চার্লি চ্যাপলিনের ‘দ্য কিড’

এক গরিব নারী কোলে সদ্যজাত শিশু নিয়ে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এলেন। গির্জার সামনে দাঁড়িয়ে তিনি দেখলেন একটা সুন্দর সাজানো গাড়ি।

মাজহার সরকারবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 22 Jan 2018, 11:25 AM
Updated : 29 Sept 2018, 09:29 AM

গাড়ি থেকে বর-কনে নেমে গির্জায় ঢুকছে। সেখানে বিয়ের অনুষ্ঠান চলছে। তখন সেই নারী কোলের শিশুকে চুপিচুপি গাড়ির পেছনের বুটে রেখে পালালেন।

শিশুর মা কি অনেক গরিব? তিনি শিশুকে কী খাওয়াবেন, কোথায় রাখবেন এ নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিলেন? হয়তো তিনি ভেবেছেন নতুন বর-কনের কাছে শিশুটি ভালো থাকবে।

আমরা যখন এসব নিয়ে ভাবছি ঠিক তখন একদল চোর এসে গাড়িটি নিয়ে পালিয়ে গেলো। গাড়ির ভেতর যে শিশু রয়েছে চোরেরা সেটা খেয়াল করলো না।

কিছুদূর যাওয়ার পর গাড়ির পেছন থেকে শিশুটি উঠল কেঁদে। ঘাবড়ে গেলো চোরের দল। এ দুধের শিশু নিয়ে কী করবে তারা এখন, এতো মহা বিপদ! একটু ভেবে উপায় একটা বের করলো চোরেরা। শিশুটিকে ডাস্টবিনে ফেলে রেখে চম্পট দিলো।

ওই সময় রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল চার্লি চ্যাপলিন। আচমকা তার গায়ে একগাদা ময়লা আবর্জনা এসে পড়ল। পাশের ভবন থেকে ফেলা হয়েছে। মন খারাপ করে চার্লি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল। যখনি অভিযোগ জানাতে যাবে তখন তার চোখে পড়ল ওই ডাস্টবিনে একটা শিশু। শিশুটিকে দেখে মায়া লাগল চার্লির, কোলে তুলে নিল সে।

কিন্তু এ শিশু নিয়ে কোথায় রাখবে সে? খাওয়াবেই কী? সে তো নিজেই বোহেমিয়ান ছন্নছাড়া লোক, থাকার জায়গা নেই, খাওয়াও জোটে না ঠিকমতো। সুতরাং যেখান থেকে পাওয়া গেছে সেখানে রেখে যাওয়াই ভালো।

কিন্তু বিধি বাম। পুলিশ দেখে ফেলে চার্লি একটা শিশু ফেলে দিচ্ছে ডাস্টবিনে। পুলিশ তাকে দিল ধমক। পুলিশের ভয়ে শিশুটাকে নিজের কাছেই রাখতে হলো। আর কোন উপায় না পেয়ে শিশুটাকে সে নিয়ে এলো নিজের ভাঙাচোরা ডেরায়।

এমনি করে পাঁচটি বছর কেটে গেল। শিশুটিকে অনেক কষ্টে সে বড় করে তুললো। চার্লি নিজেই দিন আনে দিন খায়। একবেলা খায় তো অন্যবেলা না খেয়ে থাকে। এমন অবস্থায় একদিন ছেলেটিকে নিয়ে জীবিকার খোঁজে সে বেরিয়ে পড়ল।

কিন্তু কাজ পাওয়া কি আর মুড়ির মোয়া? শেষমেশ দু’জন মিলে একটা বুদ্ধি বের করল। ছেলেটি লুকিয়ে লুকিয়ে ঢিল ছুঁড়ে বড় লোকদের জানালার কাচ ভেঙে দেয়, আর চার্লি সেখানে নতুন কাচ লাগিয়ে দেয়, বিনিময়ে পায় পয়সা। দারুণ বুদ্ধি, এভাবে চললো কিছুদিন।

তবে কারসাজিটা পুলিশের নজরে পড়ে গেলে বন্ধ হয়ে গেলো রোজগারের পথ। ততদিনে ছেলেটির মা বেশ বিখ্যাত গায়িকা হয়ে গেছেন। এখন তার অনেক খ্যাতি, প্রচুর অর্থকড়ি। তবু তার মন কাঁদে ফেলে দেওয়া সেই শিশুর জন্য। ভুলের অনুশোচনায় আর মনের দুঃখ কমাতে গায়িকা শহরের বস্তিতে গিয়ে শিশুদের জন্য কাজ করতে লাগলেন।

একদিন চার্লির ছেলেটি বস্তির আরেক ছেলের সঙ্গে মারামারি করতে গিয়ে আহত হলো। ঘটনাক্রমে গায়িকা তখন ওই বস্তিতেই ছিলেন। তিনি আহত ছেলেকে চার্লির কাছে নিয়ে এলেন। ডেকে আনলেন চিকিৎসক। চিকিৎসক এসেই টের পেলেন ছেলেটি আসলে চার্লির নয়!

তিনি খবর দিলেন পুলিশকে। পুলিশ জানাল অনাথ আশ্রমকে। আশ্রমের লোকজন এলো ছেলেটিকে নিয়ে যেতে। কিন্তু পাঁচ বছর যে শিশুকে কোলেপিঠে করে বড় করেছে সে কেন এখন ছেলেটিকে দিয়ে দেবে? চার্লি কিছুতেই ছেলেটিকে দেবে না। ছেলেটিও চার্লিকে ছেড়ে যাবে না। অনেকক্ষণ দৌড়াদৌড়ির পর চার্লি আর ছেলেটি আশ্রয় নিল একটি ছোট সরাইখানায়।

ছেলেটির মা গির্জার সামনে তাকে ফেলে আসার সময় গলায় একটা চিরকুট বেঁধে দিয়েছিলেন। চিকিৎসক সেই চিরকুট চুরি করলেন চার্লির ডেরা থেকে। এরপর তিনি তা দিলেন গায়িকার হাতে। চিরকুটে নিজের হাতের লেখা দেখে গায়িকা বুঝলেন, এটাই তার ফেলে দেওয়া শিশু যার জন্য তিনি বুক ভাসিয়ে কাঁদেন।

ছেলের একটা খোঁজ পেয়ে তাকে ফিরে পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠলেন গায়িকা। তিনি ঘোষণা করলেন, ছেলেটিকে যে এনে দেবে তাকে দেওয়া হবে অনেক টাকা পুরস্কার। বিজ্ঞাপনটি চোখে পড়ল সরাইখানার মালিকের। চার্লি যখন ঘুমিয়ে ছিল তখন তিনি আলগোছে ছেলেটিকে কাপড়ে প্যাঁচিয়ে নিয়ে গেল পুলিশের কাছে। পুলিশ ছেলেকে তুলে দিল মায়ের হাতে।

অন্যদিকে ঘুম থেকে উঠে চার্লি দেখে ছেলেটি নেই। পাগল প্রায় হয়ে গেল সে। এখানে খোঁজে, সেখানে খোঁজে। না নেই, কোথাও নেই। অবশেষে সে ফিরে আসে বস্তিতে। সারাদিন খোঁজাখুঁজির পর অবসন্ন চার্লি নিজের ডেরার দরজার সামনে বসে থাকে।

একসময় বসে থেকেই ঘুমিয়ে যায়। ঘুমের মধ্যে সে স্বপ্ন দেখতে শুরু করল। চার্লি দেখলো এই বস্তিটা আর নোংরা নেই। সাফসুতরো হয়ে গেছে, মনরোম স্বর্গের সৌন্দর্য চারদিকে। দেবদূতের পোশাক পরে উড়ছে সবাই। একসময় ছেলেটি এসে দাঁড়াল চার্লির সামনে।

কিন্তু স্বর্গে ভীষণ গোলমাল শুরু হলো। সেই শব্দে ঘুম ভাঙলো চার্লির। ঘুম ভেঙে দেখলো সামনে দাঁড়িয়ে আছে পুলিশ। চার্লিকে পুলিশ ভ্যানে উঠিয়ে নেওয়া হলো। সেটি এসে থামলো বড় এক ভবনের সামনে। গাড়ি থেকে নেমেই চার্লি দেখল ছেলেটিকে।

ছেলেটি তখন মায়ের কোল ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে। চারদিকে শুধু আনন্দ উৎসব। উৎসব তো হবেই, হারিয়ে যাওয়া ছেলেকে খুঁজে পেয়েছেন মা, ছেলেও ফিরে পেয়েছে তার মাকে।

এই হচ্ছে ‘দ্য কিড’ ছবির গল্প। গল্পটি লিখেছেন চার্লি চ্যাপলিন নিজেই। প্রায় একশ বছর আগে, ১৯২১ সালে মুক্তি পাওয়া নির্বাক হাস্যরসের এ চলচ্চিত্রটি প্রযোজনা ও পরিচালনাও করেন চ্যাপলিন নিজে। ছবির শুরুর দৃশ্যে বলা হয়, ‘একটি হাসির চলচ্চিত্র, সম্ভবত কান্নারও’। ধারণা করা হয় চলচ্চিত্রে দেখানো দারিদ্র ও সমাজকর্মীদের বিরূপ মনোভাব লন্ডনে চ্যাপলিনের নিজের ছেলেকালের প্রতিচ্ছবি।