দেশলাই বিক্রেতা ছোট্ট মেয়েটি

খুব ঠাণ্ডা পড়েছে, সেই সঙ্গে শুরু হয়েছে তুষারপাত। বছরের শেষ সন্ধ্যাটি ঢেকে গেলো অন্ধকারে। এ অন্ধকার আর ঠাণ্ডায় একটি গরিব মেয়ে দেশলাই নিয়ে রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে, দেশলাই বিক্রি করাই তার পেশা।

মাজহার সরকারবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 April 2018, 10:34 AM
Updated : 20 April 2018, 10:34 AM

এই কনকনে ঠাণ্ডায় মেয়েটির গায়ে কোনো মোটা কাপড় নেই, খালি পায়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে আর দেশলাই বিক্রির চেষ্টা করছে। তবে বাড়ি থেকে বেরোনোর আগে তার পায়ে এক জোড়া পুরনো জুতো ছিলো। ওগুলো ছিলো তার মায়ের এবং আকারে অনেকটাই বড়। মেয়েটি যখন রাস্তা পার হচ্ছিলো তখন একটা ঘোড়ার গাড়ি দ্রুত ছুটে যাচ্ছিলো। সে ভিড়ে ছুটতে গিয়ে জুতো দুটো পা থেকে খুলে পড়ে যায়।

একটা জুতো সে খুঁজেই পেলো না। আর আরেকটা জুতো এক দুষ্ট ছেলে কুড়িয়ে নিয়ে দৌড়ে পালালো আর বলে গেলো যখন সে বিয়ে করবে আর ছেলেপুলে হবে তখন সে এ জুতোটা দিয়ে বাচ্চার দোলনা বানাবে।

পাতলা ফিনফিনে পুরনো জামায় ছোট্ট মেয়েটি ঠাণ্ডায় নীল আর লাল হয়ে যাওয়া পা নিয়ে হাঁটতে লাগলো। তার জামার পকেটে একগাদা দেশলাইয়ের কাঠি আর হাতের মুঠোতেও একগুচ্ছ দেশলাই। আজ সারাদিন তার কোনো দেশলাই বিক্রি হয়নি, কেউ তাকে দয়া করে একটা পয়সা পর্যন্ত দেয়নি।

ছোট্ট মেয়েটি দেখলো আশপাশের বাড়িতে জানলায় জানলায় আলো জ্বলছে। আগুনে সেকা হাঁসের সুস্বাদু গন্ধ ভেসে আসছে বাতাসে। তার মনে পড়ে গেলো আজ নতুন বর্ষের আগের দিন। সে দুটো বাড়ির মাঝখানে কোনরকমে আশ্রয় নিলো।

বাড়িতে ফিরে যেতে আজ তার খুব ভয় করছে, একটাও দেশলাই বিক্রি হয়নি। মেয়েটির ভাবলো তার বাবা অবশ্যই তাকে খুব মারবে। আর তাদের বাড়িতেও ভীষণ ঠাণ্ডা, মাথার ওপর শুধু ছাদ ছাড়া ঠাণ্ডা থেকে রক্ষা পাওয়ার আর কিছুই নেই ।

মেয়েটির ছোট ছোট হাত দুটো ঠাণ্ডায় একদম জমে গেছে। সে পকেট থেকে একটি দেশলাই বের করে দেয়ালে ঘষে আলো জ্বালালো। মুহূর্তের মধ্যে ওই আলোটুকুই তার মুখে হাসি ফিরিয়ে আনলো। সে তার ঠাণ্ডা পা দুটো আলোর পাশে ছড়িয়ে দিলো গরম করতে। কিন্তু মুহূর্তেই দেশলাই নিভে গেলো।

সে আরেকটি দেশলাই জ্বাললো। পাশের দেওয়ালটিতে তুষার পড়ে স্বচ্ছ কাচের মতো হয়ে আছে। আর তারই মধ্য দিয়ে সে আয়নার মতো দেখলো ঘরের ভেতর টেবিলে হাঁসের রোস্ট, এর ভেতর আপেল ও শুকনো কিসমিস। মুহূর্তেই আলো নিভে গেলো আর তার সামনে শুধু পড়ে রইল ঠাণ্ডা ও স্যাঁতস্যাঁতে দেওয়াল।

সে আবারও একটি দেশলাই জ্বালালো। তার মনে হলো সে যেন বড়দিনের খুব সুন্দর একটা গাছের নিচে বসে আছে। গাছে কতো সুন্দর আলোকোজ্জ্বল সাজ। মেয়েটি হাত বাড়ালো কিন্তু দেশলাই নিভে গেলো।

বড়দিনের আলোগুলো অনেক উঁচুতে উঠে গিয়ে তারার মতো জ্বলজ্বল করতে করতে তার দিকে তাকালো। সে দেখলো আকাশ থেকে একটা তারা খসে পড়ছে। তার মনে পড়লো তার দাদীমা বলেছিলেন যে তারা খসে পড়া মানে কারো আত্মা সৃষ্টিকর্তার কাছে চলে যাচ্ছে।

মেয়েটি আবার একটি দেশলাই দেয়ালে ঘষে আগুন জ্বালালো। আর সে তার মৃত দাদীমাকে সামনে পরিষ্কার দেখতে পেলো, দাদীমা যেন তাকে সেই ভালবাসাভরা হাত দুটো সামনে মেলে তাকে ডাকছে।

মেয়েটি কেঁদে বলে উঠলো, “দাদীমা, তুমি আমাকে সঙ্গে নিয়ে যাও। আমি জানি আলো নিভে গেলেই তোমাকে আর দেখতে পাবো না।” এই বলে মেয়েটি তার সব দেশলাই জ্বালিয়ে দিলো। সে দেখলো তার দাদীমা যেন আরও উজ্জ্বল ও বড় হয়ে উঠলো। তিনি তার নাতনিকে কোলে তুলে নিলেন, তারপর তারা দুজন ধীরে ধীরে চিরদিনের জন্য আকাশে মিলিয়ে গেলো।

ওখানে শুধু আলো আর আনন্দ। শীত, ক্ষুধা ও যন্ত্রণা এসব কিচ্ছু নেই। কারণ তারা এখন সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে আছে।

পরদিন ভোরবেলা সবাই দেখলো দেওয়ালে ঠেসান দিয়ে মেয়েটি পড়ে আছে। বিমর্ষ দুটি গাল কিন্তু মুখে হাসি। তার পুরনো বছরের শেষ দিনের তুষারে জমে যাওয়া শরীরে নতুন বছরের সূর্যের আলো এসে পড়েছে।

কেউ বলে উঠলো, “মেয়েটি এই শীতে একটু উষ্ণতা চেয়েছিলো।” কেউ জানলো না কতো সুন্দর সুন্দর দৃশ্য সে দেখতে পেয়েছে আর তার দাদীমার সঙ্গে সেই আলোর সাম্রাজ্যে পৌঁছে নতুন বছরের প্রথম দিনটাকে কতো সুখেই না উদযাপন করছে।

অনুবাদকের কথা: ডেনমার্কের জগৎবিখ্যাত কবি ও লেখক হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসন (১৮০৫-১৮৭৫)। ১৮৪৫ সালে ড্যানিশ ভাষায় এ বইটি প্রথম প্রকাশিত হয়। সারা পৃথিবীতে বহু ভাষায় অনূদিত হয়েছে বিখ্যাত এ গল্পটি। অ্যান্ডারসন বিখ্যাত দু’টি কারণে, তার রূপকথা, আরেকটি তার ভ্রমণ ডায়েরি।