মানুষের খোঁজে

এক ছিল রাজা। তার কোনো সন্তান ছিল না। রাজ্যের জ্যোতিষ কবিরাজ, খনকার কার কাছে যাননি তিনি! শুধু একটি সন্তানের জন্য। পীর, ফকির, মুর্শিদ সবার দুয়ারে গিয়েছেন। কারো প্রার্থনাই যে গ্রহণ হয় না!

অনার্য মুর্শিদবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 May 2018, 11:19 AM
Updated : 19 May 2018, 11:19 AM

একসময় রাজা নিরাশ হয়ে গেলেন। তিনি ধরেই নিলেন, তার কপালে সন্তান নেই। হতাশ রাজা, একদিন তার বাবার কবরে গেলেন। সমস্ত কবরের মাটি কেঁদে ভিজিয়ে দিলেন। কিন্তু মৃত বাবা কি আর সন্তান দিতে পারেন? রাজাও এটা বোঝেন। তার এই অশ্রু প্রার্থনার নয়। আফসোসের, সান্ত্বনার।

জিয়ারত শেষে রাজা ঘুমোতে গেলেন। স্বপ্নে দেখেন বাবাকে। এতো বছর পর বাবাকে দেখে রাজা মহাআনন্দিত। তিনি আসন পেতে দিলেন। কিন্তু বাবা বসলেন না। দরজায় দাঁড়িয়ে বললেন, যে পিতার মর্মই বোঝে না সে কী করে পিতা হবে! আগে সন্তান হও, তার পর পিতা।

রাজা তার পিতাকে সব সময় সম্মান করতেন। পৃথিবীতে যদি কাউকে সর্বোচ্চ মর্যাদা দিয়ে থাকেন তাহলে তিনি পিতাকেই দিয়েছেন। কিন্তু এখন পিতার কথায় মনে হচ্ছে তিনি অসন্তুষ্ট। রাজা বিনয়ের সঙ্গে বললেন, বাবা, আমিতো কখনো আপনার অমর্যাদা করিনি।

বাবা বললেন, আমার অমর্যাদা হয়তো করোনি। কিন্তু তুমি অন্য পিতার অমর্যাদা করে যাচ্ছ! অন্যের পিতা কি পিতা নন? অন্যের সন্তান কি সন্তান নন? যদি সন্তান চাও, মানুষের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ো, বিশ্ব সন্তানকে নিজের সন্তান ভাবো, তবেই না তুমি পিতা হতে পারবে। পিতার মতো পিতা। বলেই রাজার বাবা প্রস্থান করলেন।

পিতা চলে যাওয়ার পর, রাজা বুঝতে পারলেন তার ভুলগুলো কোথায়। রাজ্য পরিচালনা করতে গিয়ে তিনি কিছু মানুষের উপর অন্যায় আচরণ করেছেন। তার মাঝে অনুশোচনার জন্ম হলো।

পিতার সঙ্গে স্বপ্নে দেখা হবার পর থেকে রাজার মাঝে দেখা দেয় অন্যরকম পরিবর্তন। তিনি প্রজাদের আরো ভালোবাসতে শুরু করেন। প্রজাদের দুঃখ দুর্দশায় পাশে থেকে নিজের মাঝে প্রশান্তি খুঁজে পান।

কিন্তু শত প্রশান্তির মাঝেও একটা অশান্তি তাকে কুঁকড়ে মারে। তার একটা সন্তান নেই! সংসারটাকে তার কান্নার খেলাঘর মনে হলো। মোঘল সম্রাট বাবরের মতো রাজাও গভীর রাতে প্রার্থনায় বসে যান। নিজের জীবনের বিনিময়ে আরেকটি জীবনের জন্য প্রার্থনা করেন। রাজ্যের প্রজারাও এই খেলাঘরে একটি সন্তানের জন্য প্রতি রাতে প্রার্থনা করে।

একদিন দুপুরে, রাণী হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। রাজ্যের সব কবিরাজদের একসঙ্গে করা হলো। সবাই আশাবাদী, রাণী মা হতে চলছেন, রাজ্য আলোকিত করে রাজার ঘরে সন্তান আসছে।

খবর শুনে রাজার আনন্দের সীমা থাকল না। খুশির দরিয়ায় তার জোয়ার আসে। রাণীর প্রতি রাজা আরো বেশি যত্নবান হয়ে উঠলেন। রাণীর খাবার-দাবারের প্রতি তিনি আগের চেয়ে আরো গুরুত্ব দিতে লাগলেন।

এক সকালে,রাণীর কোলজুড়ে একটি পুত্র সন্তান আসে। হাসি ফুটে, রাজার কান্নার খেলাঘরে, প্রজাদের মুখে। ফুল ফুটতে থাকে রাজ্যের সমস্ত বৃক্ষে।

রাজপুত্র বড় হতে থাকে, রাজার আদের্শে। রাজ্যের জ্ঞানী, গুণীদের নিয়োগ দেয়া হলো রাজপুত্রকে শিক্ষা দেয়ার জন্য। রাজপুত্রের বয়স যখন বার তখন রাজা অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিনি বুঝতে পারেন, তার জীবনের সায়াহ্ন নেমে এসেছে। হয়তো একটু পরই আঁধারের চাদর নামবে।

রাজা তার সম্পত্তির সব কিছুই প্রজাদের মাঝে বিলিয়ে দিলেন। রাজপুত্রের জন্য সামান্য কিছু জমি আর একটা ঘর ছাড়া বাড়তি কিছুই রাখেননি। রাজার বিশ্বাস ছিল, এ দিয়ে তার সন্তান রাজহালতে না হলেও তার মতো একটা সাদামাটা জীবনযাপন করতে পারবে।

রাজার এমন কাণ্ডে প্রজারা আরো অবাক। তবে কি রাজপুত্র সিংহাসনের উত্তাধিকারী হবেন না! এদিকে রাজার উপর রাণীও ভীষণ ক্ষেপে গেলেন। একদিন, রাজা রাণীকে ডেকে একটি বাক্স হাতে দেন। তারপর বললেন, এখানে একটি ধন আছে। যে ধনের কারণে আমি আজ আসল রাজা। আমার পুত্র বড় হলে তাকে এটা দেবে।

রাজার কথায় রাণী আশ্বস্ত হলেন। রাজপুত্রের জন্য তা যত্ন রেখে দিলেন। কদিন পর, রাজার মৃত্যু হয়। প্রজাদের ইচ্ছায় রাণী কদিন রাজ্য পরিচালনা করেন।

রাজপুত্রের বয়স যখন আঠার পূর্ণ হলো রাণী তখন রাজার দেয়া বাক্সটি রাজপুত্রকে দেন। রাজপুত্র সযত্নে বাক্সটি খুলল। সে কি! ভেতরে তো কিছুই দেখা যাচ্ছে না, একটা চিরকুট ছাড়া।

রাজপুত্র চিরকুটটি খুললেন। তাতে লেখা আছে, ‘মানুষের সন্ধানে বেরিয়ে পড়’। রাজপুত্রও মানুষের সন্ধানে বেরিয়ে পড়েন।