টুনু বললো, ‘দাদাই তোমাকে এখানে পেয়ে খুব ভালো হলো।’
‘কেন রে আমাকে খুঁজছিলি কেন?’
বিলু এগিয়ে এসে মোসলেহ উদ্দীন সাহেবের হাত ধরে বললো, দাদাই বলো তো টাকা এলো কোত্থেকে?
এতটুকু শোনে সবাই দাদুর আরও কাছাকাছি এসে গেলো। সবার মনোযোগ এখন দাদুর দিকে।
দাদু বলতে থাকলেন, বঙ্গ রাজ্যে টাকা শব্দটা সবসময় যেকোনো মুদ্রা বা ধাতব মুদ্রাকে বোঝানোর জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। চৌদ্দ শতাব্দীতে ইবন বতুতা খেয়াল করেছিলেন যে বাংলার লোকজন সোনা ও রূপার ধাতবকে টাকা বলেন।
টুনি বললো, ‘আচ্ছা দাদু, তোমার কাছে পুরনো টাকা বা মুদ্রা আছে? আমরা দেখতে চাই।’
‘ছিলো তো অনেকগুলো। কিন্তু সেগুলো আমি টাকার জাদুঘরে দান করে দিয়েছি।’
সবার মধ্যে হাসাহাসি পড়ে গেলো, টাকার আবার জাদুঘর আছে নাকি! সেই সঙ্গে তাদের আগ্রহও কম নয়। কোথায় সেই জাদুঘর? কী আছে সেখানে?
স্বাতী উৎসাহে বলে উঠলো, আমার দিদিমার একটা কাঠের বাক্স ছিলো। ওটাতে সে টাকা পয়সা জমিয়ে রাখতো। ওটাযে এখন কোথায় তা জানি না।
বেলী বললো, আচ্ছা দাদু টাকা কে ছাপায়? দাদু বললেন, টাকা বানানো বা ছাপানোর স্থানকে বলে টাকশাল। ইংরেজিতে বলে মিন্ট। বাংলাদেশের টাকশাল আছে গাজীপুরে। কাগুজে টাকা বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ‘বাংলাদেশ ব্যাংক’ থেকে আসে।
কিন্তু সব টাকা বাংলাদেশে ছাপা হয়না। যেমন পাঁচশ টাকার নোট ছাপা হয় জার্মানিতে। ১ ও ৫ টাকার পয়সা বানানো হয় কানাডায়। আর বাংলাদেশে টাকা ছাপানোর বিশেষ কাগজ আসে সুইজারল্যান্ড থেকে।
টুনু বললো, ‘দাদু, ওদিন কিছু চকোলেট কিনলাম। দোকানি আমাকে একটা টুকরো কাগজ দিলো যাতে চকোলেটের নাম ও পাশে টাকার পরিমাণ লেখা ছিলো। আর লেখা ছিলো ‘বিডিটি’। এর অর্থ কী?’
স্বাতী বললো, আগে যখন টাকা ছিলো না তখন মানুষ কী করতো? দাদু বললেন, উনিশ শতক পর্যন্ত বাংলায় ছোটখাটো লেনদেনে মুদ্রা হিসেবে কড়ি ব্যবহার করা হতো। সেসব কড়ির কিছু নমুনা আছে মিরপুরের টাকা জাদুঘরে।
প্রাচীন আমল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত মুদ্রিত বিভিন্ন ধরনের ধাতব মুদ্রা, কাগজের নোট ও মুদ্রা সম্পর্কিত দ্রব্যসামগ্রী দেখা যাবে সেখানে। আছে কুষাণ মুদ্রা, হরিকেল মুদ্রা, দিল্লী ও বাংলার সুলতানদের মুদ্রা, মোগল ও ব্রিটিশ শাসকদের মুদ্রাসহ আধুনিক মুদ্রা।
দাদু বলতে থাকলেন, টাকা জাদুঘরে মোঘল আমলের ‘কোচ’ ও ‘অহম’ বা ‘আসাম’ মুদ্রা রয়েছে। রয়েছে দিল্লির সুলতান গিয়াসউদ্দিন তুগলক শাহ, মোগল সম্রাট শাহজাহান, আওরঙ্গজেব, ফররুখশিয়ার ও ব্রিটিশ ভারতীয় স্বর্ণ, রৌপ্য, তাম্র মুদ্রা কাগজের নোট। এছাড়া আছে ব্রিটিশ পরবর্তী পাকিস্তান আমল, স্বাধীন বাংলাদেশের মুদ্রা ও কাগুজে নোটের ধারাবাহিক ইতিহাস।
ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, দিবস ও কালজয়ী ব্যক্তিদের স্মরণে এ পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংক ১২টি স্মারক মুদ্রা ও ৪টি স্মারক নোট প্রকাশ করেছে। এগুলোর মধ্যে একটি স্বর্ণের, একটি নিকেলের ও বাকিগুলো রৌপ্য মুদ্রা। এসব মুদ্রা ও নোটগুলো তোমাদের মুগ্ধ করবে।
শুধু মুদ্রা বা নোট নয়, আছে মুদ্রা তৈরির ডাইস, মুদ্রায় নির্মিত বাংলার ঐতিহ্যবাহী অলঙ্কার, বিভিন্ন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ব্যবহার করা দ্রব্যাদি, শস্য সংরক্ষণে রাখা মাটির মটকি ইত্যাদি।
টুনু বললো, ‘আচ্ছা দাদু, টাকা না থাকলে কী হতো?’ সবাই আবার হাসি। দাদু বললেন, খুব জরুরি প্রশ্ন। টাকা হলো অর্থনৈতিক বিনিময়ের মাধ্যম। ব্যবসা-বাণিজ্য, বাজার, অফিস, রাস্তা-ঘাট সব জায়গায় পণ্য লেনদেন বা সেবা দেওয়া-নেওয়ার মাধ্যম হলো টাকা। প্রাচীনকাল থেকেই টাকার ধারণা ছিলো।
বেলী বলে উঠলো, চল গিয়ে মাকে বলি আমরা টাকা জাদুঘর দেখতে যাবো। সবাই হই হই করতে করতে তাল তুলল। তাদের দাদাই আবার নিজের মতো বইয়ের ভুবনে ডুবে গেলেন।