কণ্ঠযোদ্ধা আবদুল জব্বার

টুনুর কথায় মোসলেউদ্দিন সাহেব চকিত ফিরে তাকালেন। টুনুর মনে হলো যেন দাদাই দূর কোনো দেশ থেকে ওর কথা শুনতে পাচ্ছেন। সব কথা তার কানে স্পষ্ট করে ঢুকছেও না। ভয় পেয়ে টুনু দাদাইকে আরও জোরে ঝাঁকাতে থাকলো। মোসলেউদ্দিন আস্তে আস্তে যেন বাস্তবে ফিরে আসলেন। হাতে থাকা ট্যাবটা পাশের টেবিলে রেখে চশমা খুলে চোখের কোণে আসা একটু পানি মুছে নিলেন।

মাকসুদা আজীজবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 August 2017, 01:18 PM
Updated : 30 August 2017, 01:18 PM

তারিখের হিসেবে বর্ষাকাল শেষ। তবে আকাশে কালো মেঘের আনাগোনা বলছে বর্ষার এখনও যাওয়ার ইচ্ছে নেই। বাচ্চাদের স্কুল কোরবানি ইদের ছুটি হয়েছে। ওরা দিন রাতই পারলে দাদাইর বাড়ি থাকে। মাঝে মাঝে এর ওর বাড়িতে গরু আসার সংবাদে এক দৌড়ে চলে যায় আবার ফিরে এসে দাদাইকে বলতে থাকে, কেমন হলো কার গরু। তবে যেহেতু এখনও গরুর আগমনও কম কম তাই ওদের ব্যস্ততাও এখনও পুরোপুরি শুরু হয়নি।

দাদাইর চশমা খুলতে খুলতেই মূল দরজা দিয়ে আরাফ যেন উড়তে উড়তে বাগানে ঢুকলো। দাদাই... দাদাই... আবদুল জব্বার মারা গিয়েছেন...

আরাফের চিৎকারে আরে দৌড়ে আসায় অন্য যারা বাগানে খেলছিল বা গাছের পরিচর্যায় ব্যস্ত ছিল দাদাই কাছে চলে এলো। দাদাই খুব আস্তে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, জানি।

তিতলি দলে নতুন জুটেছে। এ মাসেই ওরা এই এলাকায় এসেছে। অন্যদের থেকে ওর বয়সও কম আর জানা শোনাও কম। সে জিজ্ঞেস করল, দাদাই উনি কী তোমার বন্ধু ছিলেন? তুমি কাঁদছো কেন?

নীলাঞ্জনা তিতলিকে আলতো করে নিজের দিকে টেনে নিয়ে বলল উনি একজন সঙ্গীত শিল্পী ছিলেন, তুমি "ও রে নীল দরিয়া…" গানটা শুনেছো? সেটা উনারই গাওয়া ছিল।

আরাফ যোগ করল, শুধু তাই নয় তিতলি, তুমি কি দেখেছো কভু, সালাম সালাম হাজার সালাম, জয় বাংলা বাংলার জয় এই গানগুলোও উনার গাওয়া। ২০০৬ সালে বিবিসি বাংলা সেরা বাংলা গানের একটা শ্রোতা জরিপ চালিয়েছিল। ২০টা শ্রেষ্ঠ গানের মধ্যে উনার গাওয়া এই তিনটি গান ছিল। এ ছাড়াও উনি আরও অনেক জনপ্রিয় গান গেয়েছিলেন। তবে উনার সবচেয়ে বড় পরিচয় উনি একজন মুক্তিযোদ্ধা।

মুক্তিযোদ্ধা? চোখ বড় বড় করে জিজ্ঞেস করলো তিতলি। সত্যি দাদাই?

দাদাই এতক্ষণ চুপ করে ছোটদের কথা শুনছিলেন। এখন আস্তে আস্তে মুখ খুললেন, যদি ভাবিস বন্দুক আর গুলি দিয়ে শত্রুকে মারলেই শুধু যুদ্ধ করা হয় তবে আবদুল জব্বার শুধুই একজন সঙ্গীত শিল্পী। তবে যুদ্ধ ব্যাপ্তি আর যোদ্ধার অবদান বন্দুক আর গুলির চেয়ে অনেক বিস্তৃত বিষয়। সারা দেশের মানুষ যখন প্রাণ বাঁচিয়ে ভারত পালাচ্ছিল। শুরু থেকেই পাকিস্তানিরা যুদ্ধকে শক্তিশালী করতে পারে যোদ্ধাদের উদ্বুদ্ধ করতে পারে এমন মানুষদের ধরে ধরে মারছিল সেখানে আবদুল জব্বার স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রে গান গাওয়ার মতো দুঃসাহসিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। উনি গান গাইতেন আর গানের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের উজ্জীবিত করতেন। যেন তারা যুদ্ধ চালিয়ে যায়, যেন তারা হার না মানে, যেন তারা এ দেশকে স্বাধীন করতে পারে।

ছোট্ট অন্তু যোগ করল, তাহলে উনি কি মুক্তিযোদ্ধাদের হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা দাদাই?

দাদাই খুব ছোট করে হাসলেন, অন্তুর মাথায় হাত রেখে বললেন, এই উপমাটা এখানে যায় না রে অন্তু। হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা তার সুর দিয়ে খারাপ কাজও করতেন। আবদুল জব্বার একটি দেশকে রক্ষা করার কথা বলতেন। এখানে একদম আলো ও অন্ধকারের মধ্যেকার পার্থক্য।

অন্তু তার ভুল বুঝতে পারল। সে মাথা নিচু করে বলল, সরি দাদাই!

দাদাই বললেন, ধন্যবাদ অন্তু নিজের ভুল স্বীকার করে নেওয়ার জন্য। আবদুল জব্বার মুক্তিযুদ্ধে এত বড় অবদান রেখেছেন তা বলে শেষ করা যাবে না। তোরা জানিস, উনি যে শুধু গান গেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্বুদ্ধ করতেন তাই নয়, যুদ্ধের সময় তিনি প্রখ্যাত ভারতীয় কণ্ঠশিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে মুম্বাইয়ের বিভিন্ন স্থানে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পক্ষে জনমত তৈরিতে কাজ করেন। আবার কলকাতাতে অবস্থিত বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প ঘুরে হারমোনি বাজিয়ে গণসঙ্গীত পরিবেশন করেছেন যেন এই অসম যুদ্ধে লড়তে লড়তে যোদ্ধারা ভেঙ্গে না পরে, মনোবল না হারায়।

বিভিন্ন জায়গায় গান গাওয়ার ফলে উনি সম্মানী পেতেন। সেই সম্মানীর টাকা কিন্তু উনি খরচ করতেন না। সব জমিয়ে রাখতেন। এভাবে জমিয়ে রাখা প্রায় ১২ লাখ টাকা উনি স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের ত্রাণ তহবিলে জমা করেছিলেন। তখনকার ১২ লাখ টাকা কিন্তু এখন অনেক অনেক টাকা।

বুঝতে পেরেছি দাদাই, হয়তো উনি বন্দুক হাতে যুদ্ধ করেননি। তবে বন্দুক হাতে করা যুদ্ধটা ঠিকভাবে চলতে পারে তাই তিনি অন্য আরও কঠিন একটা যুদ্ধ করেছিলেন। বলে উঠলো তিতলি।

টুনু বলল, জানো তিতলি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে ভালো দিক কী ছিল? মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে ভালো দিক ছিল, কেউ কারও নির্দেশের পথ চেয়ে বসে থাকত না। সবাই জানতো দেশকে স্বাধীন করতেই হবে। তাই সবাই যার যার মতো কাজ করে যেত। সবাই মিলে এভাবে একটা উদ্দেশ্যে কাজ করা হয়েছিল বলেই পাকিস্তানীরা আর কিছুতেই আমাদের অবরুদ্ধ রাখতে পারেনি। তাই না দাদাই?

দাদাই একটুখানি হাসলেন।

দাদাই হাসি দেখে কাজল সাহস করে এসে দাদাইর চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল, দাদাই আরাফ ভাইয়া তোমাকে একটা দুঃখের খবর বলেছে। সুখের খবর কিন্তু বলেই নেই, আজকে কিন্তু বাংলাদেশ অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে দিয়েছে। তাও একদিন বাকি থাকতে। সাকিব আল হাসান একাই ১০টা উইকেট নিয়েছেন আবার ৮০ রানও করেছে। বলো কত খুশির খবর না?

দাদাই কাজলকে কাছে টেনে নিয়ে বললেন, হ্যাঁ দাদাই এটা খুব খুশির খবর। আবদুল জব্বার সেই ১৯৩৮ সালে জন্ম নিয়েছিলেন। উনি প্রায় ৭৯ বছর বয়স্ক ছিলেন। একজন মানুষের আয়ু এরচেয়ে খুব বেশি হয় না। হয়তো এ বছর না হলে পরের বছর খুব বেশি হলে আরও ১০ বছর উনি বাঁচতেন। তবে উনি যখন বেঁচে ছিলেন কিশোর ছিলেন, তরুণ ছিলেন, উনি একটা শ্রেষ্ঠ সময় পার করেছেন। উনি উনার সমগ্র শক্তি দিয়ে একটা দেশকে স্বাধীন করার চেষ্টা করেছেন। এখন এই দেশটাকে সুন্দর রাখার দায়িত্ব তোমাদের দাদাই। এই যে ক্রিকেট টিম তাদের কাজ যেমন সুন্দরভাবে করে যাচ্ছে। আমাদের সবাইকেই তা করতে হবে। তাহলেই আবদুল জব্বারের জীবনটা সার্থক হবে।