ছোট্ট রাজপুত্র

লোকালয় থেকে হাজার মাইল দূরে দুর্ঘটনায় পড়েছে একটি বিমান, বাধ্য হয়ে অবতরণ করে সাহারা মরুভূমিতে। এতে বিমানটি মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হলো। ইঞ্জিন ঠিক করতে করতে বৈমানিক খেয়াল করলেন তার কাছে শুধু অল্প কিছু খাবার আর পানি আছে। এমন সময় ছোট্ট এক ছেলে এসে বললো, ‘একটা ভেড়া এঁকে দেবে?’

মাজহার সরকারমাজহার সরকার
Published : 20 August 2018, 08:47 AM
Updated : 21 August 2018, 05:54 AM

বৈমানিক অনেক চেষ্টা করলেন ভেড়া আঁকতে, হলো না। শেষ পর্যন্ত আঁকলেন একটা বাক্স। আর তা-ই রাজপুত্রকে দিয়ে বললেন- ‘বাক্সের ভেতর ভেড়া আছে’। অদ্ভুত এ ছবি পেয়ে রাজপুত্র উচ্ছ্বসিত হলো, হয়ে গেলো তাদের বন্ধুত্ব। আর তা থেকেই জানা যায় ছোট্ট রাজপুত্রের পৃথিবীতে আগমনের কাহিনী।

‘উপগ্রহ ৩২৫’ নামে ছোট্ট একটি ঘর আকৃতির গ্রহাণু থেকে পৃথিবীতে পতিত হয়েছে ছোট্ট রাজপুত্র। অবশ্য পৃথিবীর মানুষ দূরের এই গ্রহাণুকে ‘উপগ্রহ খ-৬১২’ নামেই চেনে। সে গ্রহাণুতে আছে তিনটা আগ্নেয়গিরি। দুইটা হলো জীবন্ত, তাদের জ্বালামুখ দিয়ে দিনরাত আগুন বের হয়। রাজপুত্র সে আগুনে তার সকালের নাস্তা গরম করে নিতো। আরেকটা ছিলো মৃত আগ্নেয়গিরি, রাজপুত্র এর ভেতর তার পা ডুবিয়ে রাখতো। সে গ্রহাণুতে ছিলো সুন্দর এক বাগান, রাজপুত্র সবচেয়ে ভালোবাসতো তাকে।

বাগানের একমাত্র প্রিয় গোলাপের সঙ্গে অভিমান করে রাজপুত্র, নিজ গ্রহ ছেড়ে যায়। তারপর আরও আরও গ্রহ-উপগ্রহ-নক্ষত্র পেরিয়ে চলে আসে পৃথিবীতে। আসার পথে দেখা হয় বহু রকম মানুষের সঙ্গে। সে গল্পই বৈমানিককে জানায় রাজপুত্র। এক বণিকের সঙ্গে দেখা হলো যার অভ্যাস হলো আকাশের তারা গোনা। সেই নাকি ওই তারাগুলোর মালিক, নষ্ট করবার মতো সময় তার হাতে নেই। ছোট্ট রাজপুত্রকে বণিক বলে, ‘যদি তুমি কোনো হীরার টুকরো পাও, এর মালিক অন্য কেউ নয়; এটি হয়ে যাবে কেবল তোমার। যদি তুমি কোনো দ্বীপ আবিষ্কার করো, এর মালিক কেউ নয়; এটা হয়ে যাবে শুধু তোমার। যদি তুমি কোনো আইডিয়া পাও যা আগে কেউ ভেবে দেখেনি, তুমি এটা প্যাটেন্ট করে নেবে এবং তা হয়ে যাবে চিরদিনের জন্য তোমার সম্পদ। তাই আমার ক্ষেত্রে এই তারাগুলোও আমার। কারণ আমার আগে তারাগুলোকে নিজের করে নেওয়ার কথা চিন্তা কেউ করেনি।’

তারপর রাজপুত্রের দেখা হলো এক রাজার সঙ্গে। সে ছিলো খুব অহংকারী, তার নির্দেশ পালন না করলে ভীষণ রাগ করে। রাজপুত্রকে রাজা বলেন- ‘কর্তৃত্বের ভিত্তি হলো যুক্তি। আমি যদি দেশবাসীকে বলি, ‘যাও, সমুদ্রে ঝাঁপ দাও’, তাহলে তো তারা বিদ্রোহ করবেই। আনুগত্য দাবি করার অধিকার তখনই থাকে যখন আদেশ ন্যায়সঙ্গত। অন্যের বিচার অপেক্ষা নিজের বিচার দুঃসাধ্য। তুমি যদি নিজের বিচার করতে পারো তবেই তুমি প্রকৃত জ্ঞানী।’ পাওয়া গেলো এক ভূগোলবিদকে, ক্ষণস্থায়ী কোনোকিছুর গুরুত্ব নেই তার কাছে। সে বলেছিলো, ‘ফুল চিরদিন থাকে না।’ ভূগোলবিদের পরামর্শেই পৃথিবীতে আসে রাজপুত্র। কিন্তু সে পতিত হয় সাহারা মরুভূমিতে। এসে দেখে এখানে কোনো মানুষ নেই, চারদিকে শুধু বালি আর বালি।

দেখা হয় এক মাতালের সঙ্গে, মদপানের লজ্জা ভুলতে সে আরও বেশি করে মদ গিলছে। পাওয়া গেলো এক বাতিওলাকে, তার বিশ্রাম নেওয়ারও সময় নেই। সে তার গ্রহে রাতের বেলা বাতি জ্বালায় আর সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে বাতি নিভিয়ে ফেলে। পাওয়া গেলো এক স্বার্থপরকে যে সারাদিন নিজের প্রশংসা শুনতে চায়। আরও দেখা হলো এক ফেরিওয়ালার সঙ্গে, যে বেচে তৃষ্ণামেটানো বড়ি। দেখা হলো ঘরবাড়িহীন লোকেদের সঙ্গে যারা খালি ছুটে চলে, যারা বিরামহীন যায় আর আসে।

দেখা হলো এক সাপের সঙ্গে যে হেঁয়ালিভরা কথা জানে। সাপ বলে, ‘লোকেরা বাড়িতেও প্রত্যেকে একা।’ সাপ জানায় তার তীব্র বিষ রাজপুত্রকে আবার পৌঁছে দিতে পারে তার নিজের গ্রহে, কিংবা স্বর্গে তার গোলাপের কাছে। রাজপুত্রের দেখা হয়েছিল এক বুড়ো লেখকের সঙ্গেও। এরা সবাই বড্ড হিসেবি, হৃদয়ের চেয়ে সংখ্যাই তাদের কাছে বেশি মূল্যবান। যদি বলো, ‘আমার একটা বন্ধু আছে’, বড়রা কখনও জানতে চাইবে না- তোমার বন্ধু কি খেলতে ভালোবাসে? সে কি প্রজাপতির পাখা জমাতে পছন্দ করে? বরং জিজ্ঞেস করবে- তার বয়স কতো? ওজন কতো? কয় ভাই-বোন? তাদের যদি বলা হয় ‘আমার একটা বাড়ি আছে যার সামনে ফুলবাগান’, ওরা কিছু বলবে না। যদি বলা হয় ‘আমার একটা বাড়ি আছে যার মূল্য পাঁচ কোটি টাকা’, ওরা বলবে, ‘আহা! কি সুন্দর বাড়ি!’
তারপর পৃথিবীতে এসে রাজপুত্রের দেখা হলো এই বৈমানিকের সঙ্গে। ছোটবেলায় বই পড়ে পেটমোটা এক বোয়া কন্সটিক্টর অজগরের ছবি এঁকেছিলো সে, অজগর গিলে ফেলেছিলো আস্ত এক হাতি। কিন্তু বড়রা সেই ছবি বুঝতে পারেনি, সবাই বলেছিলো এটা একটা টুপির ছবি। তাই বুঝানোর জন্য ভেতরের হাতিটাও এঁকে দিতে হয়েছিল তাকে।

মরুভূমিতে বসে বৈমানিককে এইসব গল্প শোনায় রাজপুত্র, জানায় তার ছোট্ট গ্রহের সবকিছুর আকৃতিই খুব ছোট। ছোট মানুষ, ছোট পশুপাখি, ছোট ঘরবাড়ি, সবকিছুই ছোট। বৈমানিক জানায় সেও একসময় ছোটই ছিল। তার বয়স যখন ছয়, তখন সেও ক্রেয়ন দিয়ে ইচ্ছেমতো নানারকম ছবি আঁকতে ভালোবাসতো। কিন্তু বয়সে যারা বড় তারা তার আঁকা ছবির মানে বুঝতো না। সেই দুঃখে সে একসময় ওইসব আঁকাজোখা দিলো ছেড়ে। বড়রা কি আজব, ছোটদের তারা ঠিকমতো বুঝতেই পারে না, তাই না! আর তাই তো সবসময় দেখা যায়, শিশুরা শুধু বড়দের নানা জিনিস বুঝানোর চেষ্টা করে। তবু তারা বুঝে না। সব বড়রাই একদিন শিশু ছিলো, কিন্তু সবাই তার শৈশব মনে রাখতে পারে না।

রাজপুত্রের গ্রহে একটা সমস্যা ছিল। সেখানে জন্মে নিতো ‘বাওবাব’ নামে এক বিষাক্ত গাছ। প্রথমে এটা ছোট লতার মতো গজিয়ে আস্তে আস্তে বড় হয়ে মোটা ডালপালা মেলতো। ছোট্ট রাজপুত্র এসব বাওবাব লতা উপড়ে ফেলতো। কারণ, তা না হলে এ গাছ দ্রুত বড় হয়ে উঠবে আর পুরো গ্রহটিকেই ধ্বংস করে দেবে। সমস্যা ছোট আকারেই শুরু হয়, সুতরাং ছোট থাকতেই এর সমাধান করা উচিত।

রাজপুত্র ভালোবাসত তার গ্রহের একমাত্র গোলাপ ফুলটিকে। কোন সে দূর অচিনপুর থেকে উড়ে এসেছিল তার বীজ, সে বীজ এসে এ গ্রহের মাটিতে পড়লো, তাই থেকে চারা গজালো, প্রতিদিন সূর্যোদয়ে ঝলমলিয়ে ফুটে উঠতো সেই ফুল। পৃথিবীতে এসে ছোট্ট রাজপুত্র দেখা পেলো আরও পাঁচ হাজার গোলাপের। কিন্তু তার গ্রহের ওই গোলাপের মতো কোনটিই নয়। তখন সে বুঝলো তার ফেলে আসা গোলাপ ফুলটি অনন্য।

এই ভেবে ছোট্ট রাজপুত্র কাঁদতে লাগলো। তখন তার দেখা হলো এক শেয়ালের সঙ্গে, যে তাকে পোষ মানাবার সম্মোহনী জাদু শেখায়। এরপর তাদের বন্ধুত্ব হয়ে যায়। ছোট্ট রাজপুত্র বুঝতে পারে, তার বন্ধু শেয়ালটির মতো দেখতে পৃথিবীতে আরো অনেক শেয়াল আছে। কিন্তু তার বন্ধু শেয়ালটির মতো অন্যগুলো নয়। কারণ অনেক শেয়ালের মাঝে সেই শুধু তার বন্ধু। তখন ছোট রাজপুত্র বুঝতে পারলো, তার ভালোবাসার গোলাপটি আসলে তার কাছে কেমন ছিল। সে আবার বাগানে গেলো, গোলাপদের দিকে তাকালো। কিন্তু কোনো ভালোবাসা অনুভব করলো না, যদিও ফুলগুলো ছিলো সত্যি সুন্দর।

শেয়াল ছোট্ট রাজপুত্রের কানেকানে বললো, ‘পৃথিবীতে যা কিছু গুরুত্বপূর্ণ তা চোখ দিয়ে দেখা যায় না বা ছোঁয়া যায় না। সেসব দেখতে হলে হৃদয় লাগে। যা কিছু খাঁটি তা থাকে লুকিয়ে, অন্তরালে; ঝিনুকের ভেতর যেমন মুক্তো থাকে সে রকম। শুধু চোখ থাকলেই দেখা যায় না। হৃদয় দিয়ে দেখতে হয়।’ রাজপুত্র বললো, ‘একদিন আমি তেতাল্লিশবার সূর্য ডুবতে দেখলাম। কারও যখন খুব মন খারাপ থাকে তখন সূর্যাস্ত দেখতে ভালো লাগে।’ রাজপুত্র জিজ্ঞেস করে, ‘আচ্ছা, পোষ মানানোর অর্থ কী?’ শেয়াল উত্তর দেয়, ‘ওর অর্থ হলো গিয়ে সম্পর্ক তৈরি করা।’

রাজপুত্র সেই শেয়ালকে পোষ মানিয়েছিলো। এখন সময় হলো তাকে ছেড়ে যাওয়ার, তাই বড় কষ্ট হচ্ছে রাজপুত্রের। সে বুঝতে পারলো কাউকে ভালোবাসলে তাকে ছেড়ে যাওয়া কষ্টের। বিদায়ের সময় শেয়াল বললো, গমক্ষেতের ওপর দিয়ে যখন বাতাস বইবে, তখন বাতাসে কান পাতলে শোনবে আমার কথা। গমের সোনালি শিষের দিকে তাকিয়ে তোমার মনে পড়বে সোনালি চুলের সেই বন্ধুর মুখ।

পৃথিবীতে ঘুরতে ঘুরতে রাজপুত্রের দেখা হলো একজন রেলওয়ে সুইচম্যান ও একজন বণিকের সঙ্গে, তারপর আবার সে ফিরে এলো বৈমানিকের কাছে। এদিকে মরুভূমিতে আটদিন কেটে গেছে তাদের। অষ্টম দিন তীব্র পানি সংকট দেখা দিলো। সারাদিন হেঁটে খুঁজে অবশেষে ভোরের দিকে একটি কূপ খুঁজে পায় রাজপুত্র, সেই পানি তৃপ্তি নিয়ে খায় বৈমানিক ও রাজপুত্র। এভাবে কেটে যায় মাসের পর মাস। ঠিক এক বছর পর শেষ পর্যন্ত সেই দুর্গম মরুভূমিতে আটকে পড়া বিমান ঠিক করতে পারেন বৈমানিক, ফিরে যান যান নিজ দেশে।

কিন্তু ছোট্ট রাজপুত্রকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বৈমানিকের ধারণা সে হয়তো চলে গেছে অচেনা কোনো গ্রহলোকে। ছোট্ট রাজপুত্র কি সাপের বিষে মারা গেলো? নাকি ফিরে গেছে তার ছোট্ট গ্রহে, তার প্রিয় গোলাপের কাছে? কেউ জানে না। বৈমানিক দুশ্চিন্তা করেন, এতক্ষণে হয়তো ভেড়াটি রাজপুত্রের গোলাপকে খেয়ে ফেলেছে। রাতের আকাশে তারাভরা মরুভূমির একটা দৃশ্য আঁকেন বৈমানিক আর বলেন- তোমরা যদি কখনও এইখানে যাও তাহলে ওই তারাভরা আকাশের দিকে চেয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকো, আর ছোট্ট রাজপুত্রকে দেখামাত্র খবরটা আমাকে জানিও।

বই: ‘লে পেতি প্রিন্স’ বা ‘দ্য লিটল প্রিন্স’, লেখক: আঁতোয়ান দ্য সাঁৎ জুপেরি (১৯০০-১৯৪৪), প্রথম প্রকাশ: ১৯৪৩, অলঙ্করণ: লেখক নিজে। প্রায় তিনশ ভাষা ও উপভাষায় এটি অনূদিত হয়েছে,  নির্বাচিত হয়েছে বিশ শতকে ফ্রান্সের সেরা বই হিসেবে। ক্যাথিরিন উডসের ইংরেজি অনুবাদ থেকে বইটির সারমর্ম লেখা হয়েছে।

কিডস পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com। সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!