কোস্টারিকার লোকগল্প: পোয়েসের সোনালি কণ্ঠ

স্পেনিশরা তখনো কোস্টারিকা দখল করেনি। কোস্টারিকার পোয়েস আগ্নেয়গিরির চারপাশের বিস্তির্ণ অঞ্চল বিভিন্ন রকমের পাখ-পাখালির জন্য বিখ্যাত ছিল।

জাফর সাদেক চৌধুরীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 Feb 2019, 05:31 AM
Updated : 15 Feb 2019, 05:31 AM

মধ্য আমেরিকার দেশ কোস্টারিকা এখনো পাখ-পাখালির জন্য বিখ্যাত। এর মধ্যেও সেই সময়ে বিশেষভাবে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল একটি সুন্দরী মেয়ে এবং একটি রুয়ালডো পাখির বন্ধুত্ব। সবাই বিশ্বাস করত এই সুন্দরী মেয়ে এবং রুয়াল্ডো পাখির বন্ধুত্ব তাদের রূপের থেকেও সুন্দর।

সুন্দরী মেয়েটির নাম ছিল জেনিফার আর রুয়ালডো পাখিটির নাম ছিল জন। অবশ্য জন পাখিটির পৈত্রিক নাম ছিল না। জেনিফারই পাখিটির নাম দিয়েছিল জন। তখন থেকে পাখিটিকে সবাই জন নামে ডাকে এবং চিনে। কিন্তু জন এবং জেনিফারের এ অবিচ্ছেদ্য বন্ধুত্ব হঠাৎ করে হয়নি। একদিন একজন নিষ্ঠুর শীকারির পাতা ফাঁদ থেকে জেনিফার জনকে রক্ষা করেছিল অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে। সেই থেকে উজ্জ্বল বর্ণের রুয়াল্ডো পাখি জন চরম কৃতজ্ঞতার বন্ধনে জেনিফারের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে নিল।

জন ছিল জেনিফারের ছায়া সঙ্গীর মতো। জেনিফার যেদিকেই যেত সেদিকটা মিষ্টি কণ্ঠের জনের সুরে মুখরিত হতো। এমন সুমিষ্ট স্নিগ্ধ সুর চারপাশের পরিবেশকে এক ধরনের সজীবতা দান করত। অনেকেই তাদের দেখে অবাক হয়ে প্রশ্ন করত, কে বেশি সুন্দর! জেনিফার, জনের গান না তার সুন্দর লেজ। অনেকেই সবকিছু একযোগেই উপভোগ করত। এমনকি গ্রামের বুড়ো শামান-ওঝা যে কিনা সব কিছুতেই ভ্রু কুঁচকাতো, সেও হাসত জেনিফার আর জনকে দেখে।

কিন্তু জন-জেনিফারের বন্ধুত্বের মতো পোয়েসের চারপাশ এতটা নির্মল এবং নিরাপদ ছিল না। ভূগর্ভের অনেক নিচে পোয়েসের ভেতরে সব সময় চলত এক ধরনের উন্মাদনা, কম্পন। মূলত পোয়েস ছিল একটি সুপ্ত আগ্নেয়গিরি। এ আগ্নেয়গিরি যখন জেগে উঠে সে তখন প্রচণ্ড দানবীয় রূপ ধারণ করত। তার জ্বালামুখ দিয়ে কালো ধোঁয়া বের করে তীব্র বেগে, পেটের ভেতর থেকে উত্তপ্ত লাভা বেরিয়ে এসে ধ্বংস করে দিত নীরব পাহাড়ি জনপদ।

বৃদ্ধ শামানের যখন বালক বয়স ছিল সে তখন দেখেছে পোয়েসের প্রলয়ঙ্করী রূপ। একদিন হঠাৎ পোয়েস সংলগ্ন গ্রামগুলো কেঁপে উঠল, পোয়েস গর্জন করতে লাগল আর বের হতে লাগলো কালো ধোঁয়া। যেকোন সময় বুঝি পেট থেকে বের করে দেবে উত্তপ্ত লাভা। বৃদ্ধ শামান খুব চিন্তিত, যে কি না শুভ-অশুভ সব শক্তিকেই বশে আনতে পারে। তাকে একটি কিছু করতে হবে। আগ্নেয়গিরির এ রাগকে প্রশমিত করতে হবে।

বৃদ্ধ শামান সবার অলক্ষ্যে আস্তে আস্তে পোয়েসের জ্বালামুখের নিকটে উপস্থিত হল। তাৎক্ষণিক পোয়েসের ভেতর থেকে জোরে ধোঁয়ার কুণ্ডলী বেরিয়ে শামানকে জোরে ধাক্কা দিল। বৃদ্ধ শামান চিৎকার করে উঠল। শামান কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল, কেন তুমি এতো রেগে যাচ্ছ পোয়েস, আমার গ্রামকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে আমি তোমার জন্য কি করতে পারি।

আরও একটা বড় কুণ্ডলী মুহূর্তেই বেরিয়ে গেল জ্বালামুখ দিয়ে, ফোস ফোস শব্দ আসতে লাগল পোয়েসের ভেতর থেকে, পোয়েসের ভেতর থেকে একটি কণ্ঠ জানাল, এ কণ্ঠ কোনও সাধারণ কণ্ঠ নয়। এটা ছিল পোয়েসের অন্তরাত্মার কণ্ঠ।

- একমাত্র একটি জীবন আমাকে ঠাণ্ডা করতে পরে, তোমাদেরকে বলি দিতে হবে।

 হ্যাঁ মহাশক্তিধর, আমি এক্ষণি গ্রাম থেকে কিছু পশু নিয়ে আসছি আপনার জন্য।

- আমি সে রকম বলি চাই না, আমি চাই জনের বন্ধু জেনিফারকে, তাকে নিয়ে এসো আমার কাছে, তবেই আমি তোমাদের রক্ষা করব। আমি শীতল হয়ে যাব।     

মুহূর্তেই আরেকটি বিস্ফোরণ হল পোয়েসের ভেতর, কেঁপে উঠল সমগ্র জনপদ। আগুনের লেলিহান শিখা সাপের ফনার মতো উপরের দিকে ঊঠতে লাগল। এক ভয়াণক রূপ পরিগ্রহ করল পোয়েস। যেকোনো সময় বুঝি ধ্বংস করে দেবে পুরো ভূখণ্ড, পাহাড়, নদী, পাখ-পাখালি সব। পোয়েসের এ রূপ দেখে বৃদ্ধ শামান আর কথা বাড়ানোর সাহস পেল না। এ দুঃসংবাদ বয়ে সে গ্রামে ফিরে আসল।

এ দুঃসংবাদ শুনে সুন্দরি জেনিফার সাহসী হতে চাইল, সে চুপচাপ কোনো কথা না বাড়িয়ে শামানকে অনুসরণ করতে লাগল। এক সময় তারা আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখের কাছাকাছি চলে আসল। কিন্তু সে যখনই দেখল আগুনের লেলিহান শিখা এবং উত্তপ্ত লাভার বুদবুদ মুহূর্তেই তার সমস্ত সাহস উবে গেল মোমের মতো, তার গলা শুকিয়ে গেল ভয়ে। সে প্রাণপনে পাহাড় থেকে নেমে আসার চেষ্টা করল, কিন্তু বৃদ্ধ শামান তাকে এতো শক্ত করে ধরেছে যে তার নড়ার শক্তিই রইল না।

এসব ঘটনা যখন ঘটছিল রুয়াল্ডো পাখি জন কখনোই তার বন্ধুর পাশ থেকে নড়ল না। পোয়েসের উত্তপ্ত অন্তরের অন্তস্থলে সে উড়ে গেল। আগুনের লেলিহান শিখা উত্তপ্ত লাভার উত্তাপ, কালো ধোঁয়া কোন কিছুই তাকে থামাতে পারল না। সে পোয়েসের শক্তির কাছে চিৎকার করে বলল তুমি আমার বন্ধু জেনিফারকে নিওনা, বরং তুমি আমার পক্ষ থেকে একটি উপহার গ্রহণ কর।

মুহূর্তেই পায়োসের রাগ কিছুক্ষণের জন্য শীতল হয়ে গেল। সে চিৎকার করে জনকে জিজ্ঞেস করল,

- তুমি আমাকে আসলে কি উপহার দিতে চাচ্ছ যার বদলে আমি তোমার বন্ধুকে ছেড়ে দেব?

- আমি তোমাকে আমার কণ্ঠ উপহার দেব, যারা এটা শুনেছে সবাই বলেছে আমার কণ্ঠ হচ্ছে স্বর্ণালী কণ্ঠ এবং সুমিষ্ঠ। পৃথিবীর অন্য কোন পাখির সঙ্গে এর তুলনা করা যাবে না।

তখন জন পোয়েসের উদ্দেশ্যে তার গান নিবেদন করল। সে গানে গানে তার বন্ধু কিভাবে তাকে মৃত্যুর হাত তেকে বাঁচিয়েছিল সে গল্প বলল। রুয়ালডো জনের কণ্ঠ ছিল আসলেই একটি ঐন্দ্রজালিক কণ্ঠ। অনেকেই বলে এটা এমনই যাদুকরি কণ্ঠ যা একটি জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরির বুক থেকে চোখের পানি নামিয়ে দিয়েছিল।

সেই পানি উত্তপ্ত লাভাকে ঠাণ্ডা করে দেয়, আগুনের লেলিহান শিখাকে নিভিয়ে দেয়। পায়োসের কান্নার জল অবশেষে নিচের দিকে নামতে থাকে এবং সে জল ধারা পাহাড়ের নিচে অসংখ্য জলাধার সৃষ্টি করে। যা আজো পায়োসের চারপাশে দেখা যায়। যখনই পায়োসের রাগ কমল জল প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেল এবং পায়োস জনের উপর গ্রহণ করল। মুহূর্তেই জনের কণ্ঠ চিরদিনের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল। জন তার যাদুকরি কণ্ঠ চিরদিনের জন্য হারিয়ে ফেলল। 

সবাই ভাবল ছোট পাখিটা অনেক বিশাল মূল্য দিল, কিন্তু জন মোটেই সে রকম ভাবল না। তারপর থেকে সারা জীবন সুন্দরী জেনিফার এবং যাদুকরি কণ্ঠের জন এক সঙ্গে থাকল। তখন থেকে সবাই শুনত সুন্দরী জেনিফার তার স্তব্দ বন্ধু জনকে উদ্দেশ্য সারাক্ষণ গান গাইছে।

গল্পটি কোস্টারিকান লোকগল্প দ্যা ’গোল্ডেন ভয়েস অব পোয়েস’ অবলম্বনে রচিত।

কিডস পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com। সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!