কুঁড়ের বাদশা

আমার ছোটবেলার ঘনিষ্ট বন্ধু নবুর ছোট মামা ছিলো- সত্যজিৎ মামা। আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় ও প্রিয় সত্যজিত মামা ছিলেন আলস্যের শেষ অবতার, কিন্তু স্বপ্ন দেখতেন উসাইন বোল্টর মতো দ্রুত গতির ও প্রকাণ্ড।

জাফর সাদেক চৌধুরীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 Jan 2019, 10:39 AM
Updated : 12 Jan 2019, 10:39 AM

এতোটাই দ্রুততম ও প্রকাণ্ড স্বপ্ন দেখতেন যে অনেক সময় ভুলে যেতেন তার স্বপ্নের কাছাকাছি উঁচু ও ভারি একটা বপু তার পেটের সঙ্গে জুড়ে দিয়েছিলেন বিধাতাপুরুষ। অবশ্য বিধাতা জুড়ে দিয়েছিলেন বললে বিধাতার প্রতি খানিকটা অবিচার করা হয়। বিধাতা হয়তো সামান্যই একটা ভুঁড়ি দিয়েছিলেন, কিন্তু তিনি তার এতোটাই যত্ন-আত্তি করেছিলেন যে এখন আর শুলে পা দেখার সাধ্য নেই।

তিনি কী পরিমাণ খাওয়া-দাওয়া করেন এ বিষয়ে আলোচনা অবান্তর। কারণ তিনি যতই খাওয়া দাওয়া করেতন না কেনো আমার বন্ধু নবুর মা অর্থাৎ তার দিদি বলতেন, কম খেয়ে খেয়ে আমরা ভাইটি একদম শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে। নবুর বাবাও ঠাট্টা করে বলতো- আরে কাঠ না একেবোরে কটন-বাড হয়ে যাচ্ছে।

বাড়িয়ে বলছি না, সত্যজিত মামা রাস্তায় বের হলে গরু-মহিষের পালও পথ ছেড়ে দিতো। শেষবার ওজন মাপতে গিয়ে একটি অয়েয়িং-স্কেল ভেঙে ফেলেছিলেন মামা। মেশিনটি যদিও জীবনে অনেক লোকের ভার বইতে বইতে কিছুটা ক্লান্ত ছিলো, কিন্তু তাই বলে সত্যজিৎ মামার ভার সইতে গিয়ে একেবারেই অক্কা পাবে তা আমাদের ধারণার বাইরে ছিলো। তারপর থেকে লজ্জায় আর কখনো ওজন মাপার কথা মুখে নেননি। আমরাও মেশিন ভেঙে যাবার ভয়ে এ নিয়ে আগ্রহটা সব সময় চেপে রাখতাম।

একবার মামা আমাকে ডেকে ভুঁড়ির ওপর হাত বোলাতে বোলাতে খুব আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বললেন- বুঝলি পরশ, এভাবে বসে থাকলেতো ইতিহাসে নাম লেখাতে পারবো না, ভাবছি এবার হিমালয় অভিযানে যাবো! সারা জীবনতো তেনজিং-হিলারির নামই পড়লাম, বাংলাদেশের মুখটাও যে উজ্জ্বল করতে হবে! মামার এ ভয়ানক আত্মবিশ্বাস দেখে আমি মামাকে একটু দমানোর চেষ্টা করি, কিন্তু মামা কিছুতেই দমবার পাত্র নয়। মামাকে বলি,   

        - হা মামা অবশ্যই, তাহলে তুমিই হবে দুনিয়ার সবচেয়ে স্থূলকায় হিমালয় বিজেতা। কিন্তু একটা সমস্যা আছে, কোনো শেরপা তোমার বুড়ো আঙুলের ভরও বইতে পারবে না।

        - আরে বাছা হিমালয় অভিযানে শেরপা লাগবে কেনো, আমি একাই যাবরে দেখে নিস।

        - মামা, ঢাকার কাছেই ময়মনসিংহ জেলা, সেখানে গারো পাহাড়ে ছোট ছোট টিলা রয়েছে। তুমি বরং সেখানে যাও, একটু প্র্যাকটিসও হবে আর অভিজ্ঞতাও। হিমালয় অভিযানতো আর একদিনের ব্যাপার নয়। 

        - তু্ই কি আমাকে নিয়ে ইয়ার্কি করছিস, জানিস ‍আমি এক ‍সময় অ্যাথলেট ছিলাম! ডিস্ট্রিক্ট চ্যাম্পিয়ন ছিলাম।  

        - তুমি এখনো অ্যাথলেট হতে পারো। কিন্তু তার জন্য তোমাকে জাপান যেতে হবে।

        - কেনো? জাপান কেনো?

        - তোমার শরীরটা নিখুঁত সুমো কুস্তিগীরের মতো, এরকম শরীরের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে শুধু জাপানেই। কিছুদিন কোচিং নিলে তুমি নিশ্চিত চ্যাম্পিয়ন হবে।

সত্যজিত মামা অত্যন্ত গম্ভীরভাবে বললেন, পরশ! শেষ পর্যন্ত তুইও আমার শরীর নিয়ে কথা বললি! আসলে এদেশে কেউ কখনো ভালো কাজে উৎসাহ দেয় নারে। দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে গেলো সত্যজিত মামার নাক দিয়ে। আসলে আমি তার স্থূলকায় শরীর নিয়ে ঠাট্টা করতে চাইনি, তার হিমালয় অভিযানের স্বপ্ন দেখে আমি নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলাম না।সত্যজিৎ মামাকে নিয়ে ঠাট্টা করা খুব নিরাপদ। তিনি যে দৌড়ে গিয়ে ধরে কয়েক ঘা দেবেন তারও উপায় নেই। তার এ শরীর নিয়ে তিনি আর দিদি ছাড়া আমরা সবাই খুব চিন্তিত। এভাবে ফুলতে থাকলে সত্যজিত মামা কবে না ফেটে যায়। মোটা মানুষ আরও মোটা হতে হতে ফেটে গেছে এমন গল্প আগে কখনো শুনিনি। কিন্তু তাকে দেখলে মনে হয় ফেটে যাওয়া অবান্তর কিছু নয়। এভাবে ঘরে খেয়ে বসে শুধু দিবা-স্বপ্ন দেখলে কারনা ভুঁড়ি বাড়বে! তাকে দেখলেই ব্যাঙের ফেটে যাওয়ার গল্পটা চোখে ভাসতো।

শেষবার সত্যজিত মামার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল পথে। তিনি তার বিশাল ভুঁড়ি নিয়ে তুবড়ি বাজাতে বাজাতে রিকশা খুঁজছিলেন হন্তদন্ত হয়ে। হাতে একটি ফাইল। ভুঁড়িটা যেনো ইন করা প্যান্টের বোতাম গলে বেরিয়ে যাবে। কোনো রিকশাই মামাকে নিচ্ছে না। কয়েকজন রিকশাওয়ালা মামাকে নিলোইতো না, বরং অপমান করে ট্রাক খোঁজার পরামর্শ দিলো।

আমি কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, মামা কী সমস্যা? মামা জানালো আজ একটা ইন্টারভিউ আছেরে বিকাল পাঁচটায়। দেখ না সাড়ে চারটা বেজে গেলো, একটা রিকশাও পাচ্ছি না। সত্যজিত মামার মতো কুঁড়ের বাদশা চাকরি খুঁজতে যাচ্ছে এটা আমি মেনেই নিতে পারছি না। উনাকে দেখেই মনে হচ্ছে বৃহস্পতি গ্রহ থেকে সাবু এইমাত্র পৃথিবীতে এসে চাচা চৌধুরীকে খোঁজ করছে, অথচ উনি নাকি চাকরির খোঁজ করছে! মামাকে জিজ্ঞেস করলাম- 

        - মামা কোথায় ইন্টারভিউ?

        - একটি বিদেশি কোম্পানিতে, ম্যানেজার পদে।

        - মামা ওরা কি ভুঁড়ি বাড়ানোর ওষুধ বিক্রি করে?

        - না ওটা একটা পেট্রোলিয়াম কোম্পানি।

        - মামা তোমার চাকরি হবে না, কখনো কোনো পেট্রোলিয়াম কোম্পানির ম্যানেজারের এতো বড় ভুঁড়ি দেখছো, তাও আবার বিদেশি কোম্পানি! তোমার জন্য দারোয়ানের চাকরিটা ফিট ছিল, গোঁফওয়ালা দারোয়ান। স্যালুট দিতে দিতে ভুঁড়ি কমে যেতো। ভুঁড়ি কমলে তুমি একদম সিইও পদের জন্য ফিট হতে।

মামা প্রচণ্ড অপমানিত বোধ করছিলেন। রাগে ফোঁস ফোঁস করছিলেন ফনা তোলা সাপের মতো। নেহায়েত আমি তার প্রিয় ভাগ্নে নবুর বন্ধু, নইলে কানটা টেনে ছিড়ে দিতো। যাক, মামার মুখের অবস্থা দেখে আমি দ্রুত সেই স্থান থেকে প্রস্থান করেছিলাম। শেষ পর্যন্ত মামা ইন্টারভিউ দিতে পেরেছিলেন কিনা তার গল্প আর শোনা হয়নি। নবুর সঙ্গেও দেখা হয়না অনেকদিন।

কিডস পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com। সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!