তিকি লিকির গল্প

ইঁদুর মা আর ইঁদুর বাবার দুই ছেলে। তিকি আর লিকি। তিকি বড়, লিকি ছোট। তারা থাকে বিরাট এক চারতলা বাড়ির মাটির নিচ দিয়ে যে বিরাট ড্রেনটি চলে গেছে, তার আশপাশে। আরো অনেক অনেক ইঁদুর থাকে সেখানে। ঢাঙা, লম্বা, মোটা, চিকন, রোগা, পটকা সে বহু ধরনের ইঁদুর। ছোটখাট এক রাজ্য বলা যায়।

মঈনুল আহসান সাবেরবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 April 2018, 01:55 PM
Updated : 4 April 2018, 01:55 PM

সব ইঁদুর মিলে সেই চারতলা বাড়ির ভাড়ার ঘরে ঢোকার কয়েকটা পথ তৈরি করে নিয়েছে। খাবার-দাবার জোগাড় করা নিয়ে তাদের খুব একটা চিন্তা নেই। তেমন দরকার হলে ভাড়ার ঘর ছাড়িয়ে খাবারঘর কিংবা রান্নাঘরে যাওয়া যাবে সে পথও তাদের জানা আছে।

তিকি লিকির বাবা খুবই ভাল। নিতান্তই নিরীহ, গোবেচারা। সারাদিন বইপত্রের মধ্যে ডুবে থাকেন। আগে ছোটখাট একটা স্কুল ছিল ইঁদুর রাজ্যে। তিনি ওখানে পড়াতেন। ছাত্ররা খুশি হয়ে যা দিত, তাতেই তাদের সংসারটা চলে যেত। কিন্তু ছাত্ররা সব এমন বখাটে হয়ে গেল যে, হঠাৎ করে স্কুলটা উঠেই গেল। ওসব লেখাপড়া করে নাকি কিছুই হয় না!

তিকি লিকির বাবা আর কী করেন, রোজগার তার বন্ধ হলো। তবে আশার কথা, দু’এক ঘর ভদ্রলোক এখনো আছে। সেসব জায়গায় টিউশনি করে কিছু পান। কিন্তু তাতে কি আর সংসার চলে? খুব দরকার পড়লে এখন মাঝে মাঝে ভাড়ার ঘরের ফাঁকফোকড় গলে এটা ওটা নিয়ে আসেন। উপায় কি, বেঁচে থাকতে হবে তো!

তিকি লিকি দুজনের চেহারা খুব সুন্দর। অল্প অল্প গোঁফ উঠেছে। ছোট ছোট দাঁত, টানা টানা চোখ। দু’ভাইয়ের মধ্যে ওদের খুব ভাব। অবসর সময়ে ওরা আদব-কায়দা আর লেখাপড়া শেখে। ছেলেদের খুব ভালবাসলে কী হবে, একটা ব্যাপারে ওদের বাবা-মা খুব কড়া। উঁহু, পড়াশোনার ব্যাপারে কোন ফাঁকি দেওয়া চলবে না। সময় হলেই বাবা গম্ভীর গলায় ডাক দেবেন- তিকি লিকি!

আর তিকি লিকিও তখন হাতের সব কাজ ফেলে বইখাতা হাতে সুড়সুড় করে বাবার সামনে গিয়ে বসবে। কোনদিনও এর হেরফের হয়নি।

দু’ভাই অবশ্য খেলাধুলো আর দৌড়-ঝাঁপেও ভাল। গতবার স্পোর্টসে তিকি এক টুকরো লাল সার্টিনের কাপড় আর লিকি দু’টুকরো দারুচিনি পেয়েছিল। ওরা অবশ্য এসব দৌড়ঝাঁপের চেয়ে লেখাপড়াই বেশি পছন্দ করে। সেই ছোট্টবেলা থেকে কত কি শিখেছে তারা। প্রথমে তারা শিখেছে আদব-কায়দা আর ভদ্রতা। গুরুজনদের দেখলে সালাম দিতে হয়, বড়দের সাথে বিনয় নিয়ে কথা বলতে হয়, তাদের সব কথা শুনতে হয়, খুব জোরে কথা বলতে হয়না, খারাপ কথা বলতে নেই, মারামারি করতে নেই, সুযোগ পেলে অন্যের উপকার করা উচিত।

তিকি লিকির বাবা ওদের বলতেন- শোনো, তোমরা যদি চরিত্রবান না হও, যদি আদব-কায়দা না শেখো, অন্যের উপকার না করো, তবে তোমাদের জীবনের কোন মূল্য নেই। তিকি লিকিও বাবার সব কথা শুনতো, মানতো। সকালবেলা উঠে ওরা নীতিকথা আর বিভিন্ন উপদেশ সব চেঁচিয়ে  চেঁচিয়ে পড়তো। ওরা রাস্তায় মাথা নিচু করে হাঁটতো, মুরুব্বীদের সালাম দিত আর বন্ধুদের ঝগড়া হলে ওরাই মিটিয়ে দিত।

পাড়ার বখাটে ছেলেগুলো অবশ্য ওদের ক্ষ্যাপাতো- ওরা নাকি মিনমিনে, ন্যাকা, কোন কাজের না। ওরা অবশ্য রাগ করতো না। আসলে রাগ যে কী জিনিস সেটাইতে ওরা ভুলে গিয়েছিল। ওদের বাবা-মার খুব গর্ব ছিল ওদের নিয়ে। আর গর্ব হবে না কেন, বল? পাড়ার সবাই তো ওদের প্রশংসাই কতো সব সময়। আর ওরা তো কোনদিন মারামারি করেনি, কাউকে খারাপ কথা বলেনি। কাজেই মুরুব্বীরা কখনো ওদের খারাপ বলেননি। সবাই শুধু বলতো- আহা, এমন শান্ত-ভদ্র ছেলে, এমন সাধাসিধে সরল ছেলে, এরা জীবনে উন্নতি না করে যাবে না।

কিন্তু শুধু কি আদব কায়দা? তিকি লিকি আদব-কায়দা ছাড়া আরো কতো যে লেখাপড়া শিখেছিল। ওদের কথা শুনে পাড়ার ছেলেরা তো বটেই, বড়রা পর্যন্ত অবাক হয়ে যেতো। ইংরেজি, বাংলা, ব্যাকরণ তো শিখেছিলই। তাছাড়া ইঁদুরদের ইতিহাস, ওদের শহরের ভূগোল, রাজনীতি, পৌরনীতি, অর্থনীতি সবকিছু শিখে ফেলেছিল। তিকি আবার কবিতাও লিখতো। পাড়ার ফাংশনে নিজের লেখা কবিতা আবৃত্তি করেছিল- ‘যাচ্ছি আমি চাঁদে, ভয়ে দেখো মা কাঁদে’।

লিকি কবিতা লিখতে না পারলেও ভারি সুন্দর গান গায়। তিকি লিকির বাবা ওদের একদিন পরীক্ষা নিলেন। বাড়ির সবচেয়ে মোটা বইটাও ওরা যেদিন পড়ে শেষ করলো, তার দু’দিন পর পরীক্ষা দিয়ে ওরা খুব ভালো রেজাল্ট করলো। মা বললেন- বাছারা আমার, সোনামানিক, এই শুভদিনে একটু ভালো খাওয়া-দাওয়া হোক। বাসায় কিছু খাবার-দাবার তো ছিলই, ভাড়ার ঘর থেকেও কিছু নিয়ে আসা হলো।

আর সেদিন সন্ধ্যায় এক মজার ব্যাপার ঘটে গেলো। তখনো রান্নাবান্না সব শেষ হয়নি, ঠিক এ সময় হঠাৎ তিকি লিকির দাদু এসে হাজির। তিকি লিকি খুব ছোট্ট বেলায় দাদুকে দেখেছিল একবার। কিন্তু এতদিন পর দেখেও ওরা দাদুকে চিনতে পারে। তিকি লিকির দাদুর স্বভাব চরিত্র অদ্ভুত। বাড়ি থাকেন না। সেই ছোটবেলা থেকে এ রকম। চার-পাঁচ বছর পর পর বাড়ি ফিরে আসেন। দু’দিন থেকে আবার বেরিয়ে পড়েন।

ওদের বাড়িতে একটা হুল্লোড় পড়ে গেল। ঘরে ঢুকতেই তিকি লিকির দাদু বললেন- বেশ সুন্দর গন্ধ পাচ্ছি হে, অনেক দিন পর এমন ভালো খাবার খাব মনে হচ্ছে। তিকি লিকির বাবা তখন সব খুলে বললেন। শুনে দাদু ওদের মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে বললেন- আচ্ছা, তা দাদু আমি একটু জিরিয়ে নেই, তারপর দেখবো তোরা কী কী শিখেছিস।

তিকি লিকিকে বলতে গেলে আরেকটা পরীক্ষা দিতে হলো। দাদু রাজ্যের প্রশ্ন করলেন। তিকি লিকি কিন্তু একটারও ভুল উত্তর দিলো না। দাদু খুব খুশি হলে বললেন- তিকি লিকি, তোরা দেখি অনেক কিছু শিখে ফেলেছিস। তা বাছারা, মুখ অমন নিচু করে অত মিনমিনে গলায় কথা বলো কেন? এত লাজুক আর মিনমিনে হলে এই দুনিয়ায় কি চলে রে?

এসব কথা তিকি লিকি কোনদিন শোনেনি। তাই ওরা একটু অবাক হলো। দাদু আবার বললেন- শোন, কথা বলবে ঘাড় সোজা করে, অভদ্রতা করতে বলছিনে, কিন্তু অমন মাথা নিচু করে থাকলে কি চলে, আর গলার আওয়াজ হবে গম্ভীর, অমন আধো আধো বোল আমার বাপু ভালো লাগে না বলে দিচ্ছি। তা, আমি আছি দিন দুই, এরমধ্যে আমি ঠিক ধরে ফেলবো, লেখাপড়া আর ওসব আদব-কায়দা ছাড়া তোরা কী কী শিখেছিস আর কী কী শিখিসনি।

হ্যাঁ, দুনিয়ায় অনেক কিছু শেখার আছে, জানো তো?

তিকি লিকি মাথা নাড়লো।

দাদু বললেন- বেশ।

খেতে বসে দাদু একবার চারদিকে তাকালেন। তার সামনে তিকি লিকি, দু’পাশে ওদের বাবা-মা। দাদু বললেন- এখানে খাবার দাবার কেমন পাওয়া যাচ্ছে? বাবা মাথা নাড়লেন- না, দিনকাল ভালো না, বেশ অনেক দিন হলো সবার খুব টানাটানি যাচ্ছে, পাড়া প্রতিবেশীদের মধ্যেও আর আগের মতো মিল নেই, সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত।

অবস্থা তাহলে খারাপ বলেই মনে হচ্ছে, বলতে বলতে দাদু তিকি লিকির দিকে তাকালেন। বাবা মাথা নাড়লেন- হ্যাঁ, দিনকাল ভালো না। দাদু তখন হঠাৎ এমন কাণ্ড করলেন যে, সবাই অবাক হয়ে গেলো। নিজের খাবারটুকু গপ করে খেয়ে তিনি তিকি লিকির প্লেট থেকেও সব খাবার তুলে নিলেন। তারপর ওদের দিকে তাকিয়ে খুব আয়েশ করে সেই খাবার অল্প অল্প করে খেলেন।

তিকি লিকি তো ভীষণ অবাক। বোকার মতো দাদুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো। দাদু সবটা খেতে পারলেন না, বাকুটুকু মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিলেন। তিকি লিকির বাবা-মাও খুব অবাক। কিন্তু কেউ কিছু বললো না দেখে দাদু খুব গম্ভীর হয়ে ‘কাল সকালে দেখা হবে’ বলে উঠে চলে গেলেন। তিকি বললো- মা, দাদু অমন করলেন কেন? মা তাড়াতাড়ি ওদের নতুন করে খাবার এনে দিয়ে বললেন- ছি তিকি, জিজ্ঞেস করতে নেই, বুড়ো মানুষ তোমার দাদু, খেয়াল ছিলনা বোধ হয়।

পরদনি সকালে নাশতার সময় আবার সেই কাণ্ড। দাদু খেতে বসেই তিকি লিকির প্লেট থেকে সব খাবার তুলে নিলেন। এবারও বেশ আয়েম করে খেতে খেতে ওদের দু’জনকে বললেন- এটা তোদের ভাগ তাহলে তিকি লিকি? কিন্তু দেখ, তোমাদের ভাগ আমি খেয়ে ফেলছি। তিকি লিকি শুধু কাঁদ কাঁদ চোখে গোবেচারার মতো চেয়ে থাকলো।

তিকি লিকির বাবা এবার একটু ইতস্তত করে বললেন- বাবা, আপনি কী করছেন, এটা যে ওদের ভাগ। দাদু তখন খুব গভীর হয়ে বললেন- কিন্তু কথাটা তো ওরা বললো না, তুমিতো ওদের অনেককিছু শিখিয়েছো। কিন্তু এটা যে ওদের ভাগ এই সামান্য কথাটা বলা শেখাওনি কেন? ওদের ভাগটা কেমন দু’দুবার কেড়ে নিলাম, একবারও প্রতিবাদ করলো না, কেমন হাদারামের মতো তাকিয়ে আছে দেখো, আমি তো খাচ্ছিও না, এতো খাবারের প্রয়োজন নেই আমার, সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে নষ্ট করেছি।

তিকি লিকির বাবা বললেন- কিন্তু আপনাকে ওভাবে বললে সেটা ওদের অভদ্রতা হতো না? খিকখিক করে দাদু হেসে ফেললেন, বললেন- খুব বললে হে, আমার দরকার নেই, তবু আমি ওদের ভাগটা কেড়ে নিলাম, সেটার প্রতিবাদ কেন ওরা করবে না? আমি অন্যায় করছি তাও দেখ, কি চুপচাপ ওরা। বলি অন্যায়ের প্রতিবাদ না করাটা কি আরেকটা অন্যায় নয়? আমি বড় হয়েছি তো কী হয়েছে, আমার কাছ থেকে উল্টো কেড়ে নিলো না কেন? নাহ, তুমি সব শিক্ষা দাওনি ছেলেদের, এখনো ভাগ-বাটোয়ারা শিখলো না।

খাবার টেবিলেই ছোটখাটো একটা ঝগড়ার মতো হয়ে গেল। তিকি লিকির বাবার সাথে তিকি লিকির দাদুর। দুদু মাঝে মাঝে খুব রেগে ওঠেন, বলেন- আরে দেখো হে, তুমি একটু চেষ্টা করো, আমার নিজেরটা থাকা সত্ত্বেও আমি ওদের মুখের খাবার কেড়ে নিলাম, তাও কিছু বলবে না, এরকম নাতি বাপু আমি চাইনি। কিন্তু লিকির বাবা এসব কথা পছন্দ নয়। না হয় খেয়েছে কেড়ে, তাই বলে এই সাধারণ ব্যাপার নিয়ে এতো হৈ চৈ করার কী দরকার। তিকি লিকিকে আবার নতুন করে খাবার এনে দিলেই তো ব্যাপারটা মিটে যায়।

দাদু তখন আরো রেগে গেলেন- দেখো, একবার যে কেড়ে নিয়েছে, সে সুযোগ পেলে বারবারই নেবে, এটা কোন সমাধান হলো না। তুমি তো কোনদিনই আমার কোন কথা শুনলে না। তাইতো আমি বাড়ি থাকি না। যাচ্ছি, এক্ষুনি আবার যাচ্ছি। এবার ভেবেছিলাম, দিন দুই থেকে যাবো, তা আর হলো না। তিকি লিকির বাবা-মা খুব করে বললেন আরো ক’টা দিন থেকে যাওয়ার কথা। কিন্তু দাদু ব্যাগ গুছিয়ে নিলেন। দরজার কাছে গিয়ে তিকি লিকির দিকে ফিরে বললেন- চললাম দাদুরা, আমি যা বলে গেলাম, খেয়াল রেখো, কাজে দেবে।

দাদুর কথাগুলো তিকি লিকির কাছে খুব নতুন ঠেকলো। এ ধরনের কথা তারা কখখনো শোনেনি। বাবাতো সব সময় এর উল্টোটাই বলেন। দাদুর কথাগুলোর কী যে অর্থ! কিন্তু কী যে বলেন দাদু, উল্টো কেড়ে নিতে, ধ্যাৎ, তিকি লিকি তা কখনো পারবে না। তাই কি কখনো হয়, যে মজার কথা বলে গেলেন দাদু। ওরা প্রথম দু’তিন দিন খুব ভাবলো। কিন্তু শেষে পড়াশোনা নিয়ে এতো ব্যস্ত হয়ে পড়লো যে, দাদুর কথাগুলো একটু একটু করে ভুলে গেল। বাবা ওদের জন্য আলমারি থেকে আরো নতুন নতুন বই বের করে দিলেন। অবশ্য দাদুর কথাগুলো যে একদম মনে পড়তো না, তা নয়। কিন্তু পড়াশোনার এতো চাপ, খুব একটা ভেবে দেখার সময় ওরা পেতনা। আর বাবাকে কোনদিন জিজ্ঞেস করে দেখা হয়নি। তাছাড়া, মুরুব্বীদের এসব জিজ্ঞেস না করাই ভালো, তিকি লিকি ভাবলো।

তারপর আরো অনেক দিন চলে গেছে। তিকি লিকি অনেক লেখাপড়া শিখেছে। ওরা ইঁদুরদের জন্ম-কাহিনীর ওপর পড়াশোনা করছিল। এমন সময় ওদের শহরে একটা অঘটন ঘটে গেলো। কোত্থেকে এতো পানি এলো ইঁদুররা কেউ বোঝে না, কিন্তু পানির স্রোত সব ইঁদুরের ঘরে ঢুকে সব খাবার দাবার ভাসিয়ে নিয়ে গেলো। ইঁদুররা গর্তের মধ্যে ঘাপটি মেরে কোনমতে প্রাণ বাঁচালো বটে, কিন্তু পানি যখন নেমে গেল, তখন কারো ঘরে একফোটাও খাবার নেই। সবার খুব অসুবিধা। না খেয়ে থাকতে হয়। তখন সবাই দলবেঁধে ভাড়ার ঘরে ছুটলো।

তিকি লিকির বাবাও গিয়েছিলেন সবার সাথে। কিন্তু সবাই কিছু কিছু খাবার আনতে পারলেও তিকি লিকির বাবা ফিরে এলেন খালি হাতে। অত ভিড় আর ঠেলাঠেলির মধ্যে তিনি ভাড়ার ঘরে ঢুকতেই পারেননি। পাড়ার সব বাসায় একবেলা রান্না হলো, কিন্তু তিকি লিকিদের বাসায় দু’বেলাই চুলো বন্ধ। খুব ক্ষিদে পেলেও তিকি লিকিতো খুব ভদ্র। কোন সময় বাবা-মাকে কোন ব্যাপারে বিরক্ত করে না। তাই পেট চেপে ধরে ওরা তবু হাসি হাসি মুখে বসে থাকলো।

তার পরদিনও কিছুই জোগাড় হলো না। আজ তিকি লিকিও বেরিয়েছিল। কিন্তু হৈচৈ, টানাটানি, ধাক্কাধাক্কি, জোরাজুরি ওরা মোটেই করতে পারে না। সবাই ওদের সরিয়ে ঘরে ঢুকে যায়। ওরা ঠেলাঠেলিতে বারবার শুধু পিছিয়ে আসে। এভাবে পরপর দু’দিন ওরা ঢুকতে না পেরে ভাড়ার ঘরের পাশ থেকে খালি হাতে ফিরে এলো।

সন্ধের সময় ওরা সবাই গালে হাত দিয়ে চুপচাপ বসে আচে, হঠাৎ দরজার কড়া নড়ে ওঠে। এমন সময় কে এলো? তিকি লিকির বাবা দরজা খুলতেই ঘরে ঢুকলো পাড়ার সবচেয়ে ধাড়ি ইঁদুর। নাম গোগো। খুব লম্বা চওড়া শরীর গোগোর। গোগো একগাল হেসে বললো- শুনলাম, আপনারা না খেয়ে আছেন, ভাড়ার ঘরে ঢোকার রাস্তাগুলোও বাড়ির মানুষরা বন্ধ করে দিয়েছে, তবে আমি একটা নতুন রাস্তা বের করেছি, হে হে, একটা কাজ করলে হতো না? কী কাজ? তিকি লিকিরা সবাই মুখ তুলে তাকালো। গোগো বললো- আমার একার পক্ষে তো সম্ভব না, তিকি লিকি যদি আমার সাথে যেতো, তবে সহজেই বেশ কিছু খাবার জোগাড় করে আনতে পারতাম, তারপর ভাগাভাগি করে নিতাম।

গোগো মোটেই ভালো ইঁদুর নয়। পাড়ায় ওর অনেক বদনাম। কিন্তু না খেয়ে আর ক’দিন থাকবেন, তাই তিকি লিকির বাবা রাজি হয়ে গেলেন। গোগোর সাথে তিকি লিকি আর ওদের বাবাও গেলেন। বাবা ফোঁকড়ের পাশে পাহারায় থাকলেন আর ওরা তিনজন ভেতরে গেলো। অল্প সময়ের মধ্যে ওরা বহু খাবার জোগাড় করে ফেললো। সেগুলো এক বস্তায় বেঁধে ওরা ফিরে চললো। তিকি লিকি আর ওদের বাবা খুব খুশি। অনেকদিন পর পেটপুরে খাওয়া যাবে। গোগোর বাড়ির কাছে ওরা সবাই এলে গোগো বললো- খুব খাটুনি গেলো, এখন একগ্লাস করে শরবত খাওয়া যাক। গোগো ওদের এত উপকার করলো, তাই ওরা না বললো না। গোগো খুব সুন্দর করে শরবত বানিয়ে খাওয়ালো। গোগো বললো- এখন অনেক রাত হয়ে গেছে, আর আজকাল গুণ্ডা-বদমায়েশদেরও খুব উৎপাত। আপনারা বরং আজকের রাতের জন্য অল্পকিছু খাবার নিয়ে যান, কাল সকালে এসে বাকিটুকু নিয়ে যাবেন।

তিকি লিকিরা ভেবে দেখলো, গোগো ঠিকই বলছে। তাই ওরা অল্পকিছু খাবার নিয়ে গোগোকে শুভরাত্রি জানিয়ে বাড়ি ফিরে এলো। কিন্তু গোগো যে কতো খারাপ তাতো ওরা জানতো না। পরদিন সকালে ওরা যখন ওদের বাকি অংশটুকু আনতে গেল, তখন গোগো জানালায় বসে ফাটা গলায় গান গাচ্ছিলো। তিকি-লিকির বাবা শুভ প্রভাত জানিয়ে বললেন- গোগো, আমরা আমাদের ভাগ নিতে এসেছি। গোগো তো অবাক, কী বললেন, আপনাদের ভাগ! কীসের ভাগ? এ্যাঁ?

বাবা তাড়াতাড়ি মনে করিয়ে দিলেন- ঐ যে, কালরাতে ভাড়ার ঘর থেকে আনলাম। গোগো যেন আকাশ থেকে পড়লো, ভাড়ার ঘর থেকে আবার কখন কী আনলাম? সকালবেলা উঠেই ইয়ার্কি মারতে এসেছেন? জানেন না বুঝি, মানুষরা ভাড়ার ঘরে দুটো বেড়াল ছেড়েছে, আমি বাপু ওদিক আর মাড়াই না। আর আপনি কিনা সকালে উঠেই মিথ্যে কথা বলে আমার কাছ থেকে খাবার-দাবার হাতিয়ে নিতে চাচ্ছেন!

তিকি লিকি আর ওদের বাবা গোগোকে কতো করে বোঝালেন, কিন্তু গোগোর ঐ এক কথা। সে নাকি কিছু জানে না। কালরাতে সে নাকি কোথাও যায়নি। রাগে-দুঃখে ওদের চোখে পানি এলো। বাবা বললেন- গোগো, তুমি কিন্তু খারাপ কাজ করছে, তুমি কিন্তু কথা দিয়েছিলে। গোগো খ্যাক খ্যাক করে হেসে বললো- বলেছিলাম নাকি, যান মিথ্যে কথা বলবেন না। পারেন তো প্রমাণ করেন, মামলা করেন। মামলা করার পয়সা আছে তো? বলে গোগোর সেকি হাসি!

তিকি লিকির বাবা বললেন- ছি, মামলা কেন করবো, তুমি অল্প কিছু খাবার অন্তত আমাদের দাও, আমরা যে না খেয়ে আছি। না খেয়ে আছেন তো আমার কি? গোগো বললো- যান পেটে পাথর বাঁধেন গিয়ে। বলে সে একমুঠো চাল এনে জানালায় বসে চিবুতে লাগলো। তিকি লিকির জিভ দিয়ে জল ঝরছিল। কিন্তু তারা আর কী করবে, ঝগড়া তো করতে পারে না। ওরা তাই গোস্যা হয়ে ফিরে এলো। ওরা ভাবতেই পারেনি গোগো এমন কাজ করবে।

বাসায় এসে ওরা চুপচাপ বসে থাকলো। বিকেলের দিকে আবার একবার গেলো তারা গোগোর বাসায়। রাতেও একবার গেলো। কিন্তু গোগোর ঐ এক কথা। শেষে তো ধমকই দিয়ে বসলো- যাও যাও, ভাল চাওতো ফ্যাচ ফ্যাচ কোরনা, তোমাদের সাথে গাল-গল্প করার সময় নেই আমার। ওরা পরদিন পাড়া প্রতিবেশীদের বাসায় গেলো। কিন্তু সবাই শুধু সমবেদনাই জানালো। গোগোকে যে সবাই ভীষণ ভয় পায়। সবাই শুধু বললো- কী আর করবেন, জানেনই তো ও একটু এই রকমই। ওরা ভেবেছিল, সবাই মিলে একটা ব্যবস্থা করে দেবে। কিন্তু কেউ কোন সমাধান দিতে পারলো না। গোগোর কথা শুনে সবাই চুপসে গেল।

এমনি করে দু’দিন গেল। পড়শীরা কিছু খাবার দিলো বলে ওরা বেঁচে থাকলো, কিন্তু গোগোর মনে কোন মায়া-দয়া নেই। তিকি-লিকি বললো- বাবা, আমাদের ভাগ গোগো কেন দেবেনা? বাবা কিছু বলেন না। শেষে এমন হলো যে ওদের ঘরে কোন খাবার নেই, পড়শীরাও তাদের আর কোন খবর নেয়না। শেষে হঠাৎ একদিন বিকেলে তিকি লিকি দু’জন কথা বলতে বলতে দরজা খুলে বেরিয়ে গেল।

বাবা-মা জিজ্ঞেস করার পর্যন্ত সময় পেলোনা ওরা কোথায় যাচ্ছে। কিন্তু কি আশ্চর্য ব্যাপার! আধঘণ্টা পরই তিকি-লিকি দু’জনই দু’কাঁধে দুটো ব্যাগ নিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে ফিরে এলো। ঘরে ঢুকে ওরা ব্যাগ দুটো খোলে। ব্যাগের মধ্যে অনেক খাবার। ওরা প্লেট এনে খাবার তুলে এগিয়ে দেয় বাবা-মাকে। নিজেরাও খায়। বাবা-মা তো অবাক, ওরে, তোরা এ খাবার কোত্থেকে আনলি? গোগোর কাছ থেকে এনেছি। শুনে বাবা-মা আরো অবাক- কি কাণ্ড, ও দিল না তোরা বুঝি চুরি করে আনলি?

চুরি করবো কেন, জোর করেই এনেছি। দু’ভাই গম্ভীর হয়ে জবাব দেয়। জোর করে এনেছিস? তো কি, আমাদের ভাগ যখন দেবেনা, তখন জোর করে আনবো না কেন? মা খুব অবাক হয়ে বললেন- ওরে, ও যে একটা ডাকাত, তোরা পারলি ওর সাথে?

তিকি লিকি খুব আস্তে বললো- পারবোনা কেন মা, আমরা যে আমাদের ভাগ আনতে গিয়েছিলাম। লিকি খুকধখুক করে হাসলো- জানো মা, তিকি এমন একটা ঘুষি মেরেছে গোগোর নাকে, গোগোকে পনের দিন নাকে জলপট্টি দিতে হবে। তিকি লিকির বাবা-মা অবাক হয়ে ওদের দেখছিলেন। ওদের অন্যরকম মনে হচ্ছে। খেতে খেতে বাবা বললেন- বাছারা তোরা এতসব কোত্থেকে শিখলি, তোদের আমি তো এসব কোনদিন শেখায়নি? তিকি-লিকি একসাথে বললো- আর কীভাবে শিখবো বলো বাবা, ঠেকে শিখেছি।