ধনেশ

ধনেশ পাখির ইংরেজি নাম হচ্ছে hornbill. ইংরেজি Horn মানে হচ্ছে শিং আর bill মানে পাখির ঠোঁট বা চঞ্চু। অর্থাৎ ইংরেজিতে এই পাখির নাম, গরুর শিং ঠোঁটওয়ালা পাখি। ধনেশ পাখির শক্ত, বাঁকানো বিশাল ঠোঁটের কারণে বৈজ্ঞানিক নামকরণের সময়ও ওদের গোত্রের নাম রাখা হয়, Bucerotidae, গ্রীক ভাষায় buceros অর্থ গরুর শিং।

মাকসুদা আজীজবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 Sept 2017, 09:04 AM
Updated : 13 Sept 2017, 09:04 AM

ধনেশ পাখিটির যে ঠোঁটটাই যে শুধু বিশাল তাই নয়। ধনেশ পাখিটাও বিশাল এবং উচ্চ প্রজাতিরও। মেরুদণ্ডী প্রাণীদের মেরুদণ্ডের হাড়গুলোকে বলে কশেরুকার। এর প্রথম হারকে বলে অ্যাটলাস এবং ২য় হারকে বলে অ্যাক্সিস। এরপরে হারগুলোকে এলাকা অনুযায়ী সংখ্যা সহকারে নাম দেয়া হয়। যেমন খুলির নিচে ঘাটের হাড়গুলোকে বলে সার্ভাইকাল কশেরুকা। এর নিচ থেকে কোমর পর্যন্ত থোরটিক কশেরুকা। অন্য পাখিদের ক্ষেত্রে কশেরুকাগুলো একটা আরেকটার পাশাপাশি অবস্থান করে। ধনেশের ক্ষেত্রে অ্যাটলাস এবং অ্যাক্সিস একসঙ্গে যুক্ত থাকে। বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন ওদের অমন শক্ত, ওজনদার, পরিশ্রমী ঠোঁটটাকে শক্তভাবে ধরে রাখতে প্রাকৃতিক এই ব্যবস্থা।

ধনেশ পাখির ঠোঁট খুবই জরুরী অঙ্গ তাদের জন্য। তারা সব শক্ত কাজ ঠোঁট দিয়েই করে ফেলে। ধনেশ ফলমূল, পোকামাকড়, ছোট প্রাণী সবই খায়। এগুলোকে ধরতে খেতে এমন ঠোঁট তো অপরিহার্য। এ ঠোঁটের সাহায্যেই শক্ত কীটপতঙ্গ ও ফল গুঁড়ো করে অনায়াসে গুঁড়ো করে ফেলে, এ ছাড়াও লড়াই করা, পালক পরিষ্কার করা, বাসা বানানো ও গোছানোসহ বিভিন্ন ধরনের কাজ ঠোঁটের মাধ্যমের সমাধান করে।

ধনেশ পাখিরা অনেক প্রজাতি এমনকি তাদের সব প্রজাতি এক গণেরও নয়। পৃথিবীব্যাপী ৫৬ প্রজাতির ধনেশ রয়েছে। বাংলাদেশে ৪ প্রজাতির ধনেশ আছে। বেশ কয়েকটি গণের অন্তর্ভূত এই প্রাণীর অদ্ভুত অদ্ভুত রকমের বৈশিষ্ট্য আছে। যেমন একটি ধনেশের প্রজাতি আছে যাদের মাথার উপর হেলমেটের মতো একটা আলাদা অংশ আছে। সেটার নাম হেলমেট মাথার ধনেশ। প্রজাতি ভেদে ওদের যেমন চেহারা আলাদা তেমনি আকার আকৃতি ইত্যাদিও আলাদা তবে কিছু স্বভাবে ভীষণ মিল রয়েছে যেমন, ওদের ঘর বানানোর পদ্ধতিতে। ওদের বাড়িটা এমন হয় যে সেটায় দরজা দিয়েও রাখা যায়। কীভাবে? বলছি শোন—

ধনেশরা বাড়ি বানায় কাদা, অন্য প্রাণীর বিষ্ঠা, মাটি ইত্যাদি দিয়ে। বাড়িগুলো হয় মূলত কোনো গাছের কোটর বা গর্তে। অথবা সমুদ্রের পাড়ে হলে মাটি বা পাথরের গুহায়। মোট কথা ধনেশরা গুহাবাসী।

যেহেতু বাসার জন্য ইতিমধ্যেই একটা আশ্রয় আছে তাই ধনেশদের সেটায় শুধু একটু উপর দিয়ে কারসাজি করতে হয়। এ জন্য ওরা নানান বুদ্ধি করে। যেমন কোনো কোনো প্রজাতির পুরুষেরা মুখে করে কাদা নিয়ে আসে আর বাইরে থেকে বাসা আটকানোর কাজ করে। আবার কিছু প্রজাতির ধনেশ করে কি কাদা গিলে ফেলে। সেই কাদা পাখিটির খাদ্যনালীতে দিয়ে প্রক্রিয়াজাত হয়। তারপর ছোট ছোট মাটির দলা উগড়ে বের করে। বাকিটা কাজ করে স্ত্রী ধনেশ পাখি। সে বাড়ি গোছায় বাচ্চাদের থাকার উপযোগী করে। এবং বাড়িতে যদি অপরিণত বাচ্চা থাকে তাহলে ঘর থেকে বের হওয়ার সময় মা পাখিটি মাটি, কাদা দিয়ে ঘরটার মুখও বন্ধ করে দেয়। যেন সাপ বা অন্য কোনো শিকারি প্রাণী ওদের বাচ্চাদের খেয়ে ফেলতে না পারে।

ছোট ধনেশ ৬টি পর্যন্ত ডিম পাড়ে, প্রায় ২৫ দিন তা দেয়, প্রথম বাচ্চাটির বয়স প্রায় ৪৫ দিন হলে স্ত্রী পাখি কোটর থেকে বের হয়। বড় পাখি ২টি ডিম পাড়ে, প্রায় ৪৫ দিন তা দেয় এবং বাচ্চাদের একমাস বয়সকালে বাসা ছাড়ে, যদিও প্রায় ৮০ দিন বাসায় যাতায়াত করে। অধিকাংশ বড় প্রজাতির স্ত্রী পাখি বাচ্চা না উড়া পর্যন্ত বাসায় থাকে এবং সর্বমোট ৪-৫ মাস বন্দি জীবন কাটায়।

বন্দি জীবন কাটানোর আগে স্ত্রী পাখিরা আবার একটা প্রস্তুতি নেয়। প্রথমে বাসা হয় এবং এতে ডিম পাড়ায় প্রস্তুতিও নেওয়া হয়। ডিম পাড়ার আগে দিয়ে স্ত্রী পাখিদের উড়ার কাজে ব্যবহৃত বড় পালকগুলো  সব ঝরে যায়। ডিম পারার পরে স্ত্রী ধনেশরা ডিমে তা দিয়ে সর্বক্ষণ ডিমের কাছেই অবস্থান করে যেন ওদের ডিম অন্যরা কেউ খেয়ে ফেলতে না পারে। এরপর যখন বাচ্চারা কিছুটা বড় হয় তখন তারা ঘর থেকে বের হয়। আর ঘর থেকে বের হওয়ার আগে আগেই ওদের শরীরে পালক গজিয়ে যায়। এ সময়টুকু পুরুষ ধনেশরা খাবার সংগ্রহ করে এবং স্ত্রী ধনেশদের মুখে তুলে খায়িয়েও দেয়। ঠিক যেমন মা পাখি শিশু পাখিদের খাওয়ায় একদম সেভাবে। 

একটা বাড়িতে একজোড়া ধনেশ থাকে। একটা নারী ধনেশ আরেকটি পুরুষ ধনেশ। পরে তাদের বাচ্চা হলে শিশু ধনেশেরাও থাকে। ধনেশ তাদের ওজনের জন্যই হোক অথবা স্বভাবের জন্য খুব একটা নিজের জায়গা থেকে নড়াচড়া করে না। ওরা বড়ির আশেপাশে ১০ হেক্টর বা ১০০ বর্গকিলোমিটার পর্যন্ত জায়গায় চলাচল করে। এটাই ওদের এলাকা। এর বাইরে ওরা সহজে পাড়ি দেয় না।

পাতাঠুঁটি ধনেশ (Wreathed Hornbill), উদয়ী পাকরাধনেশ (Oriental Pied Hornbill),  রাজ ধনেশ (Great Hornbill) ও দেশি মেটেধনেশ (Indian Grey Hornbill) ইত্যাদি ধনেশকে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে দেখা যায়।