সাড়া জাগানো ‘তিনটি প্রশ্ন’

এক রাজার মনে হঠাৎ এক ভাবনা এলো। তার মনে জাগলো তিনটি প্রশ্ন। রাজা ভাবলেন, যদি এ তিনটি প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যেতো তাহলে তাকে কখনই কোন কাজে ব্যর্থ হতে হতো না, কোনো সমস্যায় পড়তে হতো না।

মাজহার সরকারবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 April 2018, 09:52 AM
Updated : 30 April 2018, 09:52 AM

প্রশ্নগুলো হলো- কোন কাজটি ঠিক কখন করা উচিৎ সেই উপযুক্ত সময়টি যদি জানা যেতো, ঠিক কোন ব্যক্তির কোন কথা শুনতে হবে তা যদি আগের থেকেই জানা যেতো বা কোন ব্যক্তিকে এড়িয়ে চলতে হবে তা আগে থেকেই বুঝা যেতো এবং কখন কোন কাজটি করা সবচেয়ে প্রয়োজন তা যদি আগে থেকে জানা যেতো!

এ ভাবনা থেকেই রাজা তার পুরো রাজ্যে ঘোষণা করলেন, যে ব্যক্তি এ তিনটি বিষয়ে রাজাকে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে শেখাতে পারবে তাকে বড় পুরস্কার দেওয়া হবে।

রাজ্যের বিভিন্ন প্রদেশ ও অঞ্চল থেকে বাঘা বুদ্ধিজীবী, জ্ঞানী-গুণী আর সেরা চিন্তাবিদরা আসতে লাগলো রাজার কাছে। কিন্তু তারা প্রত্যেকে রাজার প্রশ্নের ভিন্ন ভিন্ন উত্তর দিলো।

প্রথম প্রশ্নের উত্তরে কেউ বললো, কোনো কাজ সঠিক সময়ে শুরু করতে হলে একজনকে এক সপ্তাহ, এক মাস বা এক বছর আগে থেকে পরিকল্পনা করে এগুতে হবে। আর এভাবেই কোনো কাজ সঠিক সময়ে শুরু করা যাবে।

কেউ আবার বললো যে কোনো কাজ আগে থেকেই পরিকল্পনা করে সেই অনুযায়ী শুরু করা অসম্ভব। তাই বলে কোনো কাজ না করে বসে থাকাও উচিৎ নয়। একেকটা কাজ সময়মতো, গুরুত্ব বুঝে করা দরকার।

আবার জ্ঞানীদের কেউ কেউ বললো, রাজাকে খুব সচেতন হতে হবে চারপাশে কী চলছে সে বিষয়ে। তবুও প্রতিটি কাজের সময় আগে থেকে ঠিক করা আসলে অসম্ভব। রাজা বড়জোর জ্ঞানী সভাসদদের নিয়ে একটি উপদেষ্টামণ্ডলী বা কমিটি তৈরি করে তাদের সঙ্গে আলোচনা করে কর্ম-পরিকল্পনা ঠিক করতে পারেন।

আবার আরেকদল বুদ্ধিজীবী সবাইকে থামিয়ে দিয়ে বললো, কিছু কিছু ব্যাপার আছে যেটা নিয়ে উপদেষ্টামণ্ডলীর সঙ্গে আলোচনা করার সময়ই পাওয়া যায় না। এসব সিদ্ধান্ত মুহূর্তের মধ্যে নিতে হবে। আর তাতে সফল হবার জন্য ভবিষ্যতে কী হতে যাচ্ছে তা জানতে হবে।

তখন আবার উৎসাহীদের কেউ কেউ বলে উঠলো, একমাত্র সার্কাসের লোক, জাদুকর বা জ্যোতিষীরাই ভবিষ্যৎ বলে দিতে পারে, তাই তাদের নিয়ে একটা উপদেষ্টা পরিষদ বানানো যেতে পারে।

একইভাবে দ্বিতীয় প্রশ্নের বেলায়ও বিভিন্ন উত্তর আসতে থাকলো। কেউ বললো উপদেষ্টাদের কথা, কেউ বললো মোল্লা-পুরোহিতের কথা, কেউ চিকিৎসক-আইনজীবীদের কথা, আবার অনেকে বললো সৈনিকদের কথা শোনাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

তৃতীয় প্রশ্ন ছিলো কোন বিষয়টিকে রাজার সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিৎ। তার জবাবে অনেকে পরামর্শ দিলো বিজ্ঞানচর্চার ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিৎ। অনেকে মন্তব্য করলো সামরিক কৌশল আর যুদ্ধক্ষেত্রে দক্ষতা বাড়াতে মনোযোগ দেওয়া উচিৎ। আবার আরেক দল মত দিলো, ধর্ম-কর্ম পালনই থাকা উচিত তালিকার সবার উপরে।

রাজা সবার কথা মন দিয়ে শুনলেন, কিন্তু কারও কথা মনপুত হলো না, কারও সঙ্গে একমত হতে পারলেন না। কাউকে পুরস্কারও দিলেন না। তারপরও রাজা সঠিক জবাব পাবার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠলেন।

শেষমেশ রাজা এক সন্ন্যাসীকে ডাকে পাঠালেন। এ সন্ন্যাসী পুরো রাজ্যে তার জ্ঞান ও দূরদর্শিতার জন্য স্বীকৃত, রাজা তার সঙ্গেই পরামর্শের সিদ্ধান্ত নিলেন।

সেই সন্ন্যাসী ছিলো গৃহত্যাগী, সবসময় বনে বাস করতো, কখনই বন ছেড়ে লোকালয়ে যেতো না। সে সাধারণ লোক ছাড়া সরকারি বড় কোন কর্মকর্তার সঙ্গে কথাও বলতো না। তাই সন্ন্যাসীর দেখা পেতে রাজা তার বেশভূষা বদলে সাধারণ প্রজার ছদ্মবেশ নিলেন।

সন্ন্যাসীর ঘরে ঢোকার কিছুদূর আগেই তিনি তার ঘোড়াটিকে ছেড়ে দিলেন এবং তার দেহরক্ষীদের বাইরে অপেক্ষা করতে বললেন।

রাজা যখন সন্ন্যাসীর কাছে গেলেন সন্ন্যাসী তখন তার কুঁড়েঘরের সামনে মাটি খুঁড়ছিল। প্রজার ছদ্মবেশে থাকা রাজাকে দেখে সন্ন্যাসী তাকে স্বাগত জানিয়ে আবার মাটি খোঁড়ায় মন দিলেন। সন্ন্যাসী খুবই শীর্ণ শরীরের ও দুর্বল। মাটি খুঁড়তে কোদাল দিয়ে সে কেবল এক একটি করে কোপ দিচ্ছিলো এবং প্রতিবার জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছিলো।

রাজা কাছে গিয়ে বললেন, জ্ঞানী সন্ন্যাসী! আমি আপনার কাছে এসেছি তিনটি প্রশ্নের উত্তর জানতে। রাজা তখন সেই প্রশ্ন তিনটি করলেন।

সন্ন্যাসী মন দিয়ে রাজার প্রশ্ন শুনলো। কিন্তু কোন উত্তর না দিয়ে হাত দুটো একটু ভিজিয়ে নিয়ে পুনরায় খোঁড়া শুরু করলো।

‘আপনি মনে হয় ক্লান্ত’ সন্ন্যাসীকে বললেন রাজা- ‘আমাকে কোদালটা দিন। আমি কিছুক্ষণ মাটি খুঁড়ি।’

‘ধন্যবাদ’ বলে কোদালটি রাজার হাতে দিয়ে সন্ন্যাসী মাটিতে বসলো।

ক্ষেতের দুটো খণ্ড খুঁড়ে রাজা মাটি কোপানো বন্ধ করে দিলেন এবং সন্ন্যাসীকে পুনরায় প্রশ্ন তিনটি জিজ্ঞেস করলেন।

সন্ন্যাসী এবারও কোন উত্তর দিলো না। কোদালের দিকে হাত বাড়িয়ে রাজাকে বললো, ‘এবার আপনি কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিন, আমি একটু খুঁড়ি।

কিন্তু রাজা কোদাল না দিয়ে নিজেই আবার মাটি কোপানো শুরু করলেন।

এভাবে এক ঘণ্টা পেরিয়ে গেলো। এরপর আরও এক ঘণ্টা পার হলো। বনের গাছপালার পেছনে সূর্য ডুবতে শুরু করেছে। শেষে রাজা কোদাল মাটিতে গেঁথে রেখে খোঁড়া বন্ধ করলেন এবং বললেন, ‘আমি আপনার কাছে আমার তিনটি প্রশ্নের উত্তর জানতে এসেছি। আপনি যদি উত্তর না দেন তাহলে আমাকে ফিরে যেতে হবে।’

‘কে যেন দৌড়ি আসছে এদিকে!’ সন্ন্যাসী বললো, ‘দেখি তো কে!’

রাজা পেছনে ঘুরে তাকালেন, দেখলেন একজন দাড়িওয়ালা লোক বনের ভেতর থেকে দৌড়ে আসছে। লোকটি তার দুই হাত দিয়ে তলপেট চেপে ধরে আছে আর তার আঙুলের ফাঁক দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে।

লোকটি রাজার কাছে পৌঁছেই অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে গেলো। তার জামা খুলে দেখা গেলো তলপেটে অনেক গুরুতর একটি জখম। রাজা ও সন্ন্যাসী দু’জনে মিলে লোকটির ক্ষত পরিষ্কার করে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিলেন। তারপরও রক্তঝরা বন্ধ হচ্ছিলো না। তখন রাজা ব্যান্ডেজ খুলে ক্ষত শুকিয়ে মুছে পুনরায় ব্যান্ডেজ করে দিলেন। এতে রক্ত পড়া বন্ধ হলো। জ্ঞান ফিরলে লোকটি পানি খেতে চাইলো। রাজা পানি এনে তাকে খেতে দিলেন।

ততক্ষণে সূর্য গেছে ডুবে, পরিবেশ একদম শীতল। রাজা আর সন্ন্যাসী দু’জনে মিলে ধরাধরি করে লোকটিকে সন্ন্যাসীর কুঁড়েঘরের ভেতর নিয়ে গিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিলেন। বিছানায় শুয়ে লোকটি নিশ্চুপ হয়ে চোখ বুজে রাখলো।

কিন্তু সারাদিন অনেক পথ হেঁটে ও দিনভর মাটি খুঁড়ে রাজা ছিলেন ক্লান্ত। তিনি দরজার কাছেই উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লেন ও কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়লেন। তার ঘুম এতটাই গাঢ় হলো যে এক ঘুমেই গ্রীষ্মের সেই ছোট রাতটা কেটে গেলো। ভোরে ঘুম থেকে উঠে রাজা প্রথমে বুঝতেই পারছিলেন না তিনি আসলে কোথায় আছেন বা তার দিকে জ্বলজ্বল চোখে তাকিয়ে থাকা দাড়িওয়ালা লোকটাই বা কে? তাও মনে করতে পারছিলেন না রাজা। সবকিছু বুঝে উঠতে তার কিছুটা সময় লাগলো।

রাজাকে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে দাড়িওয়ালা লোকটা কণ্ঠ কোমল করে বললো, ‘আমাকে ক্ষমা করে দিন।’ রাজা বললেন, ‘আমি তো আপনাকে চিনিই না। আর ক্ষমা করার মতো কিছু তো হয়নি।’

‘আপনি আমাকে চিনতে না পারলেও আমি আপনাকে ঠিকই চিনেছি। আপনি আমার ভাইকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিয়েছিলান আর তার সব সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে নিয়েছিলেন। সেই থেকে আমি আপনার শত্রু, আপনাকে হত্যা করে প্রতিশোধ নেওয়ার প্রতিজ্ঞা করেছিলাম।’

লোকটা বলতে থাকলো, ‘আমি জানতে পেরেছিলাম আপনি আজ এই সন্ন্যাসীর সঙ্গে দেখা করতে আসবেন। সন্ন্যাসীর ঘর থেকে ফেরার পথে আপনাকে হত্যা করার পরিকল্পনা ছিলো আমার। কিন্তু সন্ধ্যা হয়ে গেলেও আপনি না ফেরাতে আমি নিজেই সন্ন্যাসীর কুঁড়েঘরে চলে এসেছি আপনাকে হত্যা করতে। কিন্তু আসার পথে আপনার দেহরক্ষীরা আমাকে চিনে ফেলে আর তাদের সঙ্গে আমার মারামারি হয়। এতে আমি আহত হয়ে কোন রকমে পালিয়ে আসি, কিন্তু আমি রক্তঝরেই মারা যেতাম যদি না আপনি আমার ক্ষতস্থানের পরিচর্যা ও সেবা করতেন।’

‘আমি আপনাকে মেরে ফেলতে এসেছিলাম, কিন্তু আপনি আমার জীবন বাঁচিয়েছেন। এখন যদি আপনি অনুমতি দেন তাহলে আমি আপনার সেবায় নিজেকে আজীবন এবং আমার মৃত্যুর পর আমার ছেলেকে উৎসর্গ করতে চাই।’

এতো সহজে শত্রুর সঙ্গে সমঝোতা করতে পেরে রাজা খুশি হলেন। তার সঙ্গে বন্ধুত্ব করে ক্ষমা করে দিলেন, নিজের ব্যক্তিগত চিকিৎসক দিয়ে তার চিকিৎসা করানোর আশ্বাস দিলেন। আর তার ভাইয়ের বাজেয়াপ্ত সব সম্পদ ও জমি ফেরত দেবার প্রতিজ্ঞা করলেন।

নতুন বন্ধুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রাজা বারান্দায় গিয়ে চারদিকে তাকিয়ে সন্ন্যাসীকে খুঁজলেন। ফিরে যাবার আগে শেষবারের মতো তিনি সন্ন্যাসীর কাছে তার উত্তর প্রার্থনা করবেন। সন্ন্যাসী তখন  ঘরের বাইরে আগের দিন খুঁড়ে রাখা ক্ষেতে হাঁটুগেড়ে বীজ বপন করছিলো।

রাজা সন্ন্যাসীর কাছে গিয়ে বললেন, ‘হে জ্ঞানী, আমি শেষবারের মতো আপনার কাছে আমার প্রশ্নগুলোর উত্তর প্রার্থনা করছি।’ ‘তুমি তো নিজেই নিজের প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিয়েছো’ কঙ্কালসার পায়ের উপর ভর দিয়ে বসে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা রাজার মুখের দিকে চেয়ে উত্তর দিলো সন্ন্যাসী।

‘কী বলছেন! কীভাবে দিলাম!’ বিস্মিত হলেন রাজা।

‘তুমি খেয়াল করোনি?’ উত্তর দিলো সন্ন্যাসী- ‘গতকাল তুমি যদি আমাকে দুর্বল দেখে দয়া করে সাহায্য না করতে এবং অপেক্ষা না করে ফিরে যেতে তাহলে ওই দাড়িওয়ালা লোকটা তোমাকে ফিরতি পথেই হত্যা করতো, আর তুমি তোমার ভুল বুঝতে পারার জন্য বেঁচেই থাকতে পারতে না। সুতরাং তোমার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় ছিলো যখন তুমি মাটি খুঁড়ছিলে, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ ছিলাম আমি নিজে এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিলো আমাকে সহযোগিতা করা।’

‘আবার পরের ঘটনাটাও একবার ভাবো। দাড়িওয়ালা আহত লোকটা যখন আসলো তখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে তুমি তার পরিচর্যা করেছো, তুমি যদি তার জখম ব্যান্ডেজ না করতে, তার সঙ্গে তোমার বন্ধুত্ব হতো না। তাই তখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিলো তার সঙ্গে তুমি যা করেছো তা, এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হলো ওই ব্যক্তি।

মনে রাখতে হবে, ‘সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় হলো- এটা, যা বর্তমান। বর্তমানই হলো একমাত্র সময় যখন তোমার হাতে ক্ষমতা আছে ভালো ভালো কাজ করার।’

‘সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ হলো বর্তমানে তুমি যার সঙ্গে আছো। কেউই বলতে পারে না ভবিষ্যতে আমরা আবার তার সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পাবো কিনা। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো বর্তমানে তুমি যে মানুষের সঙ্গে আছো, তার ভালো করা। কারণ মানুষকে যে পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছে তার একটা কারণ- মানবকল্যাণ।’

অনুবাদকের কথা: ১৮৮৫ সালে রাশ্যান লেখক লিও তলস্তয়ের ‘মানুষ কেন বেঁচে থাকে ও অন্যান্য গল্প’ শিরোনামে একটি বই প্রকাশিত হয়। এ বইয়ের একটি গল্প ‘থ্রি কুয়েশন্স’ বা ‘তিনটি প্রশ্ন’। এটি একটি প্যারাবল বা নীতিকথামূলক গল্প। প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে গত একশ তেত্রিশ ধরে গল্পটি বহু ভাষা ও উপভাষায় অনুবাদিত হয়েছে।