অ্যালডাস হাক্সলির গল্প: পিয়ারব্লজমের কাক

হাক্সলি তার সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও দূরদর্শী বুদ্ধিজীবীদের একজন হিসেবে পরিচিত।

মাজহার সরকারমাজহার সরকার
Published : 20 July 2018, 01:49 PM
Updated : 20 July 2018, 01:49 PM

ইংরেজ লেখক ও দার্শনিক অ্যালডাস লিওনার্ড হাক্সলি (১৮৯৪-১৯৬৩)। তিনি তার সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও দূরদর্শী বুদ্ধিজীবীদের একজন হিসেবে পরিচিত। হাক্সলি প্রায় পঞ্চাশটি বইয়ের লেখক, যার মধ্যে রয়েছে উপন্যাস ‘ব্রেভ নিউ ওয়ার্ল্ড’ (১৯৩২), দীর্ঘ প্রবন্ধের বই ‘দ্য প্যারেনিয়াল ফিলসফি’ (১৯৪৪) এবং নন-ফিকশন ‘দ্য ডোরস অফ পারসেপশন’ (১৯৫৪)। তার এই বই পড়ে উদ্বুদ্ধ হয়ে জিম মরিসন তার ব্যান্ডের নাম রাখেন ‘দ্য ডোরস’।  

হাক্সলির ১৪ বছর বয়সে তার মা মারা যান। তার কিছুদিন পর চোখের সংক্রমণে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে প্রায় অন্ধ ছিলেন তিনি। এ অবস্থার বিরুদ্ধে লড়াই করেই হাক্সলি তার স্কুলজীবন পার করেন, তারপর ১৯১৬ সালে অক্সফোর্ডের ব্যালিওল কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক পাশ করেন। পাঁচ বছর পর প্রকাশিত হয় তার প্রথম উপন্যাস ‘ক্রোম ইয়েলো’। ইংরেজ বুদ্ধিজীবীদের ব্যঙ্গ করে লেখা এ বই তাকে সাফল্য এনে দেয়। তার একটি বিখ্যাত উক্তি- ‘মানুষের মনের বিরুদ্ধে সবচেয়ে জঘন্য পাপ হলো প্রমাণ ছাড়া কোনকিছু বিশ্বাস করতে বাধ্য করা।’

হাক্সলি সাতবার সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত হন এবং অবশেষে ১৯৬২ সালে ‘রয়্যাল সোসাইটি অফ লিটারেচার’ তাকে নির্বাচিত করে। ১৯৬৩ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার লস অ্যাঞ্জেলেসে ক্যান্সারে মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত লেখালেখি চালিয়ে গেছেন তিনি। ১৯৪৪ সালে লেখা হাক্সলির একটি গল্প ‘দ্য ক্রোজ অব পিয়ারব্লজম’, বড়দিনের উপহার হিসেবে তিনি তার ভাইয়ের মেয়ের জন্য লিখেছিলেন এটি। ১৯৬৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের র‍্যানডম হাউজ থেকে বারবারা কোনির অলঙ্করণে এটি বই আকারে প্রথম প্রকাশিত হয়। ২০১১ সালে সোফি ব্ল্যাকেলের অলঙ্করণে নিউ ইয়র্ক থেকে বইটি পুনর্মুদ্রণ করা হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেসের একটি ছিমছাম শহর পিয়ারব্লজম। অনেক অনেক দিন আগে সে শহরে ছিলো বড় এক তুলাগাছ, সে তুলাগাছে বসবাস করে দুটো কাক।

তুলাগাছের গোড়ায় আবার বাস করে মস্ত বড় এক অজগর ছানা। প্রতিদিন দুপুর তিনটায় মিসেস কাক যখন বাজারে যায় তখন সাপটা হড়কাতে হড়কাতে গাছের উপরে উঠে আসে আর কাকের বাসায় যত ডিম আছে গপগপ সব খেয়ে ফেলে।

গত এক বছর ধরেই এমন কাণ্ড করে আসছে অজগর। মিসেস কাক দুই হাতের আঙুল গুনে গুনে আমাদের জানিয়েছে, রাক্ষস অজগরটা এ পর্যন্ত তার মোট দুইশ নয়টা ডিম খেয়েছে। একদিন হলো কি, দুপুরে বাজার থেকে একটু আগেই তুলাগাছে ফিরে এলো মিসেস কাক। বাসায় ঢুকে সে তো অবাক! নিজের চোখে দেখতে পেলো অজগরটা বসে বসে তার ডিম খাচ্ছে। ‘রাক্ষস কোথাকার!’ চিৎকার করে উঠলো মিসেস কাক, ‘এটা কী করছো তুমি!’

মুখভর্তি ডিম নিয়ে ফুলো ফুলো গাল দুটো নেড়ে অজগর বললো, ‘দেখতে পাচ্ছো না কী করছি! সকালের নাস্তা করছি।’ তারপর মিসেস কাকের উত্তরের আশা না করে তার পাশ দিয়েই হড়কাতে হড়কাতে তুলাগাছের নিচে নেমে এলো অজগর, এসে হাই তুলে বিছানায় শুয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়লো।

মিস্টার কাক যখন বাসায় ফিরে এলো তখন মিসেস কাক তাকে সমস্ত ঘটনা খুলে বললো। আর জানালো যে সে সাপটাকে মেরে ফেলেছে। কিন্তু মিস্টার কাক তা বিশ্বাস করলো না। কিন্তু মিসেস কাক বললো, ‘আমি মোটেও ভীতুর ডিম নই। কিন্তু তুমি যে পরিকল্পনা করছো তার একটাও ভালো না। তোমার পরিকল্পনা মাঝে মাঝে একটা-দুটো ভালো হয়, বাকি সব পচা।’ এখন যে করেই হোক আমাদের ডিমগুলোকে অজগরের হাত থেকে বাঁচাতে হবে।

মন খারাপ করে মিস্টার কাক গেলো তার বন্ধু পেঁচার সঙ্গে দেখা করতে। পেঁচা হলো বিশিষ্ট চিন্তাবিদ এবং অনেক জ্ঞানী। তার কাছে নিশ্চয়ই একটা ভালো বুদ্ধি পাওয়া যাবে, ভাবলো মিস্টার কাক। সব শুনে পেঁচা চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ ভাবলো। তারপর চেহারাটা জ্ঞানীর মতো বানিয়ে বললো, ‘আমরা এমন কিছু ডিম বানাবো যেগুলো আসলে কাদার তৈরি। তারপর সেগুলো আগুনে পুড়িয়ে শক্ত করবো।’

এই ভেবে তারা মিস্টার ইয়স্টের জমি থেকে কাদা আনলো, অলিভিয়ার বাড়ির চুলোয় সে কাদার গোলা আগুনে পুড়িয়ে শক্ত করলো, তারপর সেই গোলা সাদা রঙ করলো। এই কাজে জ্ঞানী পেঁচা ও মিস্টার কাককে সহযোগিতা করতে এলো লাকি ও সিগি।

দারুণ যন্ত্রণায় ডানে-বামে চিত হয়ে কাত হয়ে শরীর মোচড়াতে শুরু করলো অজগর, ডিম দুটো ফাটে কিনা। কিন্তু না, পুরো শরীর গাছের মধ্যে প্যাঁচিয়ে জড়িয়ে দুলিয়ে কাঁপিয়েও ডিম দুটো পেটে আস্ত রয়ে গেলো আর ব্যথা দিতে লাগলো।

জ্ঞানী পেঁচা মিস্টার কাককে জিজ্ঞেস করলো, ‘তোমার স্ত্রীর ডিমের রঙ কী?’

মিস্টার কাক বোকার মতো বললো, ‘ডিমের আবার কী রঙ হয়! সাদা’।

‘শুধুই সাদা?’

‘না, সাদার মধ্যে ছিটছিটে কালো ও মলিন সবুজ দাগ আছে।’

তারপর তারা সাদা গোলার ওপর এমনভাবে সবুজ ও কালো মলিন ছিটছিটে ফোঁটা এঁকে দিলো দেখে মনে হচ্ছে ওগুলো আসলে সত্যি সত্যি কাকের ডিম। 

পরদিন, মিসেস ও মিস্টার কাক মিলে নকল ডিমগুলো তাদের কুলায় রেখে দিলো এবং যার যার কাজে বেরিয়ে পড়লো। প্রতিদিনের মতো সেদিনও দুপুর তিনটায় অজগর হড়কাতে হড়কাতে গাছের আগায় এসে উপস্থিত হলো, কাদায় তৈরি দুটো নকল ডিম গাপুস-গুপুস করে খেয়ে নিলো।

খেয়ে দিলো তৃপ্তির ঢেঁকুর, নিজের বাসার উপরেই এমন একটা খাবার প্রতিদিন জুটে বলে বেশ খুশি হলো অজগর। আর ভাবলো জীবনটা তার ধন্য বটে! খুশিতে গুনগুন করে গান গাইতে লাগলো অজগর। গানটা হলো এমন-

             ‘আমার ডানা নেই রে, তাই উড়তে পারি না

               আমার পা নেই রে, তাই দৌড়াতে পারি না

               কালো পাখিরা গান গায় যেখানে

               হামা দিয়ে আমি যাই সেখানে

               আর তাদের ছিটছিটে ডিমগুলো খাই

               গাপুসগুপুস, আহা হা হা

               আর তাদের ছিটছিটে ডিমগুলো খাই

               গাপুসগুপুস, আহা হা হা...’

গান শেষ হতেই পেট মোচড় দিলো অজগরের, ভুড়ভুড় করে শব্দ হলো পেটের মধ্যে। যে ডিম দুটো সে আস্ত গিলে ফেলেছিলো সেগুলো পেটের মধ্যে গিয়ে এখনও আস্ত রয়ে গেছে, ভাঙেনি। এমন তো হওয়ার কথা নয়! এখন তো পেট চিনচিন করছে আর ধীরে ধীরে বাড়ছে ব্যথা। দারুণ যন্ত্রণায় ডানে-বামে চিত হয়ে কাত হয়ে শরীর মোচড়াতে শুরু করলো অজগর, ডিম দুটো ফাটে কিনা। কিন্তু না, পুরো শরীর গাছের মধ্যে প্যাঁচিয়ে জড়িয়ে দুলিয়ে কাঁপিয়েও ডিম দুটো পেটে আস্ত রয়ে গেলো আর ব্যথা দিতে লাগলো।

ততক্ষণে বাইরের কাজ শেষে তুলাগাছে নিজের নীড়ে ফিরে এলো মিস্টার ও মিসেস কাক। এসে দেখলো গাছের ডালে নাস্তানাবুদ হয়ে ঝুলে আছে বেচারা অজগর। তারপর থেকে অজগরের উচিত শিক্ষা হলো। সে আর কোনোদিন কাকের ডিম খেলো না, বরং কাকের বন্ধু হয়ে গেলো।

এবার মিসেস কাকের ডিম ফুটে বেরিয়ে এলো কয়েক ডজন ছানা। ছোট্ট কাক ছানাদের ছোট ছোট জামা-কাপড় কোথায় শুকানো হতো জানো! অজগরকে দড়ির মতো লম্বা করে ডালে ঝুলিয়ে তার গায়ে বাচ্চাদের কাপড় শুকাতে দিতো মিসেস কাক।