সাইরেন হলো বিপদ সংকেত, এটা বাজা মানে হলো বাড়িঘর ছাড়ো, আশ্রয়খানায় আসো। সেই আওয়াজে ১৪ বছরের ‘সেইতা’ নামের এক বালক তার ৪ বছরের ছোটবোন ‘সেতসুকো’কে কাঁধে নিয়ে এক দৌড়ে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। ভাইয়ের কাঁধে চড়ে সেতসুকু আনন্দই পাচ্ছে। উৎসব উৎসব লাগছে তার কাছে।
হঠাৎ বোমা পড়ে পাশের বাড়িগুলো আগুনে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলো। সেতসুকো কেঁদে উঠলো। বোমার ভয়ে নয়, বাড়িতে তার পুতুলটা ফেলে এসেছে সেজন্য। যে কোন সময় আরেক ঝাঁক বোমা পড়তে পারে, ভাইটি বোনকে বোঝানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু কে থামায় সেতসুকুর কান্না! শেষমেষ বোনের আবদার রক্ষা করতে বাড়ির দিকে ছুটলো সেইতা, পুতুল নিলো, সেতসুকু এবার শান্ত।
মাকে খুঁজতে খুঁজতে অবশেষে এসে পেলো স্থানীয় ত্রাণকেন্দ্রে। তখন মায়ের সারা শরীর ব্যান্ডেজে মোড়ানো। বোমা হামলায় তাদের মা রক্ষা পেলো না, সারা শরীর পুড়ে গেছে। দুইদিন পর মা মারা গেলো। সেইতা নিজ মায়ের পোড়া শরীরের ছাই নিয়ে চলে এলো।
মায়ের কথা খুব মনে পড়তে লাগলো ছোট্ট সেতসুকুর। মাকে দেখার জন্য জিদ করে আর কান্না করতে করতে বসে পড়ে, ঘুমানোর সময় আরও বেশি কান্নাকাটি করে। কিন্তু সেইতা কীভাবে বুঝাবে ছোট বোনটিকে? তাই ভাইটি মিথ্যার আশ্রয়ে ভুলিয়ে রাখে বোনকে।
আশ্রয়কেন্দ্র ছেড়ে দুই ভাই-বোন তাদের এক দূরসম্পর্কের খালার বাসায় উঠলো। কিন্তু যুদ্ধের সময় চারদিকে তীব্র খাদ্য সংকট দেখা দিলো। অনেক টাকা দিয়েও আর খাবার পাওয়া যাচ্ছে না। এই সময় খালা তাদের মায়ের কিমানোর (জাপানের ঐতিহ্যবাহী পোশাক) বিনিময়ে চাউল কিনে আনে। এভাবে যতদিন তাদের মায়ের পোশাকের বিনিময়ে চাউল কেনা গেলো, ততদিন পর্যন্ত দুই-ভাই বোন খালার কাছে ভালোই ছিলো।
কিন্তু পরবর্তীতে তাদের খালাও দুর্ব্যাবহার শুরু করে, এক পর্যায়ে ভাই-বোন ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। তারা আশ্রয় নেয় গুহার মতো পরিত্যক্ত একটি জায়গায়। সেই গুহায় আলো নেই, তাতে কী! ভাই সেইতা এক রাতে নিয়ে এলো অনেকগুলো জোনাকি পোকা। জোনাকি পোকার আলোতে তাদের রাত কাটে। অন্ধকারে আলোর স্বল্পতার জন্য সেইতা জোনাকি ধরে এনে মশারির ভেতর ছেড়ে দেয়, এতে ছোট বোন সেতসুকু আনন্দিত হয়। তারা যখন মৃত জোনাকি পোকাগুলোকে কবর দেয় তখন বলে তাদের মা-ও এইভাবে কবরে শুয়ে আছে।
সন্ধ্যাবেলায় সেইতা তার বোনকে জোনাক পোকা ধরে দেয়, আর সিতসুকু যখন তা ধরে তখন জোনাক পোকা হাতের মধ্যে চেপ্টে যায়। বড় ভাই ছোট বোনের এই আনাড়িপনায় হেসে ফেলে আরেকটি জোনাক পোকা ধরে এনে তার হাতের মধ্যে দেয়। তখন সেই জোনাক পোকা আলো নিয়ে উড়ে যায়।
কিন্তু খাবার কোথাও নেই, পেটের ক্ষুধায় একসময় তারা আশপাশের জলাশয় থেকে মাছ, ব্যাঙ এসব খাওয়া শুরু করে। এসব খেতে খেতে সেতসুকু ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়। সেইতা অসুস্থ বোনের জন্য ঔষধ, খাবার কিছুই জোগাড় করতে পারে না। অবশেষে এই বাড়ি সেই বাড়ি থেকে খাবার চুরি করে আনা শুরু করলো। ধরা খায়, মারও খায়। একবার আখক্ষেত থেকে আখ চুরি করতে গিয়ে খুব মার খায় সেইতা।
অগাস্ট ৬, ১৯৪৫। যুক্তরাষ্ট্রের বিমান বাহিনী জাপানের হিরোশিমা শহরের ওপর লিটল বয় নামের নিউক্লিয় বোমা ফেলে এবং এর তিন দিন পর নাগাসাকি শহরের ওপর ফ্যাট ম্যান নামের আরেকটি নিউক্লিয় বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়। ১৫ অগাস্ট জাপান আত্মসমর্পণ করে। সেইতাদের বাবা নৌবাহিনীতে ছিলেন, তাদের বাবা জাহাজসহ প্রশান্ত মহাসাগরে ডুবে গিয়েছিলেন। কিন্তু দুই ভাই-বোন এই খবর পেলো অনেক পরে।
ভাই সেইতা প্রচণ্ড ভেঙে পড়লো। খাবারের অভাবে বোন সেতসুকু রুগ্ন হয়ে গেলো। কথা জড়িয়ে গেলো, চোখ ম্লান। ভাই সেইতা কাঁধে তুলে বোনকে ডাক্তারের কাছে নেয়। ডাক্তার বললো, পুষ্টির অভাব।
সেইতা কফিন বানানোর কাজে নেমে গেলো। কফিনের ভেতর কী দিবে? বোন সেতসুকুর পছন্দের জিনিসগুলো- মলিন হয়ে যাওয়া সেই পুতুল, পাতার ঝাড়ু, কাগজের ছাতা- সবই দিলো, শুধু মায়ের পোড়ানো সেই ছাইয়ের টিনের কৌটাটা রেখে দিলো। কফিনসহ বোনকে পুড়িয়ে দিয়ে পরিবারের ঐতিহ্যস্বরূপ ছাইয়ের অংশ টিনের কৌটায় করে নিয়ে এলো।
এমন করেই ভাই সেইতার দিনগুলো কেটে যাচ্ছিলো। ২১ সেপ্টেম্বর, ১৯৪৫। জাপানের কোবে শহরের সাননোমিয়া স্টেশন। বালক সেইতা একটা পিলারে কোনো রকমে তার শরীরটা ঠেস দিয়ে বসে আছে। সঙ্গে শুধু দুটো জিনিস- চকলেটের কৌটার মধ্যে মা ও বোনের পোড়ানো ছাই আর বাবার একখানা ছবি।
স্টেশন মাস্টার লাঠি দিয়ে গুঁতো দিয়ে বুঝলেন বালক সেইতা আর অক্সিজেন টানতে পারছে না। রাতের দিকে একটা লাশবহনকারী গাড়ি এসে বালক সেইতার লাশ তুলে নিয়ে গেলো।
এটি ‘গ্রেভ অব দ্য ফায়ারফ্লাইজ’, একটি জাপানি অ্যানিমেশন চলচ্চিত্র, বাংলায় অনুবাদ করলে দাঁড়ায় ‘জোনাকির কবর’। জাপানি ভাষায় এর নাম ‘হোতারু নো হাকা’। ছবিটি নির্মাণ করেছেন পরিচালক ইসাও তাকাহাতা। এর কাহিনী নেওয়া হয়েছে আকিয়াকি নোসাকার শিশুতোষ গল্প থেকে। এ গল্পটি জাপানের স্কুলের শিক্ষার্থীদের কাছে বেশ জনপ্রিয়।