জয়নুল: আঁকাআঁকি যার রক্তে মেশা

জয়নুল আবেদিন। এই নামটা আমরা কতই না শুনেছি। আমাদের প্রায় সবারই এই নামে কোনো না কোনো পরিচিত লোক আছেন। তবে এই নামটাকে যিনি এত জনপ্রিয় করে গিয়েছেন তার নাম হলো, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন। তোমরা কি জানো তিনি কে ছিলেন? তিনি বাংলাদেশের একজন সবচেয়ে বিখ্যাত চিত্রশিল্পী।

মাকসুদা আজীজবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 Dec 2016, 10:42 AM
Updated : 29 Dec 2016, 03:04 PM

জয়নুল যখন তোমাদের বয়সী ছিল তখন থেকেই তিনি আঁকতে খুব ভালোবাসতেন। প্রতিদিনই এইটা সেইটা একে সবাইকে দেখাতেন। তার আশেপাশে যাই থাকুক না কেন উনি ঠিক ঠিক তার ছবি এঁকে ফেলতেন। সবাই অবাক হয়ে দেখত, আরে জয়নুল তো শুধু জিনিসটার ছবি আঁকে তাই না, জিনিসটার ভিতরে থাকা কোনো একটা কথাও তুলে আনে কী সুন্দর করে!

জয়নুলদের বাড়ি ময়মনসিংহ জেলার কেন্দুয়ায়। এখন এই কেন্দুয়া কিশোরগঞ্জের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে কিন্তু জয়নুল যখন জন্ম নিয়েছেন সেটা ময়মনসিংহ ছিল। গ্রামীণ পরিবেশে কত কিছু ছিল দেখার। বাড়ির পেশেই ব্রক্ষ্মপুত্র নদ, গাছ, পাখি, মাছ, নতুন ফসল, ফসল বোনা থেকে কাটা পর্যন্ত কিষাণ-কিষাণীর সংগ্রাম, নতুন ফসল উঠলে গ্রাম জুড়ে শুরু হওয়া উৎসব। ছোট্ট জয়নুল মুগ্ধ নয়নে এই সব দৃশ্য দেখতেন। এইসব দৃশ্যের ছবি এঁকে ফেলার জন্য খুব ছটফট করতেন।

জয়নুলের মা জয়নাবুন্নেসার মোট নয়জন সন্তান ছিল। জয়নুল তাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় আর একদমই আলাদা। আমরা যে সময়ের কথা বলছি তখন বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে শিক্ষা শিল্প ইত্যাদি বিষয় তেমন একটা প্রচলন হয়নি। জয়নুলের এই আঁকাআঁকি যে বিরাট একটা শিল্প হতে পারে সে ধারণা প্রায় কারও ছিল না। জয়নুলের বাবা তমিজউদ্দিন আহমেদ পুলিশের দারোগা। তার স্বপ্ন তার সন্তানরা লেখাপড়া করে বড় হবে।

একবার কার কাছে যেন জয়নুল শুনে আসলেন কলকাতায় ছবি আঁকিয়েদের জন্য স্কুল আছে। সেখানে হাতে ধরে ছবি আঁকা শেখানো হয়। জয়নুলের খুব শখ হলো স্কুলটাকে নিজে চোখে দেখে আসে। তবে বাসায় কাউকে রাজি করানো গেল না। তবে জয়নুলের পথ রোধ করার সাধ্যি কার? ঠিক ঠিক বন্ধুদের নিয়ে কলকাতা চলে গেলেন।

কলকাতার গভর্নমেন্ট স্কুল অফ আর্টস। চারিদিকে সবাই শুধু শিল্প নিয়েই মত্ত। এদিকে কেউ মানুষের ছবি আঁকছে তো ঐদিকে কেউ প্রকৃতির। কারও হাতে রং তো কারও হাতে চারকোল। জয়নুল আর চোখ ফেরাতে পারেন না। কী সুন্দর স্কুল! কী সুন্দর সবার চিন্তা ভাবনা। এখানে খাতার পাতায় ছবি এঁকে ফেললে কেউ বকুনি দেয় না, বরং সবাই যার যার মতো কাগজ নিয়ে মনের ভাবনাকে তুলে ধরতে ব্যস্ত।

বাড়ি ফিরে আর তো জয়নুলের মন বসে না। এ কেমন স্কুলে তাকে যেতে হয়! এই পড়ালেখা তো আর জয়নুলের ভালো লাগে না। তার মন জুড়ে শুধুই কলকাতার সেই আর্টস স্কুল। আচ্ছা এই দিকে এমন একটা স্কুল তৈরি হতে পারে না? ধারে কাছে? তাহলেই তো জয়নুল সেই স্কুলে যেতে পারে।

জয়নুলের সেই স্কুল তৈরির স্বপ্ন পূরণ করতে হয় জয়নুলকেই। তবে তা অনেক পরের কথা। তার আগে জয়নুল কীভাবে নিজের আঁকতে শিখার শখ মিটান জানো?

কলকাতা ঘুরে এসে অনেক ভেবে বুঝে জয়নুল ঘোষণা দিলেন এই স্কুলে আর সে যাবে না। এই লেখাপড়া তার ভালো লাগে না। সে কলকাতায় যেতে চায়। আরও আঁকা শিখতে চায়। জয়নুলের বাবা তো খুব রেগে গেলেন। সামনে তার মাধ্যমিক পরীক্ষা। সে সব বাদ দিয়ে এ আবার কী ধরণের আবদার!

সবার অমতে এবং সবার সাথে অভিমান করে ১৯৩৩ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষা বাদ রেখেই জয়নুল চলে গেলেন কলকাতা। তিনি আর্ট স্কুলে পড়বেন মানে পড়বেনই। তবে সবাই যে অমত করেছিল এমন না। জয়নুলের মা ছেলের উপর বিশ্বাস রেখেছিলেন। তিনিই নিজের গহনা বিক্রি করে ছেলেকে কলকাতা পাঠান।

১৯৩৩ থেকে ১৯৩৮ দীর্ঘ পাঁচ বছর জয়নুল কাটান কলকাতার গভার্মেন্ট স্কুল অফ আর্টসে। সেখানে তিনি চিত্রকলা শিখেন অন্য ধরণের শিল্পকলাও শিখেন। তবে এখানে এসেও জয়নুলের মন পরে থাকে তার বাড়ি পূর্ববঙ্গে। যেখানে গাছ পালা মাটি মাছ পাখি সব থাকে জয়নুলের চিন্তা জুড়ে। তার মন ভেসে বেড়ায় প্রিয় ব্রক্ষ্মপুত্র নদে। তবে তাই বলে জয়নুল তার লেখাপড়ায় ফাঁকি দেন না। তিনি প্রাণ উজাড় করে শিল্প শিখে নেন। আর ১৯৩৮ সালে তার মা জয়নাবুন্নেসার মুখ উজ্জ্বল করে কলকাতার গভার্মেন্ট স্কুল অফ আর্টসের ড্রয়িং এ্যান্ড পেইনটিং ডিপার্টমেন্ট থেকে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অর্জন করে স্নাতক পাশ করেন।

সে বছরই জয়নুলের একটা ছবি সর্ব ভারতীয় চিত্রকলা প্রদর্শনীতে খুব সারা ফেলে দেয়। জলরঙে আঁকা ছবিটা ছিল ব্রক্ষ্মপুত্র নদের, এই নদকে জয়নুল তার হৃদয়ে নিয়ে ঘুরেন। ছবিটি এতই জনপ্রিয় হয় যে জয়নুল এই ছবির জন্য স্বর্ণপদক লাভ করেন।

তোমরা হয়তো জানো আমাদের দেশের শিক্ষা-দীক্ষার সব ক্ষেত্রেই পাশ্চাত্য বিশেষ করে ইউরোপীয় রীতি অনুসরণের প্রয়াস খুব বেশি। তখন সময়টাও ছিল ইংরেজ শাসন। তাই সবখানেই তাদের প্রাধান্য। চিত্রকলার ক্ষেত্রেও এর ব্যাতিক্রম ছিল না। তবে ইউরোপীয় রীতির এই অন্ধ অনুসরণ জয়নুল মেনে নিতে পারতেন না। তিনি স্বাধীনভাবে আঁকতে চাইতেন। এই স্বর্ণ পদক প্রাপ্তির মাধ্যমে তার নিজের তৈরি স্বাধীন ধারাও একটা স্বীকৃতি পেয়ে যায়।

এরপর জয়নুল আর পিছনে ফিরে তাকাননি। প্রতিদিন নিজের মতো এঁকে তিনি বেশ ভালো সময় কাটাচ্ছিলেন। হঠাৎ ১৯৪৩ সালে দেশে দুর্ভিক্ষ লাগে। কলকাতার পথে পথে দেখতে পাওয়া যায় হাড্ডিসার দরিদ্র মানুষের শব দেহ। গ্রামাঞ্চলের মানুষের অবস্থা আরও খারাপ। ডাস্টবিনের পাশে বসে মানুষ আর কুকুর উচ্ছিষ্ট খাবার খাওয়ার যুদ্ধে নেমে যায়।

এই দুর্ভিক্ষের জন্য অনেকটাই দায়ী ছিল তৎকালীন ইংরেজ শাসকেরা। তারা এই দেশের মানুষের সম্পদ নিয়ে গিয়ে নিজেদের দেশ সাজিয়েছে স্বারম্বরে। এদিকে এদেশের মানুষ সামান্য বেঁচে থাকার খাদ্যটুকুর অভাবে গণহারে মরে যাচ্ছে। এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে উত্তাল হতে থাকে সমগ্র ভারত। জয়নুলও তার প্রতিবাদের পথ খুঁজে নেন ছবি আকার মধ্য দিয়ে।

খুব সামান্য কিছু উপকরণ, প্যাকিং পেপার, চাইনিজ ইংক আর তুলির আঁচড়ে রেখাচিত্র এঁকে জয়নুল তার ক্যানভাসে তুলে আনেন দুর্ভিক্ষের ভয়াবহতা।

দুর্ভিক্ষ শেষ হয়। তবে ভারত থেকে ইংরেজদের উৎখাত করার আন্দোলন তুঙ্গে উঠে। ইংরেজরা যাওয়ার সময় দেশ ভাগ করে রেখে যায়, ভারত ও পাকিস্তান। জয়নুল আবার ফিরে আসেন তার নিজ ভূমি পূর্ববঙ্গে। এর নাম এখন পূর্ব পাকিস্তান।

জয়নুল ফিরে এসে দেখলেন তিনি পূর্ববঙ্গকে যেমন রেখে গিয়েছিলেন এখানকার শিল্পকলা এখনও সেখানেই পরে আছে। এখনও যদি ছোট কোনো জয়নুলের চিত্র শিল্পী হওয়ার শখ জাগে তার ঘরের পাশেই কোনো স্কুল নেই। দেশ ভাগ হয়ে যাওয়ার কারণে কেউ চাইলেই এখন কলকাতা গিয়ে পড়তে পারবে না। জয়নুল আবার মাঠে নামেন তার ছোটবেলার সেই শখকে অন্য হাজার কচি শিল্পীর মধ্য দিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে।       

১৯৪৮ সালে পুরানো ঢাকার জনসন রোডে যেখানে ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে রয়েছে তখন সেখানে তখন ছিল ন্যাশনাল মেডিকেল স্কুল। সে স্কুলের একটা জীর্ণ বাড়িতে জয়নুল আবেদিন মাত্র ১৮ জন শিক্ষার্থী নিয়ে গভর্নমেন্ট আর্ট ইন্সটিটিউটের যাত্রা শুরু করেন। জয়নুল আবেদিন ছিলেন এর প্রথম শিক্ষক। ১৯৫১ সাল নাগাত স্কুলটা সেগুনবাগিচার একটা বাড়িতে স্থানান্তরিত হয়। ১৯৫৬ সালে অবশেষে শাহবাগে একটা স্থায়ী জায়গা পায় জয়নুল আবেদিনের সেই আর্টের স্কুলের স্বপ্ন।

১৯৬১ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার এই স্কুলকে প্রথম শ্রেণির সরকারি কলেজের মর্যাদা দেন। তখন এর নাম হয়, পূর্ব পাকিস্তান চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়। স্বাধীনতার আগে পর্যন্ত এই নামেই দিব্যি ইন্সটিটিউট চলতে থাকে। এই ইন্সটিটিউট থেকে আরও অনেক নামী ও গুণী কারু শিল্পী, ছবি আঁকিয়ে বের হতে থাকেন। জয়নুল আবেদিন ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত এই কলেজের অধ্যক্ষ পদে থাকেন। দেশ স্বাধীনের সংগ্রামেও এই কলেজের ছাত্র ছাত্রীরা খুব জোরালো ভূমিকা রাখেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পরে এই কলেজের নাম হয় বাংলাদেশ চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়। লোকে একে আর্ট কলেজ নামেই চিনত।

১৯৮৩ সালের ১ সেপ্টেম্বর জয়নুলের সেই স্বপ্নের আর্ট স্কুল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অনুষদ হিসাবে গৃহীত হয়। আজ তোমরা এটিকে চারুকলা নামে চিনে থাকো। পহেলা বৈশাখে এই চারুকলা ইন্সটিটিউট থেকে মঙ্গল শোভাযাত্রা বের হয়।  

জয়নুল আবেদিন বাংলাদেশে চারুকলার বিস্তারের জন্য আরও অনেক কাজ করেছেন। তার প্রচেষ্টাতেই নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে লোকশিল্প জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করা হয়।

জয়নুল আবেদিন মারা যান ১৯৭৬ সালের ২৮ মে। আর ১৯১৪ সালের আজকের দিনে মানে ২৯ ডিসেম্বর তিনি জন্ম নিয়েছিলেন। ময়মনসিংহে ব্রক্ষ্মপুত্রের পাড়ে বেড়ে উঠা জয়নুল তার ভিতরে থাকা শিল্পী সত্ত্বা দিয়ে বার বার পৃথিবীকে নাড়া দিয়েছেন। তার আঁকা দুর্ভিক্ষের ছবি, সংগ্রাম, ঝড় সাঁওতাল রমণী অনেক সুনাম অর্জন করে। ১৯৭০ সালে তিনি বাংলাদেশের নবান্ন উৎসব নিয়ে ৬৫ ফুট দীর্ঘ একটি ছবি আঁকেন। সেই ছবিটির নাম ‘নবান্ন’। এটি জয়নুলের বিখ্যাত একটি সৃষ্টি।

ঢাকার আর্ট স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্যই শুধু নয়, পূর্ববাংলায় চারুকলার পুরোধার হিসেবে অবদান রাখার জন্য তাকে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন বলে লোকে চিনে। তোমরা যদি বাংলাদেশের জাতীয় জাদুঘরে যাও তবে দেখবে ৩৬ নম্বর গ্যালারিটি তার শিল্পকর্ম দিয়ে সজ্জিত করা হয়েছে। ১৯১৬ সালে এটি জাতীয় জাদুঘরে যোগ করা হয়েছে। এর নাম শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন চিত্রশালা।

তবে জয়নুল আবেদিনের অবদান এতই বড় যে এটা শুধু পৃথিবীতে সীমাবদ্ধ রাখা যায়নি। ২০০৯ সালে বুধ গ্রহের একটা জ্বালামুখকে ‘আবেদিন’ নামে নামকরণ করা হয়েছে জয়নুল আবেদিনের সম্মানে।

গুণী এই শিল্পীকে তার জন্মদিনে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।