ছোটগল্প: লাল বাইসাইকেল

বন্ধু সজীবের লাল সাইকেলটা দেখে একপ্রকার হিংসেই হয় রিজুর। রোজ রোজ ওকে একা একা রিকশায় চেপে আসতে হয় স্কুলে। রিকশাগুলোও আবার এতো আস্তে চলে যে রিজুর বিরক্তির সীমা চরমে পৌঁছে।

সাদিক আল আমিনবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 March 2019, 06:00 PM
Updated : 19 March 2019, 06:00 PM

রিজুকে দেখিয়ে দেখিয়ে আবার দুষ্টু সজীব ওর রিকশাকে বুড়ো আঙুল তুলে চলে যায় জোরে সাইকেল হাঁকিয়ে। লাল সাইকেলে রোদ পড়লে চকচক করতে থাকে। সজীবের এঁকেবেঁকে স্টাইল করে সাইকেল চালানো রিজুকে হিংসায় ফেলে। নিজের একটা সাইকেল না হলে যেনো হয়-ই না।

তাইতো সেদিন বাসায় এসে বাবাকে অনেক অভিমানের সুরে রিজু বলে,

‘বাবা, রোজ রিকশায় করে স্কুলে যাওয়া আসা করতে আমার একদম ভালো লাগেনা।’

‘কেন ভালো লাগেনা বাবা?’

‘কেমন যেনো লাগে নিজেকে। বুড়ো মানুষ রিকশায় চড়ে। আমি কি বুড়ো?’

বিরক্তি নিয়ে বলে রিজু। বাবা ওর ব্যাপারটা বুঝতে পেরে স্নেহের স্বরে প্রশ্ন করেন,

‘তাহলে তুই কী চাস বাবা?’

‘একটা লাল টুকটুকে সাইকেল। সেটাতে চেপে প্রতিদিন আমি স্কুলে যাবো। সজীব যেমন যায়। সাইকেল নিয়ে আমিও ওকে দেখিয়ে দেবো যে আমিও সাইকেল রেসে ওর থেকে কম নই।’

নিঃশ্বাস ফেলে রিজু। মনের ভেতর সাইকেল চালিয়ে স্কুলে যাওয়ার ইচ্ছেটা প্রচণ্ড পেয়ে বসে ওকে।

‘কিন্তু তুই তো সাইকেল চালাতে পারিস না। স্কুলে যাবি কিভাবে?’

‘সেটা আমি শিখে নেবো। তুমি আগে কিনেই দাওতো!’

ছেলের এমন আবদারে না করতে পারেনা রিজুর বাবা। সামনের মাসে বেতন পেলে ওকে একটা চকচকে সাইকেল কিনে দেবে বলে প্রতিশ্রুতি দেন। রিজু অনেক খুশি হয়ে পরদিন স্কুলে গিয়ে বন্ধুদের গল্প শোনাতে থাকে যে তার বাবা তাকে খুব সুন্দর একটা সাইকেল কিনে দেবেন। বাসায় ঘুমোনোর সময়ও চোখ বুজে সে সাইকেলের স্বপ্ন দেখতে থাকে। খুব সুন্দর একটা সাইকেলে চড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে রিজু। বাতাসে তার চুল উড়ছে। এক প্যাডেলেই যেনো খুব দ্রুতগতিতে ছুটছে তার সাইকেল! বাসের সঙ্গে পাল্লা দিতেও পারে এমন ক্ষমতা যেনো!

রিজু ক্লাসের বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলার সময় ঢাকঢোল পিটিয়ে কথাটাকে আরো বড় করে তোলে। তার সাইকেলটা যে সজীবেরটার চেয়েও দ্রুতগতিতে চলবে আর কেউ তার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারবেনা; এবং ক্লাস ফাইভের মেয়েরাও যে ড্যাবড্যাব চোখে তার সাইকেল চালানো দেখে থাকবে, একথা বেশ বুক ফুলিয়েই বলতে থাকে রিজু। অনেকেই ওর কল্পিত সাইকেলটা নিয়ে উৎসাহও প্রকাশ করে।

কেউ কেউ আবার টিটকারি মারে। এক্ষেত্রে সজীবের হিংসে একটু বেশি-ই বলে মনে হয় রিজুর। কেউ আবার ‘সাইকেলহীন সাইকেলম্যান’ বলেও ক্ষ্যাপায় ওকে। কিন্তু রিজুর দৃঢ় বিশ্বাস আর কিছুদিনের মধ্যেই সাইকেলটা ওর হাতে আসছে।

বাবা রিজুকে সাইকেলটা কিনে দেওয়ার পর রিজু রোজ রোজ স্কুলে যায় আর ছুটি হলে হিরোর মতো চুল উড়িয়ে বাসায় ফেরে। চালানোটা দশদিনের মধ্যে শিখে যায় রিজু। পুরনো রাইডার সজীবও এখন ওর সঙ্গে রেসে পাল্লা দিয়ে পারেনা। ওর এই হঠাৎ উঠতি দেখে স্কুলে আর যাদের সাইকেল নেই, তারা হিংসে করতে থাকে।

একদিন এক ঘটনা ঘটে। রিজু প্রতিদিনের মতো সেদিনও স্কুলে হিরোর মতো এসে সাইকেলটা গ্যারেজে রেখে ক্লাস করতে যায়। ঠিকমতো ক্লাস করার পর ছুটি হলে গ্যারেজে এসে দেখে ওর সাইকেলটা আর আগের মতো দেখাচ্ছে না। সাইকেলের সিটটা ব্লেড দিয়ে কাটা, চাকায় কাঁটা ফুটোনো, বেলটা পুরো উঠাও, চেইনটা ছিঁড়ে দু'ফাঁক হয়ে পড়ে আছে।

সুন্দর চকচকে প্রিয় সাইকেলটার এই অবস্থা দেখে খুব হতাশ হয়ে পড়ে রিজু। এর মূল হোতা যে সজীব তা বুঝতে আর দেরি হয়না। হেঁটে হেঁটেই ওভাবে ছন্নছাড়া সাইকেলটা নিয়ে বাড়ি আসতে হয় রিজুকে। স্কুলের সব ছেলেরা ওর অবস্থা দেখে হিহি করে হাসে। সবাই ‘হিরো এখন জিরো’ বলে ক্ষ্যাপাতে থাকে। প্রচণ্ড কান্না পেলেও কোনোমতে কান্না চাপিয়ে রাখে রিজু।

প্রতিদিন খুব যত্ন করা সাইকেলটার যে এই অবস্থা হবে বিশ্বাসই করতে পারেনা রিজু। বাবাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলে,

‘সব ওই সজীবের কাজ বাবা। আমার সঙ্গে সাইকেল চালিয়ে পারেনা বলেই ও এরকম করেছে। কাল আমিও চুপ করে ওর সাইকেলের বারোটা বাজাবো।’

ভীষণ ক্ষোভে ফেটে পড়ে রিজু। বাবা সরল হাসি হেসে বিজ্ঞদের মতো বলেন,

‘না রে বাবা। এরকম কখনো করবিনা। এরকম করা পাপ।’

‘কেন বাবা? ও তো ঠিক-ই আমার সাইকেলটা নষ্ট করেছে। আমি করতে দোষ কোথায়?’

‘কেউ দোষ করলে তার ক্ষতি করে কোনো লাভ হয়না। পাল্টা সেও আবার তোর ক্ষতি করবে। বরং তার ভুলটা শুধরে দিয়ে ভালোবাসার সঙ্গে বরণ করলেই সে তার ভুল বুঝতে পারবে। বুঝলি বাবা?’

‘বুঝলাম।’

‘কাল তুই সজীবের সঙ্গে একদম খারাপ ব্যবহার করিস না। উল্টো ভালো ব্যবহার করবি। দেখবি ও ঠিক লাইনে চলে এসেছে।’

‘আচ্ছা বাবা।’

ভদ্র ছেলের মতো জবাব দেয় রিজু।

পরদিন স্কুলে এসে রিজুর ব্যবহারে সবাই অবাক। সবাই প্রত্যাশা করেছিল রিজু হয়তো এক ঘুসিতে সজীবের নাক ফাটিয়ে দেবে। অথবা সজীবের সাইকেলের বারোটা বাজিয়ে ছাড়বে৷ কিন্তু এরকম কিছুই করলোনা রিজু। সবার সঙ্গে এমন ব্যবহার করতে লাগলো যেনো কিছুই হয়নি। সজীবকে জোরে ডাক দিয়ে কাছে আসতে বলে। সজীব কী করবে বুঝতে না পেরে আমতা আমতা করতে করতে কাছে আসে। রিজু ওর ঘাড়ে হাত দিয়ে বলে,

‘কেমন আছিস দোস্ত?’

সজীব রীতিমতো ভয়ে অস্থির। কাঁচুমাচু করতে করতে বলে,

‘এইতো ভালো।’

‘তুই-ই আমার সাইকেলটার বারোটা বাজিয়েছিলি, না?’

‘ইয়ে আরকি...মানে...’

‘হাহাহাহা। আরে বোকা এতো ভয় পাচ্ছিস কেন? বন্ধু বন্ধুর বারোটা বাজাবে না তো কে বাজাবে? হাহাহাহা।’

রিজুর হাসিতে সজীব কিছুটা ভড়কে গেলেও ধীরে ধীরে বুঝতে পারে ওর নিষ্ঠুর কাজটার জন্য রিজু একদমই ক্ষ্যাপা না ওর ওপর। তাই একটু সহজ হয় সজীব৷ রিজু বলে,

‘আমার বাবা বলেছে, যে আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করবে তার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতে৷ যে ক্ষতি করবে তার উপকার করতে। তাহলেই তার উচিত শিক্ষা হবে। তুই তো আমার ক্ষতি করলি সাইকেলটা নষ্ট করে। কিন্তু আমি তোর ক্ষতি না, বরং উপকার করবো। তোর কালকের হোমওয়ার্কটা আমি করে দেবো। কি বলিস?’

সজীব যেনো নিজের ভুল বুঝতে পারলো। ভীষণ অনুতপ্ত হয় ও। প্রচণ্ড কান্না পায়। নিজেকে সামলাতে না পেরে সবার সামনে বোকার মতো ভ্যাত করে কেঁদে ওঠে রিজুকে বলে,

‘আমারে মাফ করে দিস রে বন্ধু। আমি এরকম আর কখনো করবোনা। কারো ক্ষতি করবোনা। উল্টো কেউ আমার ক্ষতি করলে উপকার করে তার ভুল ভাঙাবো।’

রিজু বড়দের মতো করে বলে,

‘সত্যি?’

‘তিন সত্যি।’

রিজুর বাবা সাইকেলটা ঠিক করে দেওয়ার পর রিজু আর সজীব রোজ একসঙ্গে সাইকেল চালিয়ে স্কুলে যায়। দুটো লাল সাইকেল একসঙ্গে চলে। কেউ আর আগের মতো কাউকে কাটিয়ে আগে যেতে চায়না। রিজুর হিরোগিরিও কমে গেছে অনেকটা। তবে সেদিন ওর সাইকেলটা নষ্ট হওয়ার মধ্য দিয়ে দুজনের বন্ধুত্বের সম্পর্কটা অনেক গাঢ় হয়ে যায়।

কিডস পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com। সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!