ব্যাঙের বিশ্বদর্শন

কোনোকালে এক যে ছিল ব্যাঙ। ব্যাঙ বাস করত জলায়, ধরে ধরে খেত পোকামাকড় আর মশা আর বসন্তকাল এলেই জাতভাইদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে সজোরে ডাক ছাড়ত ঘ্যাঙর-ঘ্যাঙ। ব্যাঙ হয়তো ওই জলাতেই তার গোটা জীবন সুখে কাটিয়ে দিত- অবিশ্যি যদি-না কোনো সারসপাখি তাকে একদিন কপ্ করে খেয়ে ফেলত।

>> ভসেভলদ গারশিনবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 June 2018, 09:51 AM
Updated : 10 June 2018, 10:11 AM

কিন্তু হল কী, একদিন এমন একটা ব্যাপার ঘটল যে তার ফলে তার জীবনের ধারাই গেল ওলটপালট হয়ে। একদিন জল থেকে উঁচিয়ে থাকা একটা খোঁটার ওপর বসে ছিল ব্যাঙ, আর বসে-বসে মহা আরামে হালকা বৃষ্টিতে ওম্ পোহাচ্ছিল।

ভাবছিল- ‘আহ্, কী চমৎকার বিষ্টিভেজা দিনটা! বেচেবর্তে থাকার কতই-না মজা!’

বৃষ্টির ফোঁটা ঝরে ঝরে পড়ছিল তার চক্কর-কাটা চকচকে পিঠের ওপর, আর তারপর ফোঁটাগুলো গড়িয়ে নামছিল তার পেটের নিচে আর পেছনের পা-দুখানার পেছনে। এত আরাম লাগছিল তার যে সে আনন্দে ঘ্যাঙর-ঘ্যাঙ করে ডেকে উঠেছিল আর-কি, কিন্তু ভাগ্যি ভালো যে সময়মাফিক তার মনে পড়ে গেল সময়টা হচ্ছে হেমন্ত আর ব্যাঙেরা হেমন্তকালে ডাকে না, তাদের ঘ্যাঙর-ঘ্যাঙ ডাক ছাড়ার ঋতু হচ্ছে বসন্ত। কাজেরই সময়মতো সামলে গিয়ে সে ডাকটা গিলে ফেলল আর নিঃশব্দে বসে-বসে আরাম পোহাতে লাগল।

হঠাৎ মাথার ওপর অনেক উঁচুতে হালকা, কাটা-কাটা শিস টানার একটা আওয়াজ কানে এল ব্যাঙের। আকাশে তখন একঝাঁক হাঁস উড়ে যাচ্ছিল, আর তাদের ডানার ঘায়ে বাতাস কেটে যাওয়ার সময় অমন একটা গানের, কিংবা বলা যায় শিস দেয়ার আওয়াজ উঠছিল। হাঁসেরা সাধারণত আকাশের এত ওপর দিয়ে ওড়ে যে খালিচোখে তাদের প্রায় দেখাই যায় না, কেবল ওই শিসের শব্দ শুনে বোঝা যায় যে হাঁসের ঝাঁক উড়ে যাচ্ছে। ওইদিন অবিশ্যি হাঁসের ঝাঁকটা নিচে নেমে এসেছিল আর শূন্যে প্রকাণ্ড একটা অর্ধবৃত্তের আকারে একচক্কর ঘুরপাক খেয়ে ঝাঁকটা এসে নামল ঠিক ওই জলার জলেই যেখানে ছিল ব্যাঙের বাসা। ঝাঁকের একটা হাঁস হেঁকে বললে, ‘প্যাঁক-প্যাঁক! আমাদের এখনও বহু দূর পাড়ি দিতে হবে হে। এস, এখানে বরং কিছুমিছু খেয়ে নেয়া যাক।’
কথাটা শুনেই ব্যাঙ তাড়াতাড়ি ঝুপ করে জলে পড়ে লুকোল। সে অবিশ্যি জানত যে হাঁসেরা তার মতো প্রকাণ্ড আর মোটাসোটা কোলা ব্যাঙকে খাবে না, তবু সাবধানের মার নেই ভেবে সে ডুব দিল খোঁটার নিচে।

কিন্তু হাঁসেরা কোথায় যাচ্ছে এটা জানার জন্য তার এমন আকুলিবিকুলি জাগল যে সবদিক ভেবেচিন্তে সে সাহস করে ড্যাবড্যাবে দুটো চোখওয়ালা তার মুখখানা জলের ওপর ভাসিয়ে তুলল।

ঠিক তক্ষুণি সে শুনতে পেল আরেকটা হাঁস বলছে, ‘প্যাঁক-প্যাঁক! ঠাণ্ডা পড়ে যাচ্ছে হে। আমাদের তাড়াতাড়ি দক্ষিণে যেতে হবে হে, দক্ষিণে যেতে হবে।’

আর একথা শোনামাত্র বাকি সব হাঁস সম্মতি জানিয়ে সজোরে প্যাঁক-প্যাঁক ডাক ছাড়তে শুরু করে দিল।

ব্যাঙ এবার ভয়ে-ভয়ে বলে উঠল, ‘আপনাদের কথায় বাধা দিচ্ছি বলে মার্জনা করবেন। কিন্তু ওই যে বললেন দক্ষিণে যাবার জন্য আপনারা এত তাড়াহুড়ো করছেন, তা সে-জায়গাটা কোথায়?”

ওর কথা শুনে হাঁসেরা ভিড় করে এল ব্যাঙের চারিধারে। ওকে দেখে প্রথমেই তাদের মাথায় সে চিন্তাটা জেগেছিল তা হল কপ্ করে একগ্রাসে ওকে খেয়ে ফেলা, কিন্তু পরে তাদের প্রত্যেকেই ভেবে দেখল যে, না ব্যাঙটা সত্যিই প্রকাণ্ড বড়, ওকে গিললে গলায় বেধে যাবে হয়তো। এরপর হাঁসেরা সবাই ডানা ঝাপটে-ঝাপটে একসঙ্গে তারস্বরে বলতে লাগল:

‘ওহ্, দক্ষিণ জায়গাটা ভারি চমৎকার! ওখানে এখন গরম। আর কি সুন্দর উষ্ণ জলের বাদা আছে ওখানে! আর আছে মোটা মোটা পুরুষ্টু সব পোকা। ওহ্, কী চমৎকার জায়গা দক্ষিণ-দেশটা।’

হাঁসেদের উত্তেজিত এই চ্যাঁচামেচিতে কানে প্রায় তালা ধরে গেল ব্যাঙের। সে অনেক কাকুতিমিনতি করে তবে তাদের চুপ করাল, তারপর অন্যদের চেয়ে যার বেশি জ্ঞানগম্যি আছে বলে মনে হল এমন ভারিক্কিগোছের একটি হাঁসকে মিনতি জানিয়ে বলতে বলল, ‘দক্ষিণ ব্যাপারটা কী?’

হাঁসটি যখন সব কথা খুলে বলল তাকে তখন অবিশ্যি ব্যাঙের মনে হল যে জায়গাটা সত্যিই আজব রকমের বটে। কিন্তু আমাদের ব্যাঙ ছিল ভারি সতর্ক, সাবধান, তাই আরও সঠিক খবর জানার জন্য সে শুধোল:

‘ওখানে পোকামাকড় আর মশা পাওয়া যায় কি?

তা আর বলতে? পাওয়া যায় একেবারে ঝাঁকে ঝাঁকে।’ জবাব দিল জ্ঞানী হাঁসটি।

শুনেই ব্যাঙ ঘ্যাঙর-ঘ্যাঙ করে ডেকে উঠল। তারপরই তাড়াতাড়ি চারিদিক তাকিয়ে দেখল হেমন্তকালে ডাক ছাড়তে ওর বন্ধুরা একে শুনে ফেলল কিনা। কিন্তু একবারের জন্য হলেও এমন আজব কথা শুনে ঘ্যাঙর-ঘ্যাঙ ডাক না ছেড়ে উপায় কী! হাঁসেদের এবার ও মিনতি জানিয়ে বলল, ‘আমাকেও আপনাদের সঙ্গে নিন-না কেন!’

‘কথা বললে বটে একখানা!’ অবাক হয়ে জ্ঞানী হাঁসটি জবাব দিল। তোমাকে সঙ্গে নেব কী করে, তোমার কী ডানা আছে?

ব্যাঙ শুধোল, ‘আপনারা রওনা দিচ্ছেন কবে?

‘শিগগিরি, খুব শিগগিরি’, একসঙ্গে হেঁকে বললে সবকটা হাঁস। ‘প্যাঁক-প্যাঁক, প্যাঁক-প্যাঁক। ভারি ঠাণ্ডা এখানে। শিগগিরি আমাদের পাড়ি দিতে হবে দক্ষিণে, দক্ষিণে, দক্ষিণে!’

‘আমাকে মিনিট-পাঁচেক সময় দেবেন কি?’ মিনতি জানিয়ে বলর ব্যাঙ। ‘পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ফিরে আসব আমি, আর যাওয়ার উপায় একটা কিছু মাথা থেকে বের করে ফেলবই ফেলব।

যে খোঁটার আগায় ফের উঠে বসেছিল তা থেকে জুপ করে জলে লাফিয়ে পড়ল ব্যাঙ, তারপর জলার নিচেকার কাদার মধ্যে এমনভাবে সেঁধিয়ে গেল আর মাটিচাপা হয়ে রইল যাতে তার চিন্তায় কেউ বিঘ্ন ঘটাতে না পারে। এদিকে পাঁচ মিনিট কেটে গেল আর হাঁসেরাও ওড়বার জন্যে প্রস্তুত হল। আর ঠিক সেই মুহূর্তে খোঁটার কাছে জলের মধ্যে ভুস করে ভেসে উঠল ব্যাঙ। ব্যাঙের মুখ আনন্দে যতখানি ঝলমল করতে পারে ওর মুখও ততখানি ঝলমল করে উঠেছে তখন।

ব্যাঙ চেঁচিয়ে বলল, ‘পেয়েছি! পেয়েছি! মাথা খাটিয়ে উপায় বের করেছি একটা! আপনাদের যে কোনো দুজন ঠোঁটে করে গাছের একটা ছোট ডাল ঝুলিয়ে নিন আর আমি সেই ডালের মাঝখান থেকে ঝুলে থাকি। আপনারা উড়বেন আর ডালে করে আমাকে বয়ে নিয়ে যাবেন। কেবল একটা কথা- ‘আপনাদের প্যাঁক-প্যাঁক আর আমার ঘ্যাঙর-ঘ্যাঙ ডাকা চলবে না, তাহলেই সবকিছু চমৎকার উতরে যাবে।’

ব্যাঙ হালকা প্রাণী হলেও হাজার হাজার মাইল তাকে ঠোঁটে করে বয়ে নিয়ে যাওয়া আর একবারের জন্যও প্যাঁক-প্যাঁক করে না-ডাকাটা বড় খেলাকথা নয়, তবু ব্যাঙের এত বুদ্ধি দেখে হাঁসেরা এমনই খুশি হয়ে উঠল যে এ প্রস্তাবে তারা রাজি হয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গেই। ঠিক হল, প্রতি দু’ঘণ্টা অন্তর হাঁসেরা ঠোঁট-বদল করবে, আর যেহেতু ব্যাঙ মাত্র একটা ও তারা এতগুলো প্রাণী সেইহেতু একেক জনের পালা তেমন ঘন ঘন আসবে না। ভালো আর শক্ত দেখে ছোট একটা গাছের ডাল যোগাড় করে দুটো হাঁস সেই ডালের দুই মুখ ঠোঁট দিয়ে চেপে ধরল আর ব্যাঙ ঝুলে রইল ডালের মাঝখানটা কামড়ে। এইভাবে হাঁসের গোটা ঝাঁকটা উড়াল দিল।

হাঁসেরা তাকে অত ভয়ঙ্কর উঁচুতে তোলায় ব্যাঙের তো প্রথমে দম বন্ধ হয়ে আসার যোগাড়। তাছাড়া যে দুটো হাঁস ডালটা ঠোঁটে ধরে ছিল তারা ঠিকমতো পাশাপাশি থেকে না ওড়ায় ডালটায় ঝাঁকুনি লাগছিল খুব। এতে বেচারা ব্যাঙ শূন্যে দুলতে লাগল কাগজের তৈরি সঙ-পুতুলের মতো। পাছে মুখ থেকে ডালটা খসে যায় আর সে আছড়ে পড়ে অনেক নিচে মাটির ওপর- এই ভয়ে ব্যাঙ প্রাণপণে চোয়ালদুটো শক্ত করে কামড়ে রইল ডালখানা। এত অসুবিধে সত্ত্বেও ব্যাঙ কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি ত্রিশঙ্কুর মতো এই ঝুলে থাকায় অভ্যস্ত হয়ে উঠল, আর ইতিউতি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগল। ডাল কামড়ে ঝুলে থাকায় তার নিচ দিয়ে ঝড়ের বেড়ে যে সমস্ত খেতখামার, মাঠঘাট, নদী আর পাহাড় পিছলে পেছনে চলে যাচ্ছিল তেমন ভালো করে সে সব অবিশ্যি দেখতে পাচ্ছিল না সে, তবু ঘাড় ঘুরিয়ে মাঝে মাঝে পেছন দিকে এক আধটুকু যা দেখছিল তাতেই তার অহঙ্কার আর সুখের সীমা ছিল না। ‘বুদ্ধি খাটিয়ে কেমন একটা আজব কাণ্ড ঘটিয়েছি আমি!’ মনে মনে সে ভাবছিল। যে হাঁসের জোড়াটা ব্যাঙকে বয়ে নিয়ে চলেছিল তাদের পেছনে পেছনে উড়ন্ত হাঁসের ঝাঁক ইতিমধ্যে শতমুখে গুণকীর্তন জুড়ে দিয়েছিল ব্যাঙের।
তারা বলছিল, ‘সত্যি, আমাদের ব্যাঙভায়ার মাথা আছে বলে একখানা!, এমন মাথা আমাদের হাঁসেদের মধ্যেই-বা কটা দেখা যায় বল দেখি?’

ব্যাঙের খুব ইচ্ছে হচ্ছিল ওদের ধন্যবাদ দেয়, কিন্তু মুখ খুললেই ওই সাংঘাতিক উঁচু থেকে পড়ে চিঁড়েচ্যাপটা হয়ে যাবে এ কথাটা সময়মতো মনে পড়ায় আরও জোরে চোয়ালদুটো দিয়ে ডালটা চেপে ধরে মুখ বুজিয়ে রইল সে। এইভাবে সারা দিন সে শূন্যে দুলতে দুলতে চলল। উড়ন্ত অবস্থাতেই হাঁসেরা ঠোঁট বদল করতে লাগল, আগের জোড়া পরের জোড়ার ঠোঁটে কায়দাদুরস্তভাবে ডালখানা চালান করে দিতে লাগল, তবু সমস্ত ব্যাপারটাই ছিল এমন সাংঘাতিক ভয়জাগানো যে থেকে থেকেই ঘ্যাঙর-ঘ্যাঙ করে ডেকে ওঠবার উপক্রম করছিল ব্যাঙ।

কিন্তু অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে সাহসের পরিচয় দিতে হচ্ছিল তাকে আর সে যে সাহসী ছিল না তাও তো নয়। সেদিন সন্ধেবেলা অজানা একটা জলায় রাতের জন্য আস্তানা গাড়ল হাঁসের ঝাঁকটা। পরদিন সকালে ফের উড়াল দিল তারা, তবে এবার আর পেছন ফিরে নয় সামনের দিকে মুখ করে ঝুলে রইল ব্যাঙ, যাতে সে নিচের দৃশ্য আগের চেয়ে ভালো করে দেখতে পারে। হাঁসেরা উড়ে চলল যত সব ফসলকাটা মাঠ, হলুদ হয়ে আসা বন আর কাটা ফসল গাদা দিয়ে রাখা গ্রামের ওপর দিয়ে। ওদের কানে আসছিল নিচে মানুষজনের কথাবার্তা আর লম্বা লম্বা লাঠি দিয়ে জোয়ার-দানা আছড়ানোর আওয়াজ। অনেক লোক আবার মাথা তুলে হাঁসের ঝাঁকটাকে দেখতে লাগল আর ঝাঁকটার মধ্যে অস্বাভাবিক কিছু একটা লক্ষ্য করে একে অপরকে আঙুল উঁচিয়ে দেখাতে লাগল কী যেন। ব্যাঙের তখন ভীষণ ইচ্ছে হচ্ছিল মাটির আরও কাছ দিয়ে উড়ে যায়, যাতে লোকে তাকে দেখতে পায় আর তার সম্বন্ধে লোকে কী বলছে তা শুনতে পায় সে।
এরপর যখন তারা রাতের জন্যে থামল তখন সে হাঁসেদের বলল: ‘আচ্ছা, আমরা কি আরেকটু নিচু দিয়ে উড়ে যেতে পারি না? উঁচু দিয়ে গেলে আমরা কেমন মাথা ঘোরে আর ভয় হয় হঠাৎ শরীর কেমন করলে যদি নিচে পড়ে যাই।’

দয়ালু হাঁসেরা কথা দিল যে এরপর তারা আর অত উঁচু দিয়ে উড়বে না। পরদিন তারা এত নিচু দিয়ে উড়তে লাগল যে নিচের লোকে কী বলাবলি করছে তা পর্যন্ত কানে এল তাদের।

তারা শুনল একটা গ্রামের বাচ্চা ছেলেমেয়েরা চ্যাঁচামেচি করে বলছে, ‘এই দ্যাখ্, দ্যাখ্,  হাঁসেরা কেমন এক ব্যাঙকে মুখে করে নিয়ে যাচ্ছে।!’

কথাটা শুনে ব্যাঙ তো আনন্দে ডগমগ হয়ে উঠল।

এরপর পরের গ্রামের বাচ্চারাও চেঁচিয়ে বলর, ‘এই দ্যাখ্, দ্যাখ্! এমন কাণ্ড দেখেছিল কোনো জন্মে?

ব্যাঙ ভাবল: এমন আজব বুদ্ধিটা যে হাঁসেদের নয়, আমারই মাথা থেকে বেরিয়েছে- তা যদি ওরা জানত!’

তৃতীয় একটা গ্রামের ওপর দিয়ে উড়ে যাবার সময় সেখানকার বাচ্চারাও চেঁচিয়ে বলল, দেখেছিস কাণ্ড! এমন বুদ্ধি বিশ্বদুনিয়ায় কার মাথা থেকে বেরোতে পারত বল্ দেখি?

না, আর সহ্য করা যায় না! এত প্রশংসায় বোঁ বোঁ করে মাথা ঘুরতে লাগল ব্যাঙের। সব সতর্কতার কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে সে এবার গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বলল:

‘আমিই এটা মাথা খাটিয়ে বের করেছি! আমি! আমিই!’

আর এই চ্যাঁচানির সঙ্গে সঙ্গে হুড়মুড় করে নিচের দিকে পড়তে লাগল সে। হাঁসের ঝাঁক ভয়ে চিৎকার করে উঠল; একটি হাঁস উড়ে নেমে এসে মাঝপথে ব্যাঙকে লুফে নেবার চেষ্টা পর্যন্ত করল, কিন্তু পারল না। চারখানা ঠ্যাং লটপট করতে করতে ব্যাঙ বাবাজি নিচে পড়তে লাগল সজোরে। কিন্তু হাঁসেরা তাকে ডালে ঝুলিয়ে খুব তাড়াতাড়ি উড়ে যাচ্ছিল বলে সে যেখানটায় চ্যাঁচানি শুরু করেছিল সরাসরি তার নিচে শক্ত পাথুরে রাস্তার ওপর এসে পড়ল না, পড়ল আরও খানিকটা এগিয়ে গিয়ে গাঁ-খানার একটা প্রান্তে পৌঁছে। আর কী ভাগ্যি, পড়বি তো পড় এক্কেবারে প্রকাণ্ড একটা নোংরা পুকুরের জলে ঝুপ করে!

জলে পড়েই সঙ্গে সঙ্গে জলের ওপর মাথা উঁচিয়ে উঠল সে, আর উত্তেজিতভাবে গলা ফাটিয়ে সেখান থেকেই চ্যাঁচাতে লাগল

‘এ বুদ্ধি আমার, আমার, আর কারও নয়!’

কিন্তু একথা শোনার লোক ছিল না কেউ ধারে কাছে। পুকুরের জলে প্রচণ্ড তোলপাড় তুলে কী একটা এসে পড়ায় পুকুরটির বাসিন্দা ব্যাঙের ভয় পেয়ে জলের নিচে গিয়ে লুকিয়েছিল। এবার তারা একে একে ভেসে উঠতে লাগল আর মহা আতঙ্কে সবাই তাকিয়ে রইল এই আগন্তুকের দিকে। আমাদের ব্যাঙ-বাবাজি ওদের সাতখানা করে গল্প বলতে লাগল- কীভাবে সারাজীবন ধরে ভেবে-ভেবে অবশেষে দেশভ্রমণের কেমন একটা অভিনব, অত্যাশ্চর্য উপায় সে আবিস্কার করেছে। অন্য ব্যাঙেদের সে বোঝাল তার একঝাঁক পোষা হাঁস আছে, আর যখনই সে দেশভ্রমণ করতে চেয়েছে তখনই তার পোষা হাঁসের ঝাঁক তাকে বয়ে নিয়ে গেছে। সে এমনকি দক্ষিণের দেশেও গেছে, আর সেই রূপকথার দেশ কত যে সুন্দর কী করে বলি! সেখানে আছে মনোরম সব উষ্ণ জলের জলা, আর তাতে আছে ঝাঁকে ঝাঁকে পোকামাকড় সুস্বাদু কত রকমের যে পোকা তার ইয়ত্তা নেই।

অবশেষে সে বলল, ‘তোরা সব কেমন আছিস তাই দেখতে এখানে এলাম আমি। বসন্তকাল পর্যন্ত তোদের সঙ্গে এখানেই থাকব, যতদিন না আমার পোষা হাঁসেরা আমায় নিতে আসে। ওদের আমি চরে বেড়ানোর জন্য ছেড়ে দিয়েছি, বুঝলি তো!’

কিন্তু ব্যাঙের ‘পোষা হাঁসেরা’ আর ফিরল না। তারা ভেবেচিল ব্যাঙ নিশ্চয়ই সেই শক্ত পাথুরে রাস্তায় আছড়ে পড়ে মরেছে, আর বেচারার এই করুণ পরিণতির কথা ভেবে ভারি দুঃখ পেয়েছিল তারা।

বই: ব্যাঙের বিশ্বদর্শন, লেখক: ভসেভলদ গারশিন, ছবি এঁকেছেন: নিকিতা চারুশিন, অনুবাদ: মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়, প্রকাশক: ‘রাদুগাপ্রকাশন, মস্কো