দেয়ালে টাঙানো সেই সাদা দাড়িওয়ালা

সকাল থেকেই আবহাওয়ার অবস্থা বেশ ভালো নয়। কালো মেঘের সারি আকাশ জুড়ে অনবরত পায়চারি করছে। কখনও কুয়াশার মতো বৃষ্টি ঝরছে।

রানাকুমার সিংহরানাকুমার সিংহ
Published : 5 August 2019, 06:50 AM
Updated : 5 August 2019, 06:50 AM

আজ প্রায় সপ্তাহ খানেক ধরে সূর্যের দেখা নেই। অবিরাম বর্ষণের ফলে চারদিকে ক্যামন অস্বস্তিকর পরিবেশ বিরাজ করছে। মায়ের বাধা সত্ত্বেও স্কুলে যাবার জন্য তৈরি হলো মুমু। স্কুল কামাই করে বাসায় থাকলে মুমুর কিচ্ছু ভালো লাগে না।

একদিন তার সহপাঠী লাবণী, ঐশী, ঝর্ণা, মিতাদের না দেখলে বা ওদের সাথে কথা না বললে তার চোখে-মুখে বিষণ্ণতা নেমে আসে। তাই মা-ও বাধা দিলেন না তেমন করে। একমাত্র মেয়ের কালো মুখ দেখতে চান না মুমুর মা।

খারাপ আবহাওয়ার কারণে স্কুলে উপস্থিতির হার অতি নগণ্য। যদিও আগের দিন নোটিশে সব ছাত্রীদের বলা হয়েছিল স্কুলে নয়টার ভেতর আসার জন্য। কারণ এদিন কবি গুরুর প্রয়াণদিবস ২২ শ্রাবণ পালনের জন্য বিবিধ বিষয়ে ছাত্রী-শিক্ষকদের সম্মিলিত বৈঠক অনুষ্ঠিত হবার কথা।

রবীন্দ্র মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে মুমুদের স্কুলে ব্যাপক অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করা হয়। মুমু কবিগুরুকে নিয়ে লেখা স্বরচিত কবিতা পাঠের জন্য তার শ্রেণি শিক্ষিকার কাছে নাম অন্তর্ভুক্ত করালো। মুমুর মনে তখন প্রচণ্ড ভয় এসেছিল এই কারণে যে, সে তো কবিতা লিখে না, তাহলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে কবিতা লিখবে কিভাবে? অতি উৎসাহে নাম লেখানোর পর নিজের উপরই প্রচণ্ড রাগ হলো মুমুর।

অন্যান্য দিনের চেয়ে এক ঘণ্টা আগে ছুটি হয়ে গেল মুমুদের স্কুল। বাসায় ফিরলো প্রচণ্ড বৃষ্টির মধ্যে। অবশ্য স্কুল ছাউনিতে পাক্কা এক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে ছিলো গাড়ির অপেক্ষায়। গাড়িতে বসেই মুমু মনে মনে একটা কবিতা লিখে ফেলেছিলো। বাসায় আসার পর তা ভুলে গেলো সে। তাই ক্ষোভে তার মন জ্বলছিলো। পোষা প্রিয় বিড়ালের উপর ক্ষোভ ঝাড়লো। এই কাজের জন্য অনিচ্ছা থাক সত্ত্বেও মা তাকে বকলেন।

সারাটি বিকাল কাগজ কলম হাতে নিয়ে সময় কাটিয়ে দিলো মুমু তার পড়ার ঘরে। উদ্দেশ্য ছিল বিশ্বকবিকে নিয়ে কবিতার কয়েকটি চরণ লিখার। কিন্তু এত সময় চেষ্টা করেও একটি অক্ষরও লিখতে পারলো না সে। ধবধবে সাদা কাগজের উপর শুধু এঁকে-বেঁকে দাগ টেনেছিলো। সেই সব দাগ দেখে তার মনে  হলো ওসব যেন শিল্পীর হাতে  টানা নিপুন চিত্রকর্ম। পরক্ষণেই এই মন্তব্যকে তার খুবই বাজে মনে হলো।

মুমু সাধারণত সন্ধ্যায় ঘুমায় না। কিন্তু সেদিন সন্ধ্যা হতেই নিদ্রা রাণীর স্নেহের আবেশে জড়ানো নিজেকে। মুমু এখন এক মনোরম জায়গায় নিজেকে আবিষ্কার করলো। জায়গাটিতে শুধু সবুজের সমারোহ। ধবধবে নীলাকাশ হাজার পাখির কুজনে মুখরিত। তার চারপাশে শুধু নানা রকম বৈচিত্র ভরা বৃক্ষ। সেখানে কোনো দুঃখ বেদনার ছোঁয়া পর্যন্ত নেই।

নানারকম প্রাণী ভয়হীন চিত্তে ঘুরে বেড়াচ্ছে তাদের মনমতো। প্রথমে এই অচেনা স্থানে কিছুটা ভয় পেলেও পরক্ষণে পরিবেশ পরিস্থিতি তাকে স্বাভাবিক করে তুললো। ধীরে ধীরে মুমু সেই স্থানের সবুজ ঘাসের গালিচার উপর দিয়ে হাঁটতে লাগলো। না, কোনো জনমানবের দেখা নেই।

হাঁটতে হাঁটতে মুমু একটি নদীর তীরে এসে পৌঁছালো। কি সুন্দর সেই  নদীর জল! লক্ষ লক্ষ মাছ সেই নদীটির কাকচক্ষু জলে খেলা করছে। তাদের মনে কোনো ভয় নেই। মুমুর প্রচণ্ড তৃষ্ণা পেল। দুই হাত দিয়ে পেট ভরে অই নদীর পানি পান করলো সে। পানি পান করে নদী থেকে উঠতে যাবে যখন, তখন মুমুর কানে ভেসে এলো আবৃত্তির সুরেলা শব্দ।

মুমু ভালো করে চারপাশে তাকালো। কিন্তু কাউকে দেখতে পেলো না। হঠাৎ পেছন থেকে কে যেন বলে উঠলো, ‘এই মেয়ে এখানে তুমি একা একা কী করছ?’ মুমু চমকে পেছন ফিরে তাকালো। সে দেখতে পেলো, সাদা শ্মশ্রুমণ্ডিত এক বৃদ্ধকে। সে মিটিমিটি হাসছিলো। মুমু কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,তুমি কে?

-আমাকে চিনতে পারছো না ? মৃদু হেসে বৃদ্ধ বললো

-না, তো! তোমাকে কখনো দেখেছি বলে মনে পড়ে না।

-আমি রবি। চিনতে পারছে খুকি?

-কোন রবি? আমাদের পাড়ার রবিতো বুড়ো নয়।

-তাহলে?

-চিন্তা করে দেখো।

মুমু কিছুক্ষণ চুপ থাকলো। তারপর কাঁপা কাঁপা গলায় বললো- তুমি বিশ্বকবি না?

-এতক্ষণে চিনলে খুকি?

-বিশ্বাস করো তোমায় প্রথম চিনতে পারিনি। এবার মুমু খানিকটা অন্যমনস্ক হলো। বৃদ্ধ বললো-

তোমার নামটা কি যেন?

-সৈমন্তী মুমু। সবাই মুমু বলে ডাকে। আচ্ছা গুরু তুমি তো মৃত, কিন্তু তুমি এখানে কী করে সম্ভব?

বৃদ্ধ মৃদু হাসলো। তারপর বললো এটা হলো আমার সৃষ্টিরাজ্য। এখানে কোনো কালিমা নেই, দুঃখ নেই, ভয় নেই, আছে মানবতার কথা। আমি মানবতার কথাই বলি।

মুমু নিঃশব্দে তাঁর কথা শুনছিলো। তারপর বলল-তোমাকে নিয়ে কিছু লিখবো ভেবেছিলাম। কিন্তু পারছি না। আমাকে একটা কবিতা শিখিয়ে দেবে?

হঠাৎ বৃদ্ধ অদৃশ্য হয়ে গেলো। মুমু চিৎকার  করে বললো-

কোথায় তুমি? আমাকে একটা কবিতা শিখিয়ে দাও।

‘এই মুমু কী হয়েছে? ওরকম করছিস ক্যানো?’ মুমুর মা ব্যস্ত হয়ে বললেন। মুমু এখনো স্বপ্নে দেখা প্রলাপ বকছিস। ধীরে ধীরে চোখ খুললো মুমু। তার সামনে তখন মা দাঁড়িয়ে। মুমু অবাক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো, ‘কবি কোথায় মা? বিশ্বকবি, কবিগুরু। মা তার কথা শুনে খু-উ-ব অবাক হলেন এবং বললেন‘স্বপ্নে কী-না কী দেখেছিস তাই নিয়ে বাড়ি মাথায় তুললি।  যা তাড়াতাড়ি খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড় কালকে সকালে আবার গানের ক্লাস রয়েছে।

মুমু পিটপিট করে দেয়ালে টাঙানো সাদা দাড়িওয়ালা সেই মহান ব্যক্তির ছবির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলো। তার মনে তখনো স্বপ্নদৃশ্যের সেই অচেনা জায়গা ভাসছিলো কী মধুরভাবে।

খুব ভোরে উঠলো মুমু। প্রতিদিনকার মতো দাদু ভাইয়ের সাথে জগিং করলো। জগিং শেষে বাসায় ফিরে হাত-পা ধুয়ে সোজা চলে গেলো পড়ার ঘরে। কাগজ কলম হাতে নিয়ে চুপচাপ কিছুক্ষণ বসে থাকার পর বিরতিহীনভাবে আট লাইনের একটা কবিতা লিখে ফেললো মুমু।

সেই কবিতা পড়তে পড়তে মুমু নিজেই অবাক হলো সে কিভাবে কবিতাটা লিখলো। ওর নিজের  লেখা কবিতা নিজের বলে বিশ্বাস করতে কষ্ট হলো।স্কুলের অনুষ্ঠানে মুমুর রচনা ও আবৃত্তি শ্রেষ্ঠ পুরস্কার পেল। মুমুর উজ্জ্বল মুখ সেই ক্ষণে আরো উজ্জ্বল লাগছিলো যখন সে কবিতাটি আবৃত্তি করছিলো।

কিডস পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি,সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানাkidz@bdnews24.com । সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!