সবাই পার্টি উপলক্ষে সাজুগুজু শুরু করে দিলো, যেন নিজেকে সবচেয়ে সুন্দর দেখায়। কুমির পরলো কলার মালা এবং ঠোঁটের কোণে ধরালো একটা প্যারাগুয়ান সিগারেট। কটকটে ব্যাঙ গায়ে জড়ালো মাছের আঁশ, কুনোব্যাঙ গায়ে মাখলো সুগন্ধযুক্ত সুগন্ধি আর গলায় ঝুলালো একটা জোনাকিপোকার হার।
কিন্তু কোন সন্দেহ নেই, সবচেয়ে বেশি সুন্দর লাগছিলো সর্প বালক-বালিকাদের। তারা তাদের গায়ের রঙের সঙ্গে মিল রেখে ভিন্ন ভিন্ন রঙের স্কার্ট পরেছে। তাদের স্কার্টের রঙ হলো লাল, সবুজ, হলুদ আর ধূসর।
পার্টিতে এসে ফ্লেমিংগোরা মন খারাপ করলো। তারা ভাবলো তাদের সুন্দর দেখাচ্ছে না। কেউ তাকাচ্ছে না ওদের দিকে। কারণ তাদের পা খালি, সাদা। তারা ভাবতে পারছিলো না পায়ে আসলে কী পরা যায়! যদিও তাদের একটু আধটুকু বুদ্ধি কিন্তু ছিলো।
একটা ফ্লেমিংগো তখন বললো, আমি জানি আমাদের আসলে কী করতে হবে। আমরা লাল, সাদা ও কালো রঙের মোজা পরবো। তাহলে সর্প বালিকারা আমাদের প্রেমে পড়ে যাবে। অন্য সবাই প্রশংসায় মেতে উঠবে।
এই ভেবে ফ্লেমিংগোরা নদী সাঁতরে ওপার গেলো, বিভিন্ন দোকানে দোকানে জিজ্ঞেস করলো। কিন্তু দোকানিদের উত্তর সবসময় একই ছিল- ‘তুমি কি তোমার সিদ্ধান্ত বদলে ফেলেছো? যে রঙের মোজা তুমি চাচ্ছো সে রকম মোজা কখনো হয় নাকি! না ভাই, আমার কাছে ওসব নেই।’
কিন্তু ফ্লেমিংগোরা হাল না ছেড়ে বাজারের সব দোকানের দরজায় দরজায় জিজ্ঞেস করলো তেমন মোজার কথা। কিন্তু পেলো না, বারবার ব্যর্থ হলো। ওই সময় ‘তুতু’ নামের একটা পাখি নদীতে পা ডুবিয়ে কাদা খাচ্ছিলো। সে দূর থেকে দেখতে পাচ্ছিলো সব কাহিনী ও মনে মনে একটা চালাকির কথা ভাবলো।
কাছে এসে খুব বিনয়ের সঙ্গে সে ফ্লেমিংগোদের বললো, ‘শুভ সন্ধ্যা স্যার। আমি জানি আপনি ঠিক কী খুঁজছেন। আপনি এখানে কোনো দোকানে তেমন মোজা খুঁজে পাবেন না। হয়তো আপনি এগুলো বুয়েনোস আইরেসে খুঁজে পেতে পারেন।’
ফ্লেমিংগো তুতু পাখিকে ধন্যবাদ দিয়ে পেঁচার গুহার দিকে চললো। গিয়ে বললো, ‘শুভ সন্ধ্যা মিসেস পেঁচা। আমরা আপনার কাছে লাল, সাদা ও কালো মোজার খুঁজে এসেছি। আজ সাপেদের নাচের অনুষ্ঠান হচ্ছে। যদি আমরা রঙিন মোজা পরে যেতে পারি তাহলে সাপেরা নিশ্চিত আমাদের প্রেমে পড়ে যাবে।’
‘আপনাদের সেবাই আমার আনন্দ’ এই বলে পেঁচা উড়াল দিলো। কিছুক্ষণের মধ্যে ফিরে এলো, সঙ্গে নিয়ে এলো মোজার মতো দেখতে অনেকগুলো খণ্ড। কিন্তু সেগুলো মোজা ছিলো না, ছিলো তার শিকার করা সাপের পায়ের চামড়া।
সেগুলো ফ্লেমিংগোদের হাতে দিয়ে পেঁচা বললো, ‘শুধু একটা শর্ত। এগুলো পায়ে পরে তোমরা যেমন খুশি তেমন নাচবে। সাবধান, নাচ বন্ধ করবে না। নাচবে আর নাচতেই থাকবে। যেমন পারো যতক্ষণ পারো নেচেই যাবে। যদি তোমরা নাচ বন্ধ করে দাও তাহলে তোমরা খুশি হওয়ার বদলে কাঁদবে।’
কিন্তু নাচ শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ পর কিছু সাপের সন্দেহ হলো। তারা ফ্লেমিংগোদের পায়ের দিকে তাকিয়ে বুঝতে চাইছিলো আসলে তারা মোজা না অন্য কিছু পরে এসেছে। কিন্তু নাচের গতি ধীর থেকে এতোই বেড়ে যাচ্ছিলো যে আসলে পায়ের দিকে তাকিয়ে ঠিক বুঝা যাচ্ছিলো না সেগুলো কী বা কীসের তৈরি। নাচতে নাচতে সবাই পাগল হয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু সাপেদের সন্দেহ গেলো না। তারা কুনোব্যাঙকে অনুরোধ করলো যেন সে তার গলার জোনাকিপোকার আলো দিয়ে দেখে আসলে ফ্লেমিংগোদের পায়ে কী? জোনাকিপোকার হার নিশ্চয়ই কম আলোতে টর্চের কাজ করবে। আর এর মধ্যে নাচতে নাচতে ফ্লেমিংগোরাও ক্লান্ত হয়ে যাবে।
এদিকে নাচের তালে একটা কুমিরের সঙ্গে পা লেগে একটা ফ্লেমিংগো গেলো মাটিতে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে একটা সাপ দৌড়ে এলো আর তার পায়ে জোনাকিপোকার টর্চ ফেললো। কী যেন দেখতে পেয়ে সে এমন চিৎকার জুড়ে দিলো যে সে চিৎকার গিয়ে পৌঁছলো পারানা নদীর ওপার।
এই শুনে, ফ্লেমিংগোরা ভয়ে পালিয়ে যেতে চাচ্ছিলো। কিন্তু কীভাবে যাবে! নেচে নেচে তারা এখন ভীষণ ক্লান্ত। চোখই খুলতে পারছে না। এর মধ্যে সাপেরা এসে তাদের ঘিরে ধরলো, পা কামড়ে দিলো। কামড়ের চোটে সব মোজা গেলো ছিড়ে।
কিন্তু অনেক সাপই ছিলো বিষাক্ত। তাই তারা ভাবলো, কামড়ে বুঝি ফ্লেমিংগোরা মরেই যাবে! কিন্তু না, তারা মরলো না। বরং পাগুলো বিষে আক্রান্ত হয়ে সারা গা গেলো লাল হয়ে। তারপর থেকেই সব ফ্লেমিংগোর গায়ের রঙ লাল।
এটা অনেক অনেক আগের ঘটনা। কিন্তু আজও, ফ্লেমিংগোরা সারাদিন তাদের পা পানিতে ডুবিয়ে রাখে। যদি পানি থেকে পা উঠিয়ে নেয় তাহলে বিষের ব্যথা আবার শুরু হয়। মাছেরা এটা জানে, জানে বলেই তারা কাছে আসে মজা করার জন্য। কিন্তু ফ্লেমিংগোরা তাদের ধরে ধরে খায়।
অনুবাদকের কথা: ওরাসিয়ো কিরোগা (১৮৭৭-১৯৩৭) উরুগুয়ের নাট্যকার, কবি ও ছোটগল্পকার। তার বেশির ভাগ গল্প অরণ্য ও বনের পটভূমিতে লেখা। লেখালেখির মাধ্যমে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন বেঁচে থাকার সুতীব্র লড়াই। তার লেখা ছোটগল্প ‘দ্য ফ্লেমিংগোস স্টকিংস’ থেকে অনুবাদ করা হয়েছে গল্পটি।