গ্রামের নাম কাঁকনডুবি

বইয়ের নাম: গ্রামের নাম কাঁকনডুবি

মাকসুদা আজীজবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 April 2017, 10:57 AM
Updated : 2 April 2017, 01:32 PM

লেখক: মুহাম্মদ জাফর ইকবাল

প্রকাশক: তাম্রলিপি

মুদ্রিত মূল্য: ৪০০ টাকা

মুক্তিযুদ্ধের গল্প তোমরা কতই না শুনেছো। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের দেশের মানুষদের কেমন কষ্টের জীবন গিয়েছে, কত মানুষ মরে গিয়েছে, কত মানুষের ঘর পুড়িয়ে দিয়েছে পাকিস্তানি হানাদার আর তাদের দেশি দোসর রাজাকারেরা। এত গল্প শুনতে শুনতে আর পড়তে পড়তে তোমাদের মনে হতেই পারে সব গল্প বুঝি তোমাদের জানা। তবে কি জানো মুক্তিযুদ্ধের সময় এতগুলো মানুষ এমন একটা ভয়ংকর সময় পার করেছে যে সবার কাছেই একটা অন্য রকমের গল্প আছে যুদ্ধকে ঘিরে। হোক সেই মানুষটা অতি বৃদ্ধ অথবা একদম শিশু।

গ্রামের নাম কাঁকনডুবি মুহাম্মদ জাফর ইকবালের একটি মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক উপন্যাস। তবে উপন্যাস বলে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। এই উপন্যাসটি লেখা হয়েছে একদম তোমাদের মতো ছোট ছট ছেলেমেয়েদের কথা চিন্তা করে। এমনকি গল্পের মূল যে চরিত্র রঞ্জুর তার বয়সও তোমাদের ধারে কাছেই। রঞ্জুর বাড়ি কাঁকনডুবি গ্রামের একপ্রান্তে। সেখানে রঞ্জুর সঙ্গে থাকে ওর নানী। রাক্ষুসে নদী কালি গাঙ এ ডুবে রঞ্জুর বাবা মা দুইজনই মারা গিয়েছেন। রঞ্জুকে নিয়ে তাই নানীর ভয় কাটেই না। সে সারাক্ষণই বকবক করে রঞ্জুকে সাবধান করে।

কাঁকনডুবি গ্রামটা অন্য সব গ্রামের মতোই। এখানে স্কুল আছে, বাজার আছে, চায়ের দোকান আছে, পাগল আছে এমনকি একটা ফালতু লোক মতি পর্যন্ত আছে।

স্কুলে গিয়ে আর দুষ্টুমি করে রঞ্জুর খুব ভালো দিন কাটছিল এমন সময় রঞ্জুদের স্কুলে পড়াতে আসেন মাসুদ ভাই। মাসুদ ভাই অন্য সব শিক্ষকদের মতো নন। তাই তাকে সহজেই স্যার না ডেকে ভাই ডাকা যায়। রঞ্জুরা সবাই মাসুদ ভাইয়ের ভক্ত হয়ে যায়। মাসুদ ভাই কত্ত জানেন কতকিছু করতে পারেন, আর এত্ত এত্ত তার পরিকল্পনা।

আগে যেখানে রঞ্জুরা স্কুলে যেত আর আসতো ক্লাস করতে রঞ্জুদের খুব একটা আনন্দ হতো না সেখানে মাসুদ ভাই আসার পরে সব বদলে গেলো। এখন সবাই স্কুলে যেতে চায়, মাসুদ ভাইয়ের গল্প শূনতে চায়, মাসুদ ভাইয়ের কাছ থেকে বই নিতে চায়। মাসুদ ভাইয়ের পরামর্শ ওরা একুশে ফেব্রুয়ারির দিন সকালে প্রভাত ফেরি করলো স্কুলে শহীদ মিনার বানালো। একদম হই হই রই রই ব্যাপার।

এমন চমৎকার দিনের মধ্যেও একটা কালো ছায়া এসে লাগলো সহসাই। দেশে যুদ্ধ লেগে গেলো। যদিও কাঁকনডুবি গ্রাম ঢাকা থেকে অনেক দূরে তাও মানুষ কেবল যুদ্ধ নিয়েই কথা বলা যুদ্ধের চিন্তাতেই অস্থির থাকে। এই চিন্তাকে আরও বাড়িয়ে দিতে কাজীবাড়ির বড় ছেলের পরিবার কাঁকনডুবি গ্রামে এসে জুটলো। সবাই বলাবলি করতে লাগলো কাজীবাড়ির বড় ছেলেকে নাকি পাকিস্তানীরা মেরে ফেলেছে। বড় ছেলের স্ত্রী আর দুই কন্যার মুখে যুদ্ধ দেখার আতঙ্ক গ্রামের মানুষদের চিন্তা আরও বাড়িয়ে দিলো।

সবাই যদিও ভাবছিলো এই অজ পাড়া গা কাঁকনডুবিতে আর কে আসবে যুদ্ধ করতে কিন্তু ব্যাপারটা তা রইলো না। হঠাৎ একদিন মাসুদ ভাই উধাও হয়ে গেলেন। লোকে বলে তিনি নাকি যুদ্ধ করতে গিয়েছেন। এদিকে ফালতু মতি দিব্যি চোখে সুরমা পরে পাকিস্তানীদের সঙ্গে জুটে গেল, আর রঞ্জুদের প্রিয় স্কুল হয়ে গেলো পাকিস্তানী সৈন্যদের ঘাঁটি।

রঞ্জু এমনি মানুষ ছট তবে সে যুদ্ধ এবং মৃত্যু বিষয়ে সচেতন। ওর চেষ্টায় গ্রামের হিন্দু পরিবাররা পালিয়ে জীবন বাঁচালো।    

এই বিশাল যুদ্ধের হুল্লোড়ে যেই কাজীবাড়িতে রঞ্জুরা ঢুকার কথা ভাবতেই পারতো না সেই বাড়ির বড় ছেলের ছোট মেয়ে ডোরার সঙ্গে রঞ্জুর খুব ভাব হয়ে গেলো। বাবাকে হারানোর পরে ডোরা খুব অন্যরকম হয়ে গিয়েছে। কারও সঙ্গে কথা বলে না, নিজের মতো থাকে। শুধু রঞ্জুর সঙ্গেই ওর যা বন্ধুত্ব।

মাসুদ ভাইয়ের কথা ভেবে ভেবে রঞ্জুও ঠিক করে সে মুক্তিযুদ্ধে যাবে। যদিও সে জানে না এত ছোট মানুষ সে কীভাবে যুদ্ধে যাবে। রঞ্জুর সঙ্গে যুদ্ধে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে বসে আছে ডোরাও। সে একদম চুল কেটে ছেলেদের মতো পোশাক পরে যুদ্ধে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে ফেলে। কেউ যেন না বুঝে ও একটা মেয়ে তাই নামও বদলে “খোকন” রেখেছে।

হানাদারদের অত্যাচার থেকে যখন সবাই জান বাঁচাতে ব্যস্ত তখন এই দুইটি শিশু নেমে যায় যুদ্ধের ময়দানে। কেমন হলো ওদের যুদ্ধ আর কীভাবেই বা ওরা মূল যোদ্ধাদের অংশ হতে পারলো এই নিয়ে গল্প গ্রামের নাম কাঁকনডুবি। বইয়ে খুব সুন্দর কিছু লাইন আছে যা তোমাদের মুক্তিযুদ্ধের স্বরূপ বুঝতে সাহায্য করবে।

মুহাম্মদ জাফর ইকবালের মুক্তিযুদ্ধের কিশোর উপন্যাস বললেই আমার বন্ধু রাশেদের নাম চলে আসে অবধারিতভাবেই। সেই অসাধারণ উপন্যাসটির সঙ্গে গ্রামের নাম কাঁকনডুবির কোনো মিলই খুঁজে পাবে না। এটা একটা অন্য গল্প, অন্য জীবন, অন্য রকমের রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। এই গল্পের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হচ্ছে যুদ্ধে নারীদের অংশগ্রহণ আর অবদান চমৎকারভাবে তুলে ধরা। উপন্যাসের একদম শেষে এসে একজন বীরাঙ্গনা যখন বলে উঠেন, তোমাদের যুদ্ধ শেষ, আমাদের যুদ্ধ মাত্র শুরু। তখন নিমেষেই তুমি যুদ্ধপরবর্তী বীরাঙ্গনাদের জীবনের সংগ্রাম আর অশেষ বঞ্চনার কথা জেনে যাবে এই একটা বাক্যের মধ্য দিয়ে।

মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক আলোচনা, বই, সিনেমা, যাদুঘর দর্শন ইত্যাদি আমরা যুদ্ধের বিভিন্ন স্মরণীয় দিনকে সামনে রেখে করি। তবে একটা দেশের গল্প শুধু কিছু দিনের নয়, মুক্তিযুদ্ধও কিছু দিনের গল্প নয়। এটি আমাদের একটা আত্ম উপলব্ধির বিষয়, আমাদের হৃদয়ে ধারণের বিষয়। একটা বিরাট যুদ্ধই দাঁড়িয়ে আছে আমাদের জীবনের ভিত্তি হিসেবে। আমরা যদি আমাদের দেশের এই ভিত্তিটাকেই ভালোভাবে ধারণ করতে না পারি তবে দেশকে আমরা সঠিকভাবে সামনে নিয়েও যেতে পারবো না।