আবদুল গনির ঘণ্টা

ছোটবেলায় আমি যে স্কুলে পড়াশোনা করেছি তার নাম লতিফপুর প্রাইমারি স্কুল। আমরা কয়েকজন ছেলেমেয়ে দলবেঁধে, হইচই করতে করতে স্কুলে পৌঁছে যেতাম।

সেলিনা হোসেনবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 Dec 2017, 10:38 AM
Updated : 4 Dec 2017, 10:38 AM

স্কুলের দপ্তরির নাম ছিল আবদুল গনি। তিনি ঘণ্টা বাজাতেন।

কখনো স্কুলে যেতে দেরি হলে আমরা দূর থেকে শুনতে পেতাম ঘণ্টার শব্দ। ঢং ঢং ঢং। ওই শব্দ শুনে আমরা দৌড় দিতাম। মাঠের ওপর দিয়ে সেই শব্দ আমাদের কাছে ভেসে আসতো। আমরা মাঠ পেরিয়ে ক্লাসে ঢুকলে ঘণ্টাধ্বনি থেমে যেতো।

আবদুল গনির অনেক বয়স হয়েছিলো। পেতলের ভারি ঘণ্টাটা বাজানোর সময় তার হাতের রগ ফুলে উঠতো। বেশ কষ্ট করে বাজাতো।

আমার মনে হতো, এই বুঝি লোকটা পড়ে যাবে। আর পড়ে গেলে ঘণ্টার ওপর মুখ থুবড়ে পড়বে। পড়ে গেলে মুখ থেঁতলে যেতে পারে, কিংবা মাথা ফেটে যেতে পারে। কখনো আর উঠে দাঁড়াতে পারবে না। কেন যে এমন ভাবনা হতো আজও ভেবে পাই না।

আবদুল গনি স্কুলের সব কাজ করতেন। হেড স্যারের টেবিল-চেয়ার-আলমারি মোছা, মাঝে মাঝে স্কুল ঘরটা ঝাড়ু দেওয়া, ডালিম গাছের যত্ন নেওয়া, ডালিম পাকলে সেটা পেড়ে আনা, এইসব কাজ।

একদিন স্কুল শুরুর আগে দেখলাম আবদুল গনি বারান্দার খুঁটিতে হেলান দিয়ে বসে আছেন। জিজ্ঞেস করলাম, চাচা কী হয়েছে?

কপালে হাত দিয়ে বললেন, জ্বর।

জ্বর তো বাড়ি যান। আজকে ঘণ্টা বাজাতে হবে না।

তা কি হয়! তাহলে ঘণ্টা বাজাবে কে?

কেউ বাজাবে না।

স্যাররা কী করে বুঝবেন যে ক্লাস শেষ হলো?

স্যাররা ঘড়ি দেখে বুঝে নেবেন।

হা হা করে হেসে আবদুল গনি বলেন, এমন করে ক্লাস চললে তো আমার চাকরি থাকবে না।

দরকার নেই চাকরি করার। আপনি বাড়ি যান।

চাকরি না করলে খাবো কি?

আমরা চুপ করে থাকি।

আবদুল গনি আমাদের বলেন, আটটা ছেলেমেয়ে আমার। ওদেরকে কে দেখবে? ওরা যে না খেয়ে মরে যাবে!

না, না এটাতো হয় না। আপনার চাকরি করাই উচিত। আমরা সমবেত কণ্ঠে বলি। আবদুল গনি হাসতে থাকেন। আমরা ক্লাসে যাই। তার একটুপর শুনি ঢং ঢং করে ঘণ্টা বাজছে। আমাদের অংক ক্লাস শেষ, এখন বাংলা স্যার আসবেন।

গনি চাচা আমাদের মনে করিয়ে দেন যে একটা ক্লাস শেষ হয়েছে, এবার তোমাদের অন্যকিছু শিখতে হবে। বেশ মজা। মাঝে মাঝে ভাবতাম, এমন ঘণ্টা ব্যবস্থা না থাকলে কি আমরা সব সময় এক ক্লাসেই বসে থাকতাম? কে জানে। ঠোঁট উল্টিয়ে নিজেকেই প্রশ্নের উত্তর দেই।

সেবার ছিলো আমাদের ফাইনাল পরীক্ষার সময়। দু’দিন পর শুরু হবে। সব ছেলেমেয়েরা পরীক্ষার চিন্তায় তটস্থ। সবাই বেশ মনোযোগী হয়ে উঠেছে। একদিন দুপুরবেলা গনি চাচা ঘণ্টা বাজানোর সময় উল্টে পড়ে গেলেন। স্যাররা ছুটে গেলেন তাঁকে তুলতে।

দেখা গেলো তিনি জ্ঞান হারিয়েছেন। কোনো একজন স্যার পানি আনলেন। চোখেমুখে পানির ছিটা দিলেন। গনি চাচা তাকালেন না। হেড স্যার যে মাদুরে নামাজ পড়তেন সেটা বিছিয়ে তাঁকে শুইয়ে দেওয়া হলো।

একজন স্যার গেলেন ডাক্তার আনতে। কোনো একজন স্যার ঘণ্টাটা উঠিয়ে নিয়ে হেড স্যারের রুমে রাখলেন। অনেক শুশ্রূষা করা হলো। ডাক্তার এলো। কিন্তু গনি চাচার জ্ঞান ফিরলো না। তাঁর বুকের হাড়গুলো ওঠানামা করছে। আমরা একপাশে দাঁড়িয়ে আছি।

শেষে একজন স্যার বললেন, এই তোদের ছুটি। তোরা বাড়ি চলে যা। কেউ এখানে থাকবে না।

আমরা সব ছেলেমেয়ে এই প্রথম কোনো হইচই না করে স্কুলের মাঠ ছাড়িয়ে বাড়ি চলে এলাম। গনি চাচার জন্য আমাদের খুব খারাপ লাগছিলো। একবার বুকের ভেতর আতঙ্ক নিয়ে ভাবলাম, মানুষটা কি না-খেতে পেয়ে মরে গেলো? এখন তাঁর ছেলেমেয়েদের কে দেখবে? আবার ভাবলাম, দূর ছাই মরবে কেন! গনি চাচার অসুখ করেছে।

অলঙ্করণ- রফিকুন নবী

পরদিন আমাদের স্কুল শুরু হলো ঘণ্টা বাজানো ছাড়া। স্যাররা আমাদের ক্লাসে ঢুকিয়ে পড়ানো শুরু করে দিলেন। আবার ঘড়ি দেখে ক্লাস শেষ করলেন। খানিকক্ষণ পর খবর এলো যে গনি চাচা মারা গেছেন। তাঁর বাড়ি ছিলো আমাদের স্কুলের কাছেই। আমরা সবাই গেলাম। সেই বাড়িতে।

তাঁর স্ত্রী, ছেলেমেয়ে, আত্মীয়-স্বজনের কান্না দেখে আমারও ভীষণ কান্না পাচ্ছিলো। আমি কাঁদতে শুরু করি। ক্লাসের একজন ছেলে আমাকে বলে, তুই কাঁদছিস কেন?

আমার যে খুব খারাপ লাগছে। তাই কান্না পাচ্ছে।

গনি চাচাতো তোর কিছু হয় না।

না হলে কি দুঃখ করতে হয় না?

ঢঙ। তাও যদি নিজের চাচা হতো।

ও আমাকে ভেঙচি কাটে। ওর কথায় আমার আরও কান্না পায়। আমি চোখের জল মুছে শেষ করতে পারি না। চুপিচুপি সবার সামনে থেকে সরে দূরে দাঁড়িয়ে থাকি। একসময় সবার সঙ্গে স্কুলে ফিরে আসি।

পুষ্প বলে, ইস! তোর চোখ একদম ফুলে গেছে।

আর একজন বলে, লালও হয়ে গেছে।

তুই এতো কেঁদেছিস কেন রে?

আমি চুপ করে থাকি। আমি কী উত্তর দেবো বুঝতে পারি না। কেন কেঁদেছি এর কোনো জবাবও আমার কাছে ছিলো না।

বাংলা ক্লাস শেষ হলে আমি স্যারের পিছুপিছু যাই। স্যার আমার দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলেন, কি রে কিছু বলবি?

স্যার।

বল, কী বলবি।

অন্য কেউ মারা গেলে কি কাঁদতে হয় না?

কে বলেছে হয় না? হয়। দুঃখ পেলে তো কাঁদতে হয়।

তোকে কেউ কিছু বলেছে?

হ্যাঁ, গনি চাচার জন্য কেঁদেছি। সেজন্য নজরুল বলেছে তুই কাঁদছিস কেন? গনি চাচা তো তোর কিছু হয় না।

ও একটা বোকা। ও কিছু জানে না। তুই ঠিক করেছিস। দুঃখ পেলে কাঁদতে হয়। অন্যের কষ্ট দেখলে কাঁদতে হয়। মানুষইতো মানুষের জন্য কাঁদবে। ওই যে গরুটা, ওটা কি তোদের গনি চাচার জন্য কাঁদবে? গনি চাচা কি ওটার জন্য ঘণ্টা বাজাতো? না কি তোদের জন্য বাজাতো?

আমাদের জন্য।

ঠিক বলেছিস। যা এখন ক্লাসে যা।

আমি ভীষণ আনন্দ নিয়ে ক্লাসে ফিরে আসি। আমি যে কোন ভুল করিনি এটা আমাকে খুব স্বস্তি দেয়। আমার ইচ্ছে হয়েছিলো স্যারের পা ধরে সালাম করতে। স্যার আমাকে এভাবে ক্লাসে যেতে না বললে আমি ঠিকই সালাম করতাম।

কয়েকদিন ঘণ্টা বাজানো নিয়ে বেশ অসুবিধা হয়। তারপর স্যাররা ঠিক করেন যে তারাই ঘণ্টা বাজাবেন। একেক সময় এক একজন স্যার ঘণ্টা বাজাতেন।

তার কিছুদিন পর একজন নতুন দপ্তরি আসে আমাদের স্কুলে। সে গনি চাচার মতো বুড়ো ছিলো না। স্বাস্থ্য ভালো ছিলো। কালো, মোটা দেখতে। ওর নামটা কী ছিলো আজ আর মনে নেই। ও যখন ঘণ্টা বাজাতো মনে হতো ঘণ্টাটা অন্যরকম করে বাজাচ্ছে। ওটা গনি চাচার ঘণ্টাধ্বনির মতো ঢং ঢং করছে না।

ওই ঘণ্টাধ্বনি শুনলে আমার মন খারাপ হয়ে যেতো। কোনো কোনো দিন ক্লাস শেষে বাইরে এসে দাঁড়ালে দেখতাম প্রবল বৃষ্টি হচ্ছে। পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে স্কুলের মাঠ। বৃষ্টির ছাঁট এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে আমাদের বারান্দা।

স্কুল ছুটি হলে দেখা যাবে বারান্দাটা কাদা কাদা হয়ে গেছে। আমরা পায়ের পাতায় কাদা নিয়ে বাড়ি ফিরতাম। মনে হতো ঘণ্টাটা বেজে যাচ্ছে। ঢং ঢং ঢং।

একজন নতুন দপ্তরি নতুন সুর তুলেছে। ওই ঘণ্টায়। বই স্লেট বুকে জড়িয়ে আমরা ছুটতাম। পুলিশ লাইন পেরিয়ে, হানিফের দোকান ছাড়িয়ে, পাকা সড়ক ধরে চলে আসতাম বাড়িতে।

কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন (১৯৪৭-) এর লেখা ‘আমার স্কুল’ বইটির একটি পরিচ্ছদ হলো ‘আবদুল গনির ঘণ্টা’। শিল্পী রফিকুন নবীর অলঙ্করণে ৩৩ পৃষ্ঠার এ বইটি ২০০২ সালে প্রকাশ করেছে ‘সাহিত্য প্রকাশ’। বইটির মূল্য চল্লিশ টাকা।

শিশুদের জন্য লেখকের আরও কিছু বই- ‘কাকতাড়ুয়া’, ‘বর্ণমালার গল্প’, ‘বায়ান্ন থেকে একাত্তর’, ‘মুক্তিযোদ্ধারা’, ‘এক রূপোলি নদী’, ‘রংধনু’ ও ‘আকাশ পরী’ ইত্যাদি।