কিন্তু হল কী, একদিন এমন একটা ব্যাপার ঘটল যে তার ফলে তার জীবনের ধারাই গেল ওলটপালট হয়ে। একদিন জল থেকে উঁচিয়ে থাকা একটা খোঁটার ওপর বসে ছিল ব্যাঙ, আর বসে-বসে মহা আরামে হালকা বৃষ্টিতে ওম্ পোহাচ্ছিল।
ভাবছিল- ‘আহ্, কী চমৎকার বিষ্টিভেজা দিনটা! বেচেবর্তে থাকার কতই-না মজা!’
বৃষ্টির ফোঁটা ঝরে ঝরে পড়ছিল তার চক্কর-কাটা চকচকে পিঠের ওপর, আর তারপর ফোঁটাগুলো গড়িয়ে নামছিল তার পেটের নিচে আর পেছনের পা-দুখানার পেছনে। এত আরাম লাগছিল তার যে সে আনন্দে ঘ্যাঙর-ঘ্যাঙ করে ডেকে উঠেছিল আর-কি, কিন্তু ভাগ্যি ভালো যে সময়মাফিক তার মনে পড়ে গেল সময়টা হচ্ছে হেমন্ত আর ব্যাঙেরা হেমন্তকালে ডাকে না, তাদের ঘ্যাঙর-ঘ্যাঙ ডাক ছাড়ার ঋতু হচ্ছে বসন্ত। কাজেরই সময়মতো সামলে গিয়ে সে ডাকটা গিলে ফেলল আর নিঃশব্দে বসে-বসে আরাম পোহাতে লাগল।
কিন্তু হাঁসেরা কোথায় যাচ্ছে এটা জানার জন্য তার এমন আকুলিবিকুলি জাগল যে সবদিক ভেবেচিন্তে সে সাহস করে ড্যাবড্যাবে দুটো চোখওয়ালা তার মুখখানা জলের ওপর ভাসিয়ে তুলল।
আর একথা শোনামাত্র বাকি সব হাঁস সম্মতি জানিয়ে সজোরে প্যাঁক-প্যাঁক ডাক ছাড়তে শুরু করে দিল।
ব্যাঙ এবার ভয়ে-ভয়ে বলে উঠল, ‘আপনাদের কথায় বাধা দিচ্ছি বলে মার্জনা করবেন। কিন্তু ওই যে বললেন দক্ষিণে যাবার জন্য আপনারা এত তাড়াহুড়ো করছেন, তা সে-জায়গাটা কোথায়?”
‘ওহ্, দক্ষিণ জায়গাটা ভারি চমৎকার! ওখানে এখন গরম। আর কি সুন্দর উষ্ণ জলের বাদা আছে ওখানে! আর আছে মোটা মোটা পুরুষ্টু সব পোকা। ওহ্, কী চমৎকার জায়গা দক্ষিণ-দেশটা।’
হাঁসেদের উত্তেজিত এই চ্যাঁচামেচিতে কানে প্রায় তালা ধরে গেল ব্যাঙের। সে অনেক কাকুতিমিনতি করে তবে তাদের চুপ করাল, তারপর অন্যদের চেয়ে যার বেশি জ্ঞানগম্যি আছে বলে মনে হল এমন ভারিক্কিগোছের একটি হাঁসকে মিনতি জানিয়ে বলতে বলল, ‘দক্ষিণ ব্যাপারটা কী?’
‘ওখানে পোকামাকড় আর মশা পাওয়া যায় কি?
তা আর বলতে? পাওয়া যায় একেবারে ঝাঁকে ঝাঁকে।’ জবাব দিল জ্ঞানী হাঁসটি।
শুনেই ব্যাঙ ঘ্যাঙর-ঘ্যাঙ করে ডেকে উঠল। তারপরই তাড়াতাড়ি চারিদিক তাকিয়ে দেখল হেমন্তকালে ডাক ছাড়তে ওর বন্ধুরা একে শুনে ফেলল কিনা। কিন্তু একবারের জন্য হলেও এমন আজব কথা শুনে ঘ্যাঙর-ঘ্যাঙ ডাক না ছেড়ে উপায় কী! হাঁসেদের এবার ও মিনতি জানিয়ে বলল, ‘আমাকেও আপনাদের সঙ্গে নিন-না কেন!’
ব্যাঙ শুধোল, ‘আপনারা রওনা দিচ্ছেন কবে?
‘শিগগিরি, খুব শিগগিরি’, একসঙ্গে হেঁকে বললে সবকটা হাঁস। ‘প্যাঁক-প্যাঁক, প্যাঁক-প্যাঁক। ভারি ঠাণ্ডা এখানে। শিগগিরি আমাদের পাড়ি দিতে হবে দক্ষিণে, দক্ষিণে, দক্ষিণে!’
‘আমাকে মিনিট-পাঁচেক সময় দেবেন কি?’ মিনতি জানিয়ে বলর ব্যাঙ। ‘পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ফিরে আসব আমি, আর যাওয়ার উপায় একটা কিছু মাথা থেকে বের করে ফেলবই ফেলব।
যে খোঁটার আগায় ফের উঠে বসেছিল তা থেকে জুপ করে জলে লাফিয়ে পড়ল ব্যাঙ, তারপর জলার নিচেকার কাদার মধ্যে এমনভাবে সেঁধিয়ে গেল আর মাটিচাপা হয়ে রইল যাতে তার চিন্তায় কেউ বিঘ্ন ঘটাতে না পারে। এদিকে পাঁচ মিনিট কেটে গেল আর হাঁসেরাও ওড়বার জন্যে প্রস্তুত হল। আর ঠিক সেই মুহূর্তে খোঁটার কাছে জলের মধ্যে ভুস করে ভেসে উঠল ব্যাঙ। ব্যাঙের মুখ আনন্দে যতখানি ঝলমল করতে পারে ওর মুখও ততখানি ঝলমল করে উঠেছে তখন।
ব্যাঙ হালকা প্রাণী হলেও হাজার হাজার মাইল তাকে ঠোঁটে করে বয়ে নিয়ে যাওয়া আর একবারের জন্যও প্যাঁক-প্যাঁক করে না-ডাকাটা বড় খেলাকথা নয়, তবু ব্যাঙের এত বুদ্ধি দেখে হাঁসেরা এমনই খুশি হয়ে উঠল যে এ প্রস্তাবে তারা রাজি হয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গেই। ঠিক হল, প্রতি দু’ঘণ্টা অন্তর হাঁসেরা ঠোঁট-বদল করবে, আর যেহেতু ব্যাঙ মাত্র একটা ও তারা এতগুলো প্রাণী সেইহেতু একেক জনের পালা তেমন ঘন ঘন আসবে না। ভালো আর শক্ত দেখে ছোট একটা গাছের ডাল যোগাড় করে দুটো হাঁস সেই ডালের দুই মুখ ঠোঁট দিয়ে চেপে ধরল আর ব্যাঙ ঝুলে রইল ডালের মাঝখানটা কামড়ে। এইভাবে হাঁসের গোটা ঝাঁকটা উড়াল দিল।
ব্যাঙের খুব ইচ্ছে হচ্ছিল ওদের ধন্যবাদ দেয়, কিন্তু মুখ খুললেই ওই সাংঘাতিক উঁচু থেকে পড়ে চিঁড়েচ্যাপটা হয়ে যাবে এ কথাটা সময়মতো মনে পড়ায় আরও জোরে চোয়ালদুটো দিয়ে ডালটা চেপে ধরে মুখ বুজিয়ে রইল সে। এইভাবে সারা দিন সে শূন্যে দুলতে দুলতে চলল। উড়ন্ত অবস্থাতেই হাঁসেরা ঠোঁট বদল করতে লাগল, আগের জোড়া পরের জোড়ার ঠোঁটে কায়দাদুরস্তভাবে ডালখানা চালান করে দিতে লাগল, তবু সমস্ত ব্যাপারটাই ছিল এমন সাংঘাতিক ভয়জাগানো যে থেকে থেকেই ঘ্যাঙর-ঘ্যাঙ করে ডেকে ওঠবার উপক্রম করছিল ব্যাঙ।
দয়ালু হাঁসেরা কথা দিল যে এরপর তারা আর অত উঁচু দিয়ে উড়বে না। পরদিন তারা এত নিচু দিয়ে উড়তে লাগল যে নিচের লোকে কী বলাবলি করছে তা পর্যন্ত কানে এল তাদের।
তারা শুনল একটা গ্রামের বাচ্চা ছেলেমেয়েরা চ্যাঁচামেচি করে বলছে, ‘এই দ্যাখ্, দ্যাখ্, হাঁসেরা কেমন এক ব্যাঙকে মুখে করে নিয়ে যাচ্ছে।!’
কথাটা শুনে ব্যাঙ তো আনন্দে ডগমগ হয়ে উঠল।
এরপর পরের গ্রামের বাচ্চারাও চেঁচিয়ে বলর, ‘এই দ্যাখ্, দ্যাখ্! এমন কাণ্ড দেখেছিল কোনো জন্মে?
ব্যাঙ ভাবল: এমন আজব বুদ্ধিটা যে হাঁসেদের নয়, আমারই মাথা থেকে বেরিয়েছে- তা যদি ওরা জানত!’
তৃতীয় একটা গ্রামের ওপর দিয়ে উড়ে যাবার সময় সেখানকার বাচ্চারাও চেঁচিয়ে বলল, দেখেছিস কাণ্ড! এমন বুদ্ধি বিশ্বদুনিয়ায় কার মাথা থেকে বেরোতে পারত বল্ দেখি?
না, আর সহ্য করা যায় না! এত প্রশংসায় বোঁ বোঁ করে মাথা ঘুরতে লাগল ব্যাঙের। সব সতর্কতার কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে সে এবার গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বলল:
‘আমিই এটা মাথা খাটিয়ে বের করেছি! আমি! আমিই!’
জলে পড়েই সঙ্গে সঙ্গে জলের ওপর মাথা উঁচিয়ে উঠল সে, আর উত্তেজিতভাবে গলা ফাটিয়ে সেখান থেকেই চ্যাঁচাতে লাগল
‘এ বুদ্ধি আমার, আমার, আর কারও নয়!’
কিন্তু একথা শোনার লোক ছিল না কেউ ধারে কাছে। পুকুরের জলে প্রচণ্ড তোলপাড় তুলে কী একটা এসে পড়ায় পুকুরটির বাসিন্দা ব্যাঙের ভয় পেয়ে জলের নিচে গিয়ে লুকিয়েছিল। এবার তারা একে একে ভেসে উঠতে লাগল আর মহা আতঙ্কে সবাই তাকিয়ে রইল এই আগন্তুকের দিকে। আমাদের ব্যাঙ-বাবাজি ওদের সাতখানা করে গল্প বলতে লাগল- কীভাবে সারাজীবন ধরে ভেবে-ভেবে অবশেষে দেশভ্রমণের কেমন একটা অভিনব, অত্যাশ্চর্য উপায় সে আবিস্কার করেছে। অন্য ব্যাঙেদের সে বোঝাল তার একঝাঁক পোষা হাঁস আছে, আর যখনই সে দেশভ্রমণ করতে চেয়েছে তখনই তার পোষা হাঁসের ঝাঁক তাকে বয়ে নিয়ে গেছে। সে এমনকি দক্ষিণের দেশেও গেছে, আর সেই রূপকথার দেশ কত যে সুন্দর কী করে বলি! সেখানে আছে মনোরম সব উষ্ণ জলের জলা, আর তাতে আছে ঝাঁকে ঝাঁকে পোকামাকড় সুস্বাদু কত রকমের যে পোকা তার ইয়ত্তা নেই।
কিন্তু ব্যাঙের ‘পোষা হাঁসেরা’ আর ফিরল না। তারা ভেবেচিল ব্যাঙ নিশ্চয়ই সেই শক্ত পাথুরে রাস্তায় আছড়ে পড়ে মরেছে, আর বেচারার এই করুণ পরিণতির কথা ভেবে ভারি দুঃখ পেয়েছিল তারা।
বই: ব্যাঙের বিশ্বদর্শন, লেখক: ভসেভলদ গারশিন, ছবি এঁকেছেন: নিকিতা চারুশিন, অনুবাদ: মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়, প্রকাশক: ‘রাদুগা’ প্রকাশন, মস্কো