রাজস্থানের রূপকথা: ইঁদুর ও চড়ুইয়ের গল্প

অনেক দিন আগে এক ইঁদুর ও চড়ুইয়ের মধ্যে বন্ধুত্ব হয়। চড়ুইটি ছিল ছোট্ট ধূসর রঙের। একদিন সে পাখায় আঘাত পেলো। ভাঙা পাখায় খুব বেশিদূর উড়ে যেতে পারতো না চড়ুইটি।

মিলন আশরাফবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 March 2018, 09:13 AM
Updated : 14 March 2018, 09:13 AM

ইঁদুরটির গায়ের রঙও ছিল ধূসর। দেহের আকার ছিল খুব ছোট। তবে সে ছিল বড় হৃদয়ের অধিকারি। চড়ুইটির কাছে ইঁদুরটি আসতে কোনো ভয় পেত না। কারণ পাখিটি কখনো তাকে ঠোকর কিংবা বিরক্ত করতো না। তাছাড়া পাখিটির এমন আহত অবস্থা দেখে হৃদয় কেঁদে উঠল ইঁদুটির। সে সিদ্ধান্ত নিল চড়ুইটিকে সাহায্য করবে।

এমন একদিন এল অবশেষে। সেদিন চড়ুইটি মাটিতে পড়ে থাকা ময়লা-আবর্জনা ঠুকরিয়ে খাচ্ছিল। এমন সময় ইঁদুরটি তার কাছে গিয়ে বলল, ‘ওহে ছোট্ট গানের পাখি, তুমি আহত হয়েছো জেনে আমার দুঃখ হচ্ছে। আমি কি তোমাকে সাহায্য করতে পারি?’ চড়ুইটি মাথা তুলে ইঁদুরটির দিকে তাকালো। এরকম এক চুলভর্তি লম্বা লেজওয়ালা প্রাণীকে দেখে কিছুটা ভড়কে গেলো সে। এই ধরনের প্রাণীকে সে আগে কখনো দেখেনি।

কিন্তু ইঁদুরটির চোখে দয়া দেখে তার হৃদয় গলে গেল। ইঁদুরটি তার লম্বা চুলভর্তি লেজ দিয়ে ভাঙা পাখাগুলো ঢেকে ওম দিতে লাগল। ক্ষতস্থানে ওম পেয়ে সুস্থ হয়ে উঠল চড়ুইটি। খুব শিগগির পাখিটি উড়তে শুরু করলো।

চড়ুইটি মিষ্টি করে ইঁদুরটিকে ধন্যবাদ দিয়ে বেড়াতে বের হলো। বহুদূর গিয়েও সে কখনো ইঁদুরটিকে ভুললো না। যেখানে যেখানে গেলো, সব জায়গা থেকে কিছু কিছু খাবার নিল ইঁদুরটির জন্য। কৃষকের পাকা সরিষাক্ষেত দেখে সেখানে বসে খেতে লাগলো সে। তার বন্ধুর জন্যও কিছু শস্য সংগ্রহ করছিল।

বন্ধু ইঁদুরটি কৃষকের সরিষাক্ষেতে যাবার বিষয়ে আগেই সাবধান করেছিল। সে বলেছিল, একবার এই কৃষকের ঘরে ঢুকে বেশ মুশকিলে পড়েছিল সে। এমনকি প্রায় মরতে বসেছিল। কিন্তু পাখিটি এই মজাদার খাবারগুলো ইঁদুরের জন্য নিতে আগ্রহী। সেই মুহূর্তে ইঁদুরের সতর্কবার্তা সম্পর্কে কোনো চিন্তা-ভাবনা মাথায় এলো না তার।

এরপর একদিন কৃষক জাল পেতে রাখলো পাখিটিকে ধরার জন্য। এই ফাঁদ বিষয়ে কোনো ধারণা ছিল না চড়ুইটির। সে শস্য সংগ্রহ করার জন্য জমিতে নেমে পড়ল। নেমেই তার পা জালে আটকে গেল। কৃষক তাকে দেখে ফেললো এবং পা দুটি বাঁধল গাছের সঙ্গে। আর কৃষক পাশের সরিষাক্ষেতের নিকট বসে রইল।

বিকেলে ঘরে ফেরার জন্য ছটফট করতে শুরু করলো চড়ুইটি। বাচ্চাদের খাওয়ানোর জন্য চিন্তায় পড়ে গেল। কৃষকের সঙ্গে খুব ভালো আচরণ করেও কোনো উপকার পেল না। কৃষক তাড়াতাড়ি তার কথা বলা বন্ধ করে দিলো। চড়ুইটি হতাশ হয়ে পাশ দিয়ে যাওয়া এক রাখালকে ডাকল। রাখাল গরুর পালসহ তাকে অতিক্রম করছিল তখন।

অনুরোধের সুরে বলল,

‘ও গরুর পাল চরানো রাখাল

দেখো নিয়তির কী বেহাল,

বাসায় আমার পাঁচটি নিষ্পাপ বাচ্চা

বাতাসে পড়ে ভাঙবে হাড় মজ্জা

আগুনে পুড়ে হবে ছারখার

বৃষ্টি হলে ভিজে একাকার

কৃষকের মন সেতো বড় শক্ত

সাহায্য করো তুমি হতে মুক্ত।’

পাখিটির আকুতি দেখে তার প্রতি দয়া হল রাখালের। সে কৃষককে তাকে ছেড়ে দিতে অনুরোধ জানালো। কৃষক তাকে শোনালো-

‘সকাল হতে রাত দিন

শস্য করে চুরি সারাদিন

নিষেধ শোনে না আমার কোনো

ক্ষেতটাকে ভাবে ঘরবাড়ি যেনো

শুনছি না তোমার কোনো কথা আর

মে পর্যন্ত করেছি ব্যবস্থা থাকবার।’

এমনটি শোনার পর রাখালের আর কিছুই বলার থাকে না। সুতরাং সে তার পশুর পাল নিয়ে সামনের দিকে চলে যায়। সে একটি ছাগপালকে অনুসরণ করছিল। বাঁশি বাজিয়েগাইছিল গান। ছাগলের মাথার উপর লাঠি দোলাচ্ছিল।

চড়ুইটি ছাগপালককে দেখে আবারও শুরু করল-

‘ও ছাগপাল চরানো রাখাল

দেখো নিয়তির কী বেহাল,

বাসায় আমার পাঁচটি নিষ্পাপ বাচ্চা

বাতাসে পড়ে ভাঙবে হাড় মজ্জা

আগুনে পুড়ে হবে ছারখার

বৃষ্টি হলে ভিজে একাকার

কৃষকের মন সেতো বড় শক্ত

সাহায্য করো তুমি হতে মুক্ত।’

ছাগপালক কৃষকের কাছে গিয়ে পাখিটিকে মুক্তির কথা বলল। কৃষক তাকে আগের মতো একই উত্তর দিয়ে ফেরত পাঠালো। ইতোমধ্যে ইঁদুরটি তার বন্ধুকে মিস করতে আরম্ভ করল। এরপর তাকে খুঁজতে বের হলো। অনেক খোঁজাখুঁজির পর দূর থেকে দেখতে পেল চড়ুইটিকে। তখন সে গাছে ঝোলানো অবস্থায় সাহায্যের আবেদন জানাচ্ছিল।

বন্ধুকে বাঁচানোর জন্য সেই মুহূর্তে সে একটি পরিকল্পনা করল। সে একটি গর্তের মধ্যে ঢুকে একটি হীরার হার নিয়ে বের হয়ে আসলো। হারটি কৃষককে দেখিয়ে বলল, ‘এটি আপনাকে দেবো, যদি চড়ুইটিকে মুক্ত করে দেন।’

হীরার হার দেখে কৃষকের চোখ লোভে চকচক করে উঠল। ভাবল, হারটি নিশ্চিত ঝোলানো পাখিটির চেয়ে মূল্যবান। সে গাছের কাছে গিয়ে দড়ির গিঁট খুলে পাখিটিকে মুক্ত করে দিল। মুক্তি পেয়ে পাখিটি যতদ্রুত সম্ভব উড়ে গেল। ইঁদুরটিও হার নিয়ে গর্তে ঢুকলো।

গরীব কৃষক ছোট্ট এই প্রাণীর চালাকি দেখে অবাক দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে রইল!

আয়তনের দিক দিয়ে ভারতের সবচেয়ে বড় অঙ্গরাজ্য রাজস্থান। নানা পুরাণ ও লোককাহিনীতে ভরা এ রাজ্যের একটা শিশুতোষ রূপকথা হলো ‘ইঁদুর ও চড়ুইয়ের গল্প’। অঞ্জলি ভার্মার ইংরেজি থেকে গল্পটি অনুবাদ করেছেন মিলন আশরাফ।

অলঙ্করণ: শিল্পী সমর মজুমদার