গুগল স্যার

ভূতটার শীত করছে। থরথর করে কাঁপছে মামদো ভূত। মানুষের রূপ ধরে গতকালের ট্রেনে কলকাতা থেকে ঢাকায় এসেছে সে।

অনার্য মুর্শিদবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 March 2018, 11:28 AM
Updated : 11 March 2018, 11:28 AM

হালকা একটা চাদর আর দুটো জামা এনেছে সঙ্গে। ভেবেছিল এটা দিয়ে শীত তাড়াবে। কিন্তু বাংলাদেশে আজকাল যা শীত পড়ছে! একবার লন্ডনে গিয়ে এরকম বিপদে পড়েছিল সে। টেমস নদীর পারে হাওয়া খেতে গিয়ে টের পেয়েছে শীত কাকে বলে!

এখন সে কথাই মনে পড়েছে। বারো বছর আগে বাংলাদেশি বন্ধুদের আমন্ত্রণে একটা মৈত্রী সম্মেলনে যোগ দিতে ঢাকায় এসেছিল। সে বছর কলকাতা থেকে আরো অনেকেই এসেছিল। সবাই নেচে-গেয়ে বাংলাদেশি ভূতদের মাতিয়ে গিয়েছিল।

তখন বাংলাদেশের আবহাওয়া এরকম বাজে ছিল না। ইদানিং দেশি-বিদেশি কলকারখানাগুলো শহরের পরিবেশ নষ্ট করে ফেলেছে। ভূতটা আজ এসেছে বাংলাদেশের নামজাদা ইতিহাসবিদ মিস্টার ওয়াইজম্যানের কাছে। ওয়াইজম্যান কলকাতার ইতিহাস নিয়ে পিএইচডি করেছেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। তার কাছে একটা উত্তর জানতে এতো দূর আসা। প্রশ্নটা হলো, কলকাতার নাম কেন কলকাতা?

কলকাতার নামধাম নিয়ে ভূতটা মাথা ঘামাতো না। সে একটা পিচ্চি ভূতের স্কুলে পড়ায়। তার জানাই ছিল না এখনকার পিচ্চিদের জানার আগ্রহ অনেক! কথায় কথায় তারা প্রশ্ন করে। এটা কী, ওটা কী? এটা কেন হলো, ওটা কেন হলো না? এটা কে বানাল, ওটা কে বানাল? পিচ্চি ভূতের এতো প্রশ্নের উত্তর কী সে দিতে পারে!

ক্লাসে এক পিচ্চি ভূত সেদিন প্রশ্ন করে বসল, স্যার কলকাতার নাম মুর্শিদাবাদ বা অন্য কিছুও তো হতে পারত। ‘কলকাতা’ হলো কেন? মামদো বলল, গাধা এটা কোনো প্রশ্ন হলো! এর কোনো উত্তর আছে?

পিচ্চি বলল, স্যার প্রশ্ন তো প্রশ্নই। উত্তর নেই এমন কোন প্রশ্ন আছে পৃথিবীতে? মামদো ভূত বুঝল পিচ্চি ভূতের যুক্তি ঠিক। প্রশ্ন থাকলে উত্তরতো অবশ্যই আছে। কিন্তু কী সেই উত্তর? মামদো উত্তরের সন্ধানে নেমে গেলো। কলকাতার এক বিখ্যাত সাংবাদিক তার বন্ধু। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের মিস্টার ওয়াইজম্যান এ ব্যাপারে পটু। তাই সে উত্তর খুঁজতে চলে এলো ঢাকায়।

কিন্তু ঢাকায় এসে যে এমন বিপদে পড়বে তা কে জানতো! এখন সে কি উত্তর খুঁজবে নাকি কম্বল খুঁজবে! মনে মনে পিচ্চিটার ওপর তার রাগই হলো। পিচ্চি ভূতকে এত্তো ইতিহাস জানতে হবে কেন! কখন কে কলকাতার নাম রেখেছে, সেটাও জানার ইচ্ছে হলো! পিচ্চিরা এতো বিষয়ে আগ্রহী হয় কেন? আগেকার পিচ্চিরা তো এরকম ছিল না!

ঢাকার রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মামদো ভূতের মনে পিচ্চিদের নিয়ে নানা প্রশ্নের উদয় হতে থাকে। অনেকক্ষণ হেঁটেও কোনো মানুষের দেখা পেলো না সে। অন্ধকারে গা ছমছম করছে। ভয়ে বুক ঢিবঢিব করছে। একটু হাঁটার পর ভূতটা একটা চায়ের দোকান দেখলো। দোকানটা একটা কারখানার সামনে। গভীর রাত পর্যন্ত শ্রমিকরা এখানে চা-পানি খায়।

মামদো একটা টুল টেনে বসলো। চায়ের অর্ডার করল। চা খেলে ঠাণ্ডা কম লাগবে, শরীরটা একটু চাঙা হবে। কিন্তু দোকানি জানালো, চায়ের লিকার সবে শেষ হয়েছে। আজ আর চা হবে না।

মামদো মন খারাপ করে বসে থাকলো।

কিছুক্ষণ পর একজন হকার এলো। ‘এই নেবেন পত্রিকা...! আগামীকালের পত্রিকা...! মামদো একটা পত্রিকা কিনলো। আজকের প্রধান শিরোনাম ‘প্রযুক্তিতে এগিয়ে যাচ্ছে শিশুরা’। বিস্তারিত সংবাদ পড়ে মামদো মুচকি হাসলো। সে বুঝতে পারলো, প্রযুক্তির কল্যাণেই পিচ্চি ভূতদের জানার এতো আগ্রহ। গুগল নামে নাকি একটা সার্চ ইঞ্জিন বেরিয়েছে। সেখানে কোনো প্রশ্ন লিখে সার্চ দিলেই উত্তর মিলে যায়!

পিচ্চিরা গুগল স্যারকে ইচ্ছেমতো প্রশ্ন করছে। গুগল স্যারও জবাব দিচ্ছে সঙ্গে সঙ্গে। এখন গুগল স্যারই পিচ্চি ভূতদের বড় বন্ধু। গুগল স্যার জানেন না এমন উত্তর পৃথিবীতে নেই। এই স্যারটাই তাদের জ্ঞানের উৎস। এই স্যারের কারণেই তাদের মনে নতুন নতুন প্রশ্ন জাগে।

মামাদো মনে মনে বলল, একটা রহস্যের না হয় সমাধান হলো। কিন্তু কলকতা? কোথায় মিলবে সেই উত্তর! অনেক বই ঘেঁটেও এই প্রশ্নের উত্তর মেলেনি। তাই তো ওয়াইজম্যানের কাছে আসা। কিন্তু ব্যস্ত এ নগরীর কোথায় থাকেন ওয়াইজম্যান? কোন গলিতে? পুরো দিন গাধার মতো হেঁটেছে, অথচ কাউকে জিজ্ঞেসও করেনি। নিজেকে এখন তার ‘মানুষ’ মনে হচ্ছে। মানুষরা যেমন বোকা লোককে কখনো সখনো ‘গাধা’ বা ‘ভূত’ বলে, তেমনি ভূতসমাজে বোকা ভূতদের বলা হয় ‘মানুষ’!

মামদো পত্রিকাটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। উঠার সময় সে দোকানির কাছে মিস্টার ওয়াইজম্যানের ঠিকানা জানতে চাইল। দোকানি বলল, আপনিতো ওয়াইজম্যানের বাড়ির কাছেই আছেন। ওই যে দেখছেন কারখানাটা! ওটার পেছনেই ওয়াইজম্যান থাকেন। কিন্তু তিনি তো এখন দেশের বাইরে। একটা আন্তর্জাতিক সেমিনারে অংশ নিতে গতকাল তিনি জার্মানি গেছেন। আপনার কিছু জানার থাকলে প্রশ্ন ও ঠিকানা রেখে যান। ওয়াইজম্যান আসলে উত্তর পোস্ট করে দেবেন।

মামদো বললো, ওয়াইজম্যান কি রোজই আপনার দোকানে আসেন? দোকানি বলল, হুঁ। উনি প্রতিদিন আমার এখানে চা খান। গপ্প-সপ্প করেন। মামদো বলল, আমি একটা প্রশ্ন নিয়ে কলকাতা থেকে এসেছি। দোকানির সঙ্গে মামদোর ভালোই খাতির হয়ে গেলো। দোকানি বলল, আমিও আগে ভূত ছিলাম। এখন মানুষ হয়ে গেছি। কারণ ভূত হয়ে থাকতে আমার ভাল্লাগে না। ভূতদের বুদ্ধি কম।

মামদো বলল, আপনি ঠিক বলেছেন। ভূতদের কোনো জ্ঞান নেই। এই যেমন ছোট্ট একটা উত্তরের জন্য পিচ্চি ভূতদের কাছে কীভাবে আটকে যেতে হলো আমাকে! ছোট্ট একটা প্রশ্ন, কলকাতা কেন কলকাতা হলো?

মামদো ভূতের প্রশ্ন শুনে দোকানি হাসলো, ও! এই প্রশ্ন! এই প্রশ্নের উত্তর আপনি তো আমার থেকেও জানতে পারেন। আমি মিস্টার ওয়াইজম্যানের কাছ থেকে শুনেছি। তিনি গল্প করতে করতে বলছিলেন, ‘কিলা’ বা ‘কেল্লা’ থেকে কলকাতা হয়েছে। তবে আরেকদিন বললেন, ‘কিলা’ বা ‘কেল্লা’ থেকে নয়, ‘কালী’ থেকে ‘কলকাতা’ হয়েছে। এক সময় সেখানে নাকি মা কালীর বাস ছিল। তিনি উঠে গিয়ে যেই কালী ঘাটে বসলেন, তখনই জায়গাটার নাম হয়ে গেলো কলকাতা!

উত্তরটা মোটামুটি পছন্দ হলো মামদোর। কিন্তু পিচ্চি ভূত যদি পাল্টা প্রশ্ন করে, কালী কেন উঠে গেলেন? তখন সে তো আবার আটকে যাবে। তাই সে আগেই দোকানিকে আবার প্রশ্ন করে।

দোকানি বলল, কলকাতার নামকরণ ভালোভাবে জানতে হলে তার আগে আপনাকে জানতে হবে ‘শৈব’ আর ‘শক্ত’র পার্থক্য। বুঝতে হবে বৌদ্ধ মহাযান আর কাপালিকদের সাধনা পদ্ধতি। কিন্তু এই মুহূর্তে এতো বিস্তারিত তো আপনার পক্ষে জানা সম্ভব নয়। তার চেয়ে শুধু এইটুকু জেনে রাখুন, তখন বেহালা থেকে দক্ষিণেশ্বর ছিল কালীক্ষেত্র, আর তার অধিশ্বরী কালী বাস করতেন কলকাতায়। কাপালিকরা তাকে নিয়ে পালিয়ে গেলো কালীঘাটের বনে। এভাবেই একসময় কলকাতা ‘কলকাতা’ হলো।

মামদো বুঝতে পারলো এতসব তথ্য জানতে হলে তাকে ইতিহাসের বই পড়তে হবে। নয়তো পিচ্চি ভূতরা তাকে প্রশ্ন করে আটকে ফেলবে। তাই সে আরো বইপড়ার শপথ করে দোকানির কাছ থেকে বিদায় নিলো।