আত্মপরিচয়

বাবার মৃত্যুর পর মায়ের অবস্থা ভালো যাচ্ছে না। মা মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছে। মায়ের দেখাশোনা করার জন্য একজনকে রাখা হয়েছে। তবুও মায়ের উন্নতির চেয়ে অবনতি বেশি।

শাহরিয়ার সিফাতবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 June 2019, 08:47 AM
Updated : 7 June 2019, 09:49 AM

আর আমি তো দিন দিন ছন্নছাড়া হয়ে পড়ছি। খেয়াল করার মতো কেউ নেই। পড়াশোনা কেমন করছি, আমার কোনো অসুবিধা হচ্ছে কিনা এসব জানার একটা মানুষও নেই আমার পাশে। আমি এখন নবম শ্রেণিতে পড়ি। বাবার মৃত্যুর এক বছর হয়ে গেল। বাবার মৃত্যুর পর আমার জীবনটাও কেমন করে জানি বদলে গেল।

আর মা তো চিরদিনের জন্য বদলে গেল। যেখানে মা নিজের প্রতিই খেয়াল রাখার জ্ঞান হারিয়েছে, সেখানে আমি এক ক্ষুদ্র প্রাণ! আমাকে খেয়াল রাখবে কী করে? তবুও মাঝে মাঝে মনে হয়, মা আমাকে একটু আদর করে দিক। কতদিন আদর পাই না। মা সারাক্ষণ বাকরুদ্ধ হয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। কারো সঙ্গে কথাও বলে না। মা শুধু যে নিজের বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছে, তা নয়। নিজের চালিকাশক্তিও হারিয়ে ফেলেছে। তাই সবসময় হুইল চেয়ারে বসে থাকে, কখনো বিছানায় শুয়ে। এভাবেই দিন পার হয়ে যায় মায়ের। কিন্তু আমার তো দিন পার হতে চায় না।

এদিকে পাড়ার ছেলেরা আমাকে নিয়ে ঠাট্টা করে, কানাঘুষা করে। আমার খুব খারাপ লাগে। আমি কী এমন অপরাধ করেছি, যার কারণে আমাকে এই কষ্টগুলো ভোগ করতে হবে? ওরা আমাকে কখনোই সহপাঠী ভাবতে চায় না, ভাবতেও পারে না। আমাকে তাদের সঙ্গে নিতে চায় না, একটু খেলতেও দেয় না। সারাক্ষণ শুধু নিগ্রহ ও উপহাসের পাত্র হিসেবেই তারা আমাকে গণ্য করে।

আমার খুব কষ্ট হয়, চাপা কষ্ট। আমার কথাগুলো কে শুনবে? কেউ তো নেই। বাবাকে হারিয়েছি। মা-সে তো চেতনাহীন, জীবন থেকেও যেন নির্জীব। আমার কেউ নেই। আর সেই সুযোগে পাড়ার ছেলেরা আরো বেশি করে আমাকে নিয়ে উপহাস করার সুযোগ পেয়েছে। আমি যেন তাদের বিনোদনের একমাত্র খোরাক! তাই কখনো খেলার সাথী পাইনি। মাঠে একা একাই ফুটবল নিয়ে দৌড়ে বেড়িয়েছি।

কখনো মাঠে যাওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছি, তাদের নোংরা উপহাসের পাত্র বনে যাওয়ার ভয়ে। কিন্তু কী করব? আমার তো কেউ নেই। বাসায় বসে আর কতক্ষণ থাকা যায়? আমারও তো একটা জীবন আছে। আমারও তো ইচ্ছে করে, আমার বয়সী ছেলে-মেয়েদের মতো একটু আনন্দে মেতে থাকতে, একটু প্রাণ খুলে হাসতে, সহপাঠীদের সঙ্গে মিশতে। কিন্তু আমি তো পারি না। বারবার নিগৃহীত হয়ে ফিরে আসতে হয় আমাকে।

আমি অতীত খুঁজতে যাই না। আমার জন্ম যেভাবেই হোক, যে ধর্মের মানুষই আমি হয়ে থাকি। আমার জন্ম হয়েছে একটা নিষ্পাপ শিশু হিসেবেই। আমার কি পাপ ছিল? আমার মতো ছেলে-মেয়েরা যখন জন্মের পর নিষ্পাপ হয়ে জন্মায়, সেখানে আমাকে কেন পাপের বোঝা বইতে হবে? সমাজ কীভাবে একটা নিষ্পাপ শিশুকে লেপন করে দেয় পাপের কালিমা? ওরা কি এই পাপের চেয়েও বড় পাপ করে ফেলে না তখন? এই কথাগুলো বলার মতো কেউ নেই! আসলেই আমার তো কেউ নেই।

আমার বাবা-মা ছিল নিঃসন্তান। ডাক্তার বলেছিল, আমার মায়ের কখনো বাচ্চা হবে না। এই দুঃখে যখন তারা সন্তানহীন দিনযাপন করছিল, তখন আমার জন্ম। আমার জন্মটা কাঙ্খিত না অনাকাঙ্খিত আমি জানি না। আমার মতো একটা নিষ্পাপ শিশুকে তারা ডাস্টবিনের মতো আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করে ফেলে গিয়েছে। আমার জীবন সেদিনই শেষ হয়ে যেত, যদি না রাস্তার সেই রিক্সাওয়ালা সদ্যোজাত আমাকে নিয়ে হাসপাতালে না যেতেন।

আমার জীবন মৃত্যুর পথে এত ধাঁধাঁ, আর কোনো জীবনে ঘটেছে কিনা জানা নেই। আমার জন্মদাতা-জন্মদাত্রী আমার মৃত্যু কামনা করে ডাস্টবিনে ফেলে রেখে গেল। আর একজন সাধারণ রিক্সাওয়ালা আমার জীবন বাঁচিয়েছেন। হ্যাঁ, এরাই পৃথিবীর সবচেয়ে সেরা মানুষ। যার কারণে আমার জীবনটা সেদিন রক্ষা পেয়েছিল। যার কারণে এই সুন্দর পৃথিবীর আলো বাতাসে বেড়ে উঠছি নতুন পরিচয়ে।

আমার এই দুর্বিষহ জীবনে, সেদিনের বেঁচে যাওয়াটাকে আমি দুর্ভাগ্য মনে করতে পারি না। কেননা, আমার মতো কত নিষ্পাপ শিশুই তো প্রতিদিন এভাবে হত্যার শিকার হচ্ছে। আমার মতো কত শিশুই ডাস্টবিনে মরে-পচে-গলে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। ক্ষুধার্ত কুকুরের খাদ্য হয়েছে কত সদ্যোজাত নিষ্পাপ শিশু। সেখানে আমি সুযোগ পেয়েছি পৃথিবীর আলো বাতাসে বেড়ে উঠার। আমিও তো সেদিন ডাস্টবিনে ক্ষুধার্ত কুকুরের খাদ্য হতে পারতাম, আমার দেহ গলে-পচে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারতো।

সেদিন রিক্সাওয়ালা মহৎ মানুষটি আমাকে হাসপাতালে নেবার পর কেউ আমার বর্তমান বাবা-মাকে খবর দেয়। তাদের সন্তান না থাকায়, আমাকে তারা দত্তক নেয়। আমি পেয়ে যাই আমার পরিচয়। সেখানেই আমার বেড়ে ওঠা। আর তারাই হয়ে যায় আমার বাবা-মা। আমাকে খুব আদর যত্নে ছোট থেকেই মানুষ করেছে তারা। কিন্তু আমার বাবার মৃত্যুর পর সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়। সেদিন যদি এমন একটা দুর্ঘটনা না ঘটত, তাহলে আজ হয়তো সবকিছুই ঠিকঠাক থাকতো। কেউ হয়তো সাহস পেত না, আমাকে নিয়ে, আমার জন্ম পরিচয়, আমার ধর্ম পরিচয় নিয়ে প্রশ্ন তোলার।

একদিন বিকেলে মাঠে ফুটবল নিয়ে একাই খেলতেছি। কিছু ছেলে আমাকে দেখলেই উপহাস করে, কটাক্ষ করে কথা বলে। আজও তার ব্যতিক্রম নয়। আজও তারা একই কাজটি আমার সঙ্গে করে ফেলল। মুহূর্তে ভাবলাম, প্রতিবাদ না করলে এরা আরো সুযোগ নিবে, এরা মাথায় উঠে যাবে, আমার মতো অন্য কাউকেও এভাবে উপহাস করবে। আমি এটা মানতে পারি না, নিরব দর্শক হয়ে অন্যায়কে নির্দ্বিধায় সায় দিতে পারি না। আমি ক্রোধ সংবরণ করতে না পেরে সেদিন প্রতিবাদ করেছিলাম।

মায়ের শরীর খারাপ। আগের চেয়ে ভীষণ খারাপ। রাতে খাওয়া শেষে মায়ের বিছানার পাশে কিছুক্ষণ বসে থেকে মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছিলাম। জানি না মায়ের কেমন অনুভূতি হয়েছিল। মনে হচ্ছিল, আজ মা যদি সুস্থ থাকতো, ঠিক এভাবেই আমার মাথায় হাত বুলিয়ে আমাকে ঘুম পাড়াতো। সেই সুখ ভোগের সুযোগ হয়নি আমার। আমাকে মেনে নিতে হয় এই চরম বাস্তবতার মুহূর্তগুলো। যে মুহূর্তগুলো আমাকে হাজারবার ভেঙ্গে দ্বিখণ্ডিত করেছে। তবুও হেরে যাইনি। হারতেও চাইনি কখনো। যে ছেলেটা জন্মের পরই হারতে হারতে জিতে গিয়ে বড় হয়েছে- সে কখনো হারতে পারে না।

বিকেলের ঘটনাটা বারবার মনে আসছে। গভীর রাত হয়ে যাচ্ছে, তবুও ঘুম আসছে না। মনে প্রশ্ন জাগছে, জন্ম পরিচয়ই কি বেঁচে থাকার মূল চালিকাশক্তি? ধর্মও কি তাই? এসব ছাড়া কি কেউ স্বাভাবিকভাবে সমাজে বাস করার অধিকার রাখে না? আমার মতো শিশুও না? প্রত্যেকটা শিশু জন্মের সময় থেকে নিজেদের চোখে পৃথিবী আলোকিত করার অনুপ্রেরণা পাক। বংশ কিংবা ধর্ম-কোনো পরিচয়েই বড় না হয়ে বেড়ে উঠুক নিজ পরিচয়ে। এ ভাবনায় ঘুমিয়ে গেলাম একটি নতুন আলোকিত সকালের আশায়। যে সকাল আলোকিত করবে, অনুপ্রেরণা জোগাবে আত্মপরিচয়ে বেড়ে উঠার জন্য আমার মতো সব শিশুদের।

লেখক: এইচএসসি শিক্ষার্থী, কারমাইকেল কলেজ, রংপুর