ফোটে।

গাছের যত্ন তরী নিজের হাতে করে। তার খুব শখ অ্যাকুরিয়ামে মাছ পালবে। মাকে এখনও রাজি করাতে পারেনি। মা বলেছে, মাছের যত্ন যদি ঠিকমতো না হয় আর মাছ যদি মারা যায় তাহলে সেই কষ্ট নাকি তরী সহ্য করতে পারবে না। তাই এসএসসি পরীক্ষার আগে মাছ কিনে দেয়া হবে না। তরী হিসেব করে দেখেছে সে এখন পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। আর পাঁচটি বছর অপেক্ষা করলে তার এই ইচ্ছেটা পূরণ হবে।

মে মাসের দ্বিতীয় রবিবার মা দিবস। তরীর মা শিক্ষক। মায়ের স্কুলেই মেয়ে পড়ে। বলতে গেলে সারাদিনই মেয়ে মায়ের কাছাকাছিই থাকে। তাই মাকে লুকিয়ে কিছু করা অর্থাৎ মাকে সারপ্রাইজ দেয়াটা একটু কঠিন। তরী অনেকদিন ধরেই চিন্তা করছিল কি করে মাকে চমকে দেয়া যায়।অনেক ভেবে সে একটা বুদ্ধি বের করলো।

আাজ মা দিবস। কাকতালীয়ভাবে স্কুল ছুটি। মা রান্না শেষ করে বসে বসে একটা বই পড়ছিল। তরী এসে মাকে জড়িয়ে ধরে বললো, 'হ্যাপি মাদার্স ডে মা। তোমাকে আমি খুব ভালবাসি।' মাও হেসে মেয়েকে আদর করে দিল। তরী বললো, 'আজ তোমাকে একটা জীবন্ত উপহার দিব। তুমি চোখটা বন্ধ করে একটু অপেক্ষা কর।' বলেই তরী দৌড়ে বের হয়ে গেল। ফিরে এসে মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে বললো, 'এবার চোখ খোলো।'

মা চোখ খুলে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকলো মেয়ের হাতের দিকে। তারপর তাকালো তরীর মুখের দিকে। তরীর মুখখানা আনন্দে ঝলমল করছে। কারণ মাকে সে যতটা সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিল মা বোধ হয় তার থেকে অনেক বেশি অবাক হয়ে গেছে। মায়ের চোখে মুখে মুগ্ধতা। 'এটা তুই বানিয়েছিস!' তরী মাথা নেড়ে সায় দিল। 'কবে?' মা জিজ্ঞেস করলো। 'একবছর ধরে।' শুনে মা আর কথা বলতে পারলো না। তরীকে বুকে জড়িয়ে ধরলো। তারপর হাত পেতে তরীর হাত থেকে নিলো পেঁপে গাছের বনসাই। একটা পাঁচ লিটারের মিনারেল ওয়াটারের বোতলের নিচের অংশটি কেটে তাতে মাটি ভরাট করে এই বনসাইটি তৈরী করা হয়েছে। একফুট উচ্চতার গাছটি একটি পূর্ণাঙ্গ পেঁপে গাছের আকৃতি নিয়েছে। তরী এসব কিভাবে করেছে এবারে বুঝতে পারলো তার মা।

মা তো প্রতিদিন তরীর ঘরে কয়েকবার ঢোকে, তাই এই বাসায় এটি বানানো সম্ভব নয়। তাদের ঠিক পাশের বাসাতে তরীর নানা-নানী থাকে। তার সব আবদার নানা-নানীর কাছে। পাশাপাশি বাসা হওয়ায় মা খুব বেশি সময় ওই বাসায় গিয়ে থাকে না। আর পেঁপে গাছ অতি অযত্নেও দ্রুতই বেড়ে উঠতে পারে। তরী তাই বড় সাইজের বোতলের নিচের অংশটি বেছে নিয়েছে বনসাইটি তৈরি  করার জন্য। তারপর মাটিতে পেঁপের বীজ পুঁতে দিয়েছে। চারাগাছটা যখন একটু বড় হয়েছে তখন সেটিকে একটি শক্ত তার দিয়ে এমনভাবে বেঁধে দিয়েছে যাতে সেটি আর বাড়তে না পারে। তারপর একবছর ধরে তার নানীর বাসার বারান্দায় রেখে গাছটির যত্ন নিয়েছে। প্রয়োজনে পাতা ছেটে দিয়েছে। আজ সেটি সে তার মায়ের হাতে তুলে দিল।

মেয়ের দেয়া জীবন্ত উপহারটি হাতে নিয়ে তরীর মায়ের এক অদ্ভুত অনুভূতি হতে লাগলো। এইতো সেদিন মেয়েটিকে কোলে করে এবাড়িতে নিয়ে এলো। প্রথম যেদিন সে মা বলে ডাকলো সেই আওয়াজটা আজও কানে মধুর মতো লেগে আছে। সেই ছোট্ট সোনামনিটা কবে এতো বড় হয়ে গেল। মায়ের চোখটি যেন ঝাপসা হয়ে আসছে। কিন্তু এই অশ্রুধারা মা লুকালো না। বয়ে যেতে দিল। এ যেন শান্তির বারি।

কিডস পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com । সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!