আগমনী বৈশাখকে নিয়ে একটি রচনা

আমাদের গ্রামটা ছবির মতো। বিভিন্ন গল্প-উপন্যাসে তোমরা একথা শুনে থাকবে। অনেকেই এভাবে তুলনা দিয়ে থাকে। কিন্তু আসলেই আমাদের গ্রামটা অনেকটা ছবির মতোই।

সাদিক আল আমিনবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 April 2019, 07:27 AM
Updated : 1 April 2019, 07:27 AM

গ্রামের বাম হাত ধরে নদী লক্ষ্মী চলে গেছে। ডান হাত ধরে সারি সারি ধানের ক্ষেত। মাথা ধরে বিশাল শালবাগান আর পা ধরে রয়েছে বিলের মাঝে শতশত অতিথি পাখিদের ডাক। শীতে যেমন অতিথি পাখিতে পুরো গ্রামের বিলগুলো সয়লাব হয় যায়, তেমনি গ্রীষ্মেও পড়ে ধুম।

এখনকার সময়টা গ্রীষ্মের শুরু। মানে বৈশাখের গায়ে হলুদ। এই গায়ে হলুদে নিমন্ত্রিত হয়েছে পুরো গ্রামবাসী। শীতের বিদায় শেষে এখন বৈশাখের আগমন হবে। সেজন্য নিজ রূপ বদলেছে প্রতিটি বস্তু-ব্যক্তি-উপাদান। দুপুরবেলা ভরা রোদে মুগ্ধ হয়ে দেখে থাকার মতো হয় আমাদের গ্রাম। আনোয়ার চাচাও ক্ষেতে কাজ করতে করতে ক্লান্ত হলে শীতল আমতলায় বসে মনের সুখে গান গায় আর তার নিত্যসঙ্গী লাল-হলুদ রঙের বাঁশিটা বাজায়। আমাদের মন সেই আওয়াজ শুনে কেমন যেন আবেগে ভরে ওঠে। সেই সুরে বিরহ আর আনন্দ দুটোই আছে যেন!

আসছে বৈশাখের কালবৈশাখী ঝড় নিয়ে আমার বন্ধু আলেয়ার উত্তেজনার শেষ নেই। আমার সঙ্গে আগেই কথা বলে রেখেছে যে মাঝরাতে ঝড় হলে চুপিচুপি আম কুড়োতে যাবে। মেয়েমানুষ হয়ে মধ্যরাতে আম কুড়োতে যেতে চাওয়ার সাহস দেখে আমি অবাক হই। আমার আরেক বন্ধু রশিদ আলেয়ার সাহসের কাছে দুধ-ভাত। একটা সহজ কাজ করতেও সে দশবার ভাবে। আমার সাহস আছে না ভয় আছে বুঝতে পারিনা। তবে আলেয়ার সাথে আম কুড়োতে যেতে রাজি হই।

ঠাণ্ডা বাতাস শরীরে যখন ঝাপটা দেয় আর ঝিরঝিরে বৃষ্টি যখন গায়ের ওপর এসে পড়ে, তখন খুব সুখ অনুভব করি। মনে হয় যেন সারারাত আম কুড়োতে কুড়োতেই কাটিয়ে দেই। তারপর হঠাৎ বিজলী চমকালে আলেয়া কিছুটা ভয় পেয়ে গিয়ে আমাকে বলে, ‘চল বাড়ি যাই’। সাহসী মেয়েটার ভয় দেখে আমি ভড়কে যাই। আবার মজাও পাই। ওকে আরেকটু ভয় দেখাতে ইচ্ছে করেই দেরি করি আমি। এবারও ঝড়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আম কুড়োতে যাবো বলে আনন্দ অনুভব করি।

আগমনী বৈশাখকে নিয়ে কার্তিক স্যার একটা রচনা লিখতে বললে সবাই লিখে নিয়ে যাই। আমার রচনাটা সবার চেয়ে ভালো হয়েছে বলে স্যার মন্তব্য করেন। স্যার আমার ওপর খুশি হয়ে একটা বড় দায়িত্ব আমার কাঁধে চাপিয়ে দেন। গ্রামে যতগুলো অনাহারী-গরীব-দুঃস্থ শিশু আছে, যারা আমার সমবয়সী প্রায়, তাদের একটা তালিকা করতে বলেন। আমি স্যারকে কিছু জিজ্ঞেস না করে তালিকা জমা দিয়েই ক্ষান্ত হই। কারণ জানতাম স্যার মহৎ উদ্দেশ্যেই কিছু একটা করবেন! তাই আর আলাদাভাবে স্যারকে জিজ্ঞেস করিনি।

ক্লাসের জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতেই দেখি কৃষাণ চাচারা ক্ষেতের আইল পাড়ছে, পানি দিচ্ছে, সার দিচ্ছে। তাদের শরীরেও যেন গ্রীষ্মের মধুর আমেজ দেখা যায়। এ মৌসুমে তাদের কিছু বাড়তি রোজগার হয় গ্রামের বৈশাখী মেলায় দোকান দিয়ে। অনাগত পাখিরা যেখানে এসে প্রতি শীতে আশ্রয় নেয়, সেই বিলের বিপরীতেই বসে বৈশাখী মেলা। প্রতি বছরেই বৈশাখে এমন মেলা বসে আমাদের গ্রামে।

মেলায় আমি একা একা অথবা বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে যাই। নাগরদোলায় চড়ি, মিঠাই খাই, অনেক মজা করি। এবারের বৈশাখী মেলায় চিন্তা করেছি আমিও একটা দোকান দেবো! রঙিন পুতুল বানাতে যেহেতু পারি, আর অনেকগুলো যেহেতু জমা হয়ে আছে, সেগুলো বিক্রি করতে পারলে প্রতিদিন আইসক্রিম খাওয়ার টাকাটা ঠিকই উঠে যায়। আলেয়াকে এ ব্যাপারে বললে সে অবশ্য একটা পুতুল ফ্রি নিতে চায়!

অনেক প্রতীক্ষা ও আয়োজনের পর পহেলা বৈশাখ তার রঙিন রক্তিম রূপ আমাদের দেখালো। গাছে গাছে তখন পাখিদের দূরন্তপনা, তরুণ হতে থাকে পাতারা, সোনালি সবুজ হয়ে ওঠে ফসলের ক্ষেত, নদীর বুকে উথাল-পাথাল স্রোতে ভেসে যায় যেন পাগল মন! আনোয়ার চাচার বাড়িতে পহেলা বৈশাখে পান্তা আর ইলিশের দাওয়াত। পেট পুরে খাওয়ার পর বন্ধুদের সঙ্গে মেলায় যাই আমার পুতুলগুলো নিয়ে। মেলা ভালোভাবে ঘুরে, অনেক আনন্দ করার পর পুতুলের দোকান দেবার আয়োজন করি।

সবগুলো পুতুল এক ঘণ্টার মধ্যেই বিক্রি হয়ে যায়। হাতে আসে বিশ টাকা। মনে মনে খুব খুশি হলাম। এই টাকা দিয়ে ইচ্ছেমতো আইসক্রিম খাওয়া যাবে। কে যেন আমাকে ডাকছে বুঝতে পেরে পেছনে ঘুরে দেখি কার্তিক স্যার। স্যার আমার পিঠে হাত রেখে বললেন, ‘চল আমার সঙ্গে৷ কিছু কাজ আছে। রশিদ আর আলেয়াকেও নে’। এতো সুন্দর জমজমাট মজাদার মেলে ছেড়ে স্যারের সঙ্গে যেতে হবে ভেবে মন খারাপ হয়ে গেল। হয়তো স্যার এখন কোনো কিছুর ওপর রচনা লিখতে দেবেন!

আমরা তিনজন মন খারাপ করে স্যারের পিছুপিছু চললাম। কিন্তু স্কুলে এসেই আমাদের মন ভালো হয়ে গেল। আমি যেসব অনাহারী শিশুদের লিস্ট করে স্যারকে দিয়েছিলাম, স্যার তাদের সবাইকে ক্লাসে ডেকে এনেছেন। আমাদের বুঝতে আর দেরি রইলোনা যে স্যার এই গরীব অনাহারী শিশুদের খাওয়ানোর জন্যই এই ব্যবস্থা করেছেন। সারের প্রতি কৃতজ্ঞতায় মনটা ভরে গেল আমাদের। মনের খুশিতে আমরা শিশুদের মাঝে খাবার ভাগ করে দিলাম। শিশু বলতে ভুল হবে, তারাতো আমাদের মতোই। আমাদেরই বয়সী। কিন্তু খেতে না পেয়ে পেয়ে যেন আকারে ছোট হয়ে গেছে!

খাওয়া শেষ হলে স্যার সবার উদ্দেশ্যে কিছু কথা বললেন। এই আকস্মিক আয়োজনে তারা খুশি হয়েছে কিনা জানতে চাইলেন। সবাই এতো জোরে চিৎকার করে আনন্দধ্বনি জানালো যে বোঝা গেল তারা বেজায় খুশি হয়েছে! স্যার আরো একটু উদ্যোগ নিলেন, সেসব গরীব বঞ্চিত ছেলেমেয়েদের বিনামূল্যে পড়াবেন বলে ঘোষণা দিলেন। সবাই আরো জোরে চিৎকার দিয়ে উঠলো। কিন্তু তার চেয়েও জোরে আমি চিৎকার দিলাম মনে মনে। স্যার এতো ভালো হতে পারেন জানতাম না।

কাল থেকে এলাকার পিচ্চি গুণ্ডা আমার প্রিয় দুই বন্ধু সেলিম আর তার ভাই রহিমও যে আমাদের সঙ্গে পড়বে, ভেবে আরো খুশি লাগতে লাগলো। এবারের বৈশাখে এটাই আমার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। আলেয়া আর রশিদও আমার মতো অনেক খুশি হয়েছে। সেদিন সবাইকে নিয়ে কার্তিক স্যার আবার মেলায় গেলেন। নাগরদোলায় চড়ালেন, বায়োস্কোপ দেখালেন, মুড়ি-মুড়কি, বাতাসা, লাড্ডু খাওয়ালেন। রঙিন মেলা যেন আরো রঙিন হয়ে যেতে লাগলো।

লেখক: শিক্ষার্থী, কৃষি অনুষদ, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

কিডস পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com। সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!