ঠাকুর্দার ভূত দর্শন

আমাদের গ্রামে সর্বশেষ ভূত দেখা গিয়েছিল নারায়ণের ঠাকুর্দার শ্রাদ্ধের দিন থেকে প্রায় বছরখানেক। আর তখনই ভূতদের নিয়ে যুগের পর যুগ চলমান মিথ্যাচারের অবসান হয়েছিল। বিভিন্ন গল্প, উপন্যাস কিংবা ইতিহাসে ভূতদের নিয়ে যেসকল তথ্য-উপাত্ত হাজির করা হয়েছিল তা একটি বৃহৎ ষড়যন্ত্রের অংশ বলে প্রতীয়মান হয়েছে।

জাফর সাদেক চৌধুরীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 Sept 2018, 08:55 AM
Updated : 18 Sept 2018, 08:57 AM

এমন একটা নিরীহ প্রাণীকে মানুষ কি ভয়ঙ্করভাবেই না রূপায়িত করেছে। মানুষ তার নিশৃংসতা ভূতের উপর দিয়ে চালিয়ে দিয়েছে যুগের পর যুগ। নারায়ণের দাদা মারা না গেলে এ মিথ্যাচার হয়তো আরও কয়েক শতাব্দী চলত। এ কথার সত্যতা খুঁজতে আমাদের একটু পেছনে যেতে হবে।

নারায়ণের ঠাকুর্দার বয়স হয়েছিল প্রায় সোয়াশত বছর। অস্তি, চর্ম ছাড়া শরীরে আর কিছু ছিল না। দেখেই মনে হতো কোন মিশরিয় মমি নারায়ণদের বসার ঘরের ছোট খাটে গুটিশুটি মেরে শুয়ে আছে। ইতিহাসে বর্ণিত ভূতের যে বাহ্যিক রূপ পাওয়া যায় নারায়ণের দাদা তা জীবদ্দশায়ই লাভ করেছিলেন।

ছোটবেলা থেকেই আমরা ভূতের ভয়ের পরিবর্তে নারায়ণের ঠাকুর্দার ভয় পেয়ে বড় হয়েছি। জীবন্ত মমি যখন হাঁটা শুরু করে তখন ভূতের ভয় বলে কিছু থাকে না, তার ভয়েই আমরা পালাতাম। এমন ভয়ঙ্কর চেহারাতে সম্ভবত যমেরও অরুচি ছিল, তাই শত বছর পেরোনের পর আরও সিকি শতাব্দী চলে গেলেও নারায়ণের ঠাকুর্দাকে যম নাগাল পাচ্ছিল না।

কিন্তু একদিন হঠাৎ করে ঠাকুর্দার ঘুমের ভেতর যমরাজ তার কর্ম সম্পাদন করে আমাদের দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা পূরণ করেছিল। এ কাজটি করার জন্য আমরা বেশ কয়েকদিন ভগবান ভুলে যমরাজের উপাসনা করেছি। তবে আমরা নিশ্চিন্ত ছিলাম যে ঘুমের ভেতর এ কাজ না করলে যমরাজের বাপেরও এমন কাজ করার সাধ্য ছিল না। তবু আমাদের হিরো যমরাজই এ কাজটা করেছিল বিধায় আমিসহ আমার সব বন্ধু-বান্ধব তার প্রতি কৃতজ্ঞই থাকলাম।  

সেদিনের ঘটনাটি আমাদের কাছে ছিল নেহায়াৎ অনাকাঙ্খিত। আমরা ছেলে-ছোকরারা ভেবেছিলাম তার মৃত্যুতে মনে হয় সবাই আনন্দোৎসব করবে, কিন্তু আমাদের গ্রামজুড়ে যে শোকযাত্রা শুরু হলো তা দেখে অবাকই হচ্ছিলাম। এই মমিটাকে আরো কিছুদিন বাঁচিয়ে রাখলেই বোধ হয় গ্রামের অনেক সমৃদ্ধি ঘটত। আমরা কি আর তখন জানতাম আমাদের গ্রামের স্কুল, কলেজ, মন্দির, শ্মশানঘাট সবই তার গাটের পয়সা থেকে করা হয়েছিল! বরং নারায়ণকে ভ্যা ভ্যা করে কাঁদতে দেখে ন্যাকামোই মনে হচ্ছিল। এই মমি ঘরে রাখার জন্য কেউ কাঁদে! কোথায় মমি থাকবে পিরামিডে না তা না করে তারা রেখেছে বসার ঘরে। তাদের রুচি নিয়েই আমাদের সন্দেহ হচ্ছিল।

সেদিন আকাশটা কিঞ্চিৎ মেঘলা ছিল। রাতের বেলায় নারায়ণদের বাড়িতে রামায়ণ পাঠ হবে সঙ্গে ভুরিভোজও হবে তাই আমরা সদলবলে নারায়ণদের সদ্য মমিমুক্ত বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। আমাদের কেউ নেমন্তন্ন না করলেও গ্রামের কারো বাড়িতে খানাপিনার খবর শুনলে আমরা নিজ দায়িত্বেই চলে যেতাম। সেদিনও তাই যাচ্ছিলাম, কিন্তু শ্মশানের যে দিকটাতে নারায়ণের ঠাকুর্দার দাহ হয়েছিল সেদিক থেকে এক মাঝবয়সী বনেদি চেহারার মানুষ আমাদের ডাক দিল।

পরিষ্কার শুনতে পেলাম ভদ্রলোক বিলু, ফটিক, বলাই বলে ডাকছিল। আমাদের তিনজনের নাম তিনি কীভাবে জানলেন তা নিয়ে মাথা ঘামানোর আগেই ভদ্রলোকের দিকে হাঁটা শুরু করলাম। তার গায়ে মিষ্টি সুগন্ধ চারপাশকে কেমন সজীব করে তুলেছে। সামনে গিয়েই তার পরিচয় জানতে চাইলাম।

তিনি জানালেন তার নাম পরাণ বন্দোপাধ্যায়, তিনি নাকি নারায়ণের ঠাকুর্দা। এ কথা বলেই কাঁধের ঝোলা থেকে বাতাসা আর লেবেনচুষ বের করে খেতে দিলেন। এরকম অপরিচিত লোকের এমন অমায়িক ব্যবহার দেখে সত্যি আমরা অবাক হয়েছিলাম। লেবেনচুষ মুখে দেব কি দেব না তা নিয়ে একটু দ্বিধায়ই ছিলাম।

কিন্তু তার অমায়িক ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে অনিচ্ছাসত্ত্বেও লেবেনচুষ মুখে দেয়ার পর বুঝলাম এ লেবেনচুষ ভূত ছাড়া মানুষের কারখানায় তৈরি সম্ভব নয়। কি তার গন্ধ কি তার স্বাদ! নিজ থেকেই তিনি বললেন, এখন আর আমি মানুষ নই। গতকাল থেকে ভূত হয়ে গেছি। মরার পর বেশ কয়েকদিন মানুষই ছিলাম, পরিপূর্ণ ভূত হতে কিছুটা সময় লেগেছে।

স্থির চোখে তিনি আমাদের দিকে তাকিয়ে আছেন। ভয়ে মুখ দিয়ে রাম রাম করছি। তিনি আমাদের এ দশা দেখে মাথায় হাত রাখলেন। বললেন ভূতরা খুবই নিরীহ প্রাণী, তারা কখনো কাউকে ভয় দেখায় না, মিথ্যা কথা বলে না। কারণ এগুলো করলেই তারা আবার মানুষ হয়ে যাবে। ভূত থেকে মানুষ হওয়াকে তারা খুবই অসম্মাজনক মনে করে। আহা এমন নিপাট একজন ভদ্রলোককে আমরা তার জীবদ্দশাই ন্যায্য সম্মান দিই নাই বলে খুব অনুতাপ হচ্ছিল। ভূত হয়ে তার ভদ্রতা এবং সুশীলতা যেন পরিপূর্ণতা পেয়েছে। ইচ্ছে হচ্ছিল তখনই মরে ভূত হয়ে যাই।

তিনি আরও বললেন, ভূতদের আত্ম-সম্মানবোধ অনেক প্রবল, তাই তারা কাউকে ভয় দেখানোর মতো এমন হীন কাজ কখনো করে না। পারলে মানুষের উপকার করে, না পারলে ক্ষতি করে না। ভয় দেখানোর মতো এমন ছেলে মানুষী কোনো বাচ্চা ভূতও করে না। ঠাকুর্দা বললেন, তিনি মাত্র কালকে ভূত হয়েছেন, সে হিসেবে ভূত সমাজে তিনি এক নবজাত শিশু।

মানুষ মরলেই ভূত হয় না, ভূত হওয়ার কিছু আলাদা যোগ্যতাও লাগে। শিশু ভূতদের অনেক কঠিন সাধনা করতে হয়। দুইশ বছর যাবত তাদেরকে শেখানো হয় কীভাবে মানুষকে ভয় না দেখিয়েও লোকালয়ে থাকা যায়। ভূত বলে যাদের চালানো হয় তারা আসলে মানুষ, ভূতের ছদ্মবেশ ধরে। কখনোতো কোনো ভূতকে মানুষ মানুষ খেলতে দেখিনি।

ভূতরা ভূতই, তারা এসব পছন্দ করে না। একারণে ভূতদের বলা হয় এ মহাবিশ্বের সেরা জীব। কিন্তু মানুষ তাও নকল করে ফেলেছে। ভূতদের নকল করা মানুষের প্রিয় স্বভাব। ঠাকুর্দা আরো জানালেন ভূতদের নকল করা তার প্রিয় স্বভাব ছিল জীবদ্দশায়। চিন্তা করে দেখলাম আমরাওতো ভূত ভূত খেলি। কখনোতো কোনো ভূতকে মানুষ মানুষ খেলতে দেখি নি। এই ছিল নারায়ণের ঠাকুর্দার সঙ্গে আমাদের শেষ সাক্ষাৎ এবং জীবীত কিংবা মৃত কোন ভূতের সঙ্গেও আমাদের শেষ সাক্ষাৎ।

কিডস পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com। সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!