ক্ষুদে মুজিবসেনার গল্প

গঞ্জের বামদিকে রাস্তার পাশের ধানক্ষেতের আল ধরে সোজা দুই মাইল পথ হেঁটে এসেছে ওরা। দলে আছে মোট ছয়জন। হপ্তাখানেক হলো ভারত থেকে ট্রেনিং শেষে যুদ্ধে ফেরার।

সাদিক আল আমিনবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 March 2019, 06:31 AM
Updated : 6 March 2019, 06:31 AM

এরই মধ্যে দশ-বারোটা ছোটখাট অপারেশন চালিয়েছে। তবে আজকের অপারেশনটা বড়ই বলা চলে। এমনকি জটিলও। ঢাকা থেকে মুক্তিবাহিনীর বিশেষ গাড়ি ওদের গঞ্জে নামিয়ে দিলো। শেখরপুরের গঞ্জ বলা হয় ওই জায়গাটাকে। প্রায় সন্ধ্যের কাছাকাছি সময়ে এসেছে বলে আর দেরি না করে সরাসরি গ্রামে চলে এলো তারা। মধ্যরাতের অপারেশনের ব্যাপারে তারা যে খুব আত্মবিশ্বাসী তা তাদের দেখেই অনুমান করা যায়। গ্রামের একজন মুরুব্বির সঙ্গে পূর্বপরিচয় ছিলো মুক্তিবাহিনীর দলের একজনের। আজকের রাতটা সেখানে থেকেই অপারেশন চালানোর পরিকল্পনা তাদের।

২.

শেখরপুরের কালাম মুরব্বির বাড়ির সঙ্গে লাগানো বাড়িটা খালেকের। খালেক জমিতে কৃষিকাজ করে। তার ছেলে মনজুরুল সেকেন্ডারি স্কুলে ক্লাস সিক্সে পড়ে। নিয়মিত স্কুলে না গেলেও বাবার জমিবাড়িতে প্রায় সময়ই দুপুরে ভাত নিয়ে যায় মনজুরুল। এখন অবশ্য স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তার খেলাধুলার ফুরসতও হয়েছে অনেকটা! সকাল বিকেল দুইবেলা খেলা এখন তার প্রতিদিনের রুটিনে। রাতে আবার বাবার সঙ্গে নির্জন ঘন অন্ধকার দাওয়ায় বসে রেডিও শুনতেও বিরক্তি নেই তার। বরং ভালোই লাগে। দেশে খুব তাড়াতাড়ি যুদ্ধ লাগতে যাচ্ছে; স্বাধীনতা সংগ্রাম। এসব বুঝতে পারে মনজুরুল ভালোভাবেই। সবার চোখে সে ছোট হলেও আসলে সে যে ছোট নয় তা প্রমাণ করে দিলো সেদিন রাতের ঘটনায়, ছয়জন মিলিটারি যেদিন পাশের বাড়ির মুরুব্বি কালামের বাড়িতে এলো মিলিটারিদের ওপর গোপন একটি অপারেশন চালানোর জন্য।

ছয়জন মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে টিম কমান্ডার ছিলো রইসুল। রইসুলকে অনিচ্ছা নিয়েও যুদ্ধে আসতে হয়েছে। অথচ না এসে কোনো উপায় ছিলোনা তার। বাড়িতে মৃতপ্রায় অসুস্থ মা পড়ে আছে। জায়গা-জমি কিছু নেইও রইসুলদের পেট চালানোর মতো। বাধ্য হয়েই তাই যুদ্ধে আসতে হয়েছে তাকে। কিছু না হলেও পেট পুরে খাবার তো পাবে ক্যাম্পে! আর বেতন হিসেবে যে টাকা পারে তার মধ্য থেকে কিছু টাকা মাকে পাঠালে মাও ভালোমতো খেতে পারবে; এ ভাবনা থেকেই তার যুদ্ধে আসা।

তবে যুদ্ধে আসার পরে নিজ স্বার্থের কথা ভুলে যায় রইসুল। দেশের স্বার্থের জন্য এখন যা কিছু হোক, করতে প্রস্তুত সে। বাড়ির কথা মনে পড়ায় চোখের কোণে জমা হালকা পানি মুছলো রইসুল। রাতের প্ল্যানের ব্যাপারে তার সহকর্মীদের সঙ্গে পরামর্শ করলো। প্রায় পঞ্চাশটার মতো পাক মিলিটারি থাকবে সেই ক্যাম্পে। গঞ্জের পাশেই নদীর ঘাটের ওখানে ক্যাম্পটা। তাদের মধ্যে কয়েকজন থাকবে বাইরে পাহাড়ায়; কয়েকজন বাইরে বিড়ি খাবে, গল্প করবে; বাকিরা ঘুমোবে। তাদের দায়িত্ব খুব সতর্কতার সাথে সবকটা মিলিটারিকে মেরে ফেলা।

বোম দিয়ে পুরো ক্যাম্প উড়িয়ে দেওয়ার কথা থাকলেও তা সম্ভব নয়। কারণ পুরো মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে মূল যে নীল নকশা তৈরি হয়েছে পাকবাহিনীর দ্বারা, তা এই ক্যাম্পেই আছে; গোপন সূত্রে জেনেছে রইসুলরা। যে করেই হোক সেটা উদ্ধার করেই আনতে হবে তাদের! নইলে পুরো দেশ ও জাতি হুমকির মুখে পড়বে। রইসুল সবাইকে প্রস্তুত হতে বললো। ঠিক রাত তিনটায় অপারেশন চালাবে তারা।

কালাম মুরব্বির বাড়ির ভেতরের সব কথা গোপনে এতক্ষণ শুনছিলো মনজুরুল। মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে তার ধারণা আরো পরিষ্কার হলো। মনে একটা উত্তেজনাও বোধ করতে লাগলো সে। সে যদি যুদ্ধ করতে পারে! পাক মিলিটারিদের যদি গুলি করে মেরে ফেলতে পারে তাহলে যেন বিষয়টা খুব স্বস্তির হয়; মনে মনে চিন্তা করতে লাগলো মনজুরুল। কিন্তু যুদ্ধ করবে কিভাবে! তার কাছে তো সেসব শক্তিশালী রাইফেল পিস্তল নেই যুদ্ধ করার মতো! যেগুলো দিয়ে এক গুলিতে মানুষ কেনো একটা হাতিকে পর্যন্ত মেরে ফেলা যায়। নেই তো কি হয়েছে, তীর আর ধনুক তো আছে! বুদ্ধি খেলে যায় মনজুরুলের মাথায়।

গতদিনই ধনুকটা বানিয়েছে সে। দূর গ্রামে যে ঝিল আছে সেখানে অনেক পাখির আনাগোনা। কয়েকটা পাখিকে শিকারের জালে ফেলতেই তার এই ধনুক বানানো। কয়েকটা তীরও মাঠিয়েছে চমৎকারভাবে। যদিও আজ সারাটাদিন ওটা দিয়ে কোনো পাখি মারতে পারেনি সে, তবে মানুষ নিশ্চয়ই মারতে পারবে; বুকে প্রচণ্ড উত্তেজনা অনুভব করে মনজুরুল।

৩.

রাত তখন আড়াইটা। রইসুল তার সহযোদ্ধাদের প্রস্তুত হয়ে নিতে বললো। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই অপারেশন শুরু করা হবে৷ এদেশের শোষকদের চিরতরে মিলিয়ে দিতে হবে; মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে রইসুল। পাঁচজনকে পাঁচটা দিক ভাগ করে দিয়ে সে গুরুদায়িত্বটা নেয়। ক্যাম্পের ঠিক মধ্যভাগটা দিয়ে প্রবেশ করবে সে। ওখানে প্রায় বিশজনের মতো মিলিটারি প্রহরায় থাকবে। সবাই নিজ নিজ দিক সামলে নিয়ে যদি পারে তবে রইসুলের দিকটা কভার করবে যতটা সম্ভব; এমনটা বলা ছিলো রইসুলের। রইসুল ভিতরে গিয়ে অপারেশন চালিয়ে নীল নকশাটা উদ্ধার করে নিয়ে আসবে। ব্যাপারটা খুব একটা সোজা নয়। আল্লাহর নাম নিয়ে অপারেশনে নেমে পরলো রইসুল।

কলাগাছের আড়াল থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের কর্মকাণ্ড দেখছিলো এতক্ষণ মনজুরুল। সেও গিয়ে রইসুল ভাইয়ের সঙ্গে যোগ দেবে কিনা চিন্তা করছিলো। গিয়ে যদি বড় রকমের কোনো বিপদে পড়ে তখন কি হবে! যদি মিলিটারিরা তাকে বেঁধে রেখে দেয়! কিংবা যদি মেরে ফেলে! নিজের জন্য ভয় নেই মনজুরুলের। ভয় বিষয়টাকে এখনও আত্মস্থ করতে পারেনি তার মস্তিষ্ক। শুধু বাবার জন্য মনটা কেমন করতে লাগলো। সে মরে গেলে বাবার জন্য জমিবাড়িতে দুপুরবেলা আর ভাত নিয়ে যাওয়ার কেউ থাকবে না। বাবা হয়তো না খেয়েই বলদ দুটো নিয়ে জমি চাষ করে যাবেন! মা মারা যাবার পর থেকে বাবাকে দেখাশোনা করার আর কেউ নেই মনজুরুল ছাড়া।

হঠাৎ করে ভাবনায় ছেদ পড়ে মনজুরুলের। ভেতর থেকে চেঁচামেচির আওয়াজ আসছে। রইসুল ভাইয়ের সহযোদ্ধাদের আশেপাশে দেখা যাচ্ছে না। রইসুল ভাই সম্ভবত ভেতরে। কোনো একটা সমস্যা নিশ্চয়ই হয়েছে। কোনো রকমের চিন্তাভাবনা না করে মনজুরুল তীর আর ধনুকটা শক্ত করে হাতে ধরে ক্যাম্পের ভেতরে ঢুকে যায়।

৪.

বড় একটা রুমের দরজায় উঁকি দিয়ে মনজুরুল দেখলো রইসুল ভাই আর তার সহযোদ্ধাদের বেঁধে রেখেছে মিলিটারিরা। সহযোদ্ধারা বাইরে কয়েকটা মিলিটারি মারলেও রইসুল ভাই তার কাজটা ভালোমতো করতে পারেনি, ধারণা করলে মনজুরুল। যা করার এখন তাকেই করতে হবে। দেশকে বাঁচানো বলে কথা! দেশের মানুষকে বাঁচানো বলে কথা।

নীল নকশাটা উদ্ধার করতে না পারলে সবাই যে একটা বড় ক্ষতির সম্মুখীন হবে এমনটা সন্ধ্যার দিকে শুনেছিলো মনজুরুল রইসুল ভাইদের আলোচনায়। মনজুরুলের কানে ভাসতে থাকে উদাস দাওয়ায় বসে বাপ-বেটার রেডিওতে শোনা গান, ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি...।’ তবে কানে বাজতে থাকা সে গান এখন আর মনে খোরাক জোগায় না, খোরাক জোগায় রক্তে।

আড়াল থেকে মিলিটারিদের তাক করে একের পর এক তীর ছুঁড়তে থাকে মনজুরুল। যেন বিরাট এক রণক্ষেত্রের সে সেনাপতি! এক সময় সুযোগ বুঝে রইসুল ভাইয়ের হাতের বাঁধনটা খুলে দেয় সে। রইসুল ভাই বাকিদের উদ্ধার করে ফেলে সঙ্গে সঙ্গে। সবাই মিলে বুকের ভেতর জ্বলা গরম আগুনে হানাদারদের পোড়ায়। ওরা চালায় গুলি, মনজুরুল ছুঁড়ে তীর। অবশেষে সব মিলিটারিরা মরে গেলে নীল নকশাটা উদ্ধার করতে সক্ষম হয় তারা। অপারেশন সফল হয় তাদের।

রইসুল ও তার সহযোদ্ধারা ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেনি এতোটুকু একটা ছোট ছেলে তাদের বাঁচাতে পারবে! রক্ষা করতে পারবে এতোগুলো মিলিটারির হাত থেকে। কিভাবেই বা সে তাদের আসার খবর জানলো, আর কিভাবেই বা অপারেশনের ব্যাপারে জানলো এসব জিজ্ঞেস করায় মনজুরুল যে তাদের কথা গোপনে শুনেছিলো এবং গভীর রাতে চুপ করে বাসা থেকে বেরিয়ে তাদের অনুসরণ করতে করতে ক্যাম্পে এসেছিল তা বললো। গোপনে কারো কথা শোনা খারাপ কাজ হলেও এই ছোট বাচ্চাটা সামান্য খারাপ কাজটা না করলে তারা হয়তো আর প্রাণ নিয়ে বেঁচে ফিরতে পারতো না! তার চেয়েও বড় ব্যাপার হলো নীল নকশাটা তারা উদ্ধার করতে পেরেছে। এটা উদ্ধার করতে না পারলে বড় ধরণের একটা ক্ষতি হয়ে যেতো পুরো জাতির। রইসুলরা যে কিভাবে মনজুরুলকে ধন্যবাদ দেবে তার ভাষা খুঁজে পাচ্ছিলোনা।

সেদিনের পর থেকে মনজুরুল আবার আগের মতোই জীবনযাপন করতে লাগলো। তার ওই অপারেশনে যোগ দেওয়ার ব্যাপারে কেউ জানে না। মনজুরুল কাউকে জানাতেও চায়নি। শুধু মনের মধ্যে এক ধরণের প্রশান্তি অনুভব করে। দেশ স্বাধীন হবার রাতে মনজুরুল রেডিওতে বিজয়ের ঘোষণাপাঠ শুনতে পেলো। তখনো গভীর রাত। চাঁদের আলোয় পুরো উঠোন আলোময়। এমন খুশির রাতে বাবা তাকে জড়িয়ে ধরে বললো, ‘দেখেছিস বাবা, মুজিবের সেনারা কিভাবে দেশটাকে স্বাধীন করে নিলো!’ মনজুরুল মনে মনে বললো, ‘তোমার ছেলেও একজন সাহসী বীর মুজিবসেনা বাবা।’

লেখক: শিক্ষার্থী, প্রথম বর্ষ, কৃষি অনুষদ, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

কিডস পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com। সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!