মিউমিউ আর নতুন বাবুর গল্প

মিউমিউয়ের মনটা খারাপ। মা আজ তাকে সারাদিন কোলে নেয়নি, আদর করেনি, চুমু দেয়নি। সকাল থেকেই তাই বড্ড কান্না পাচ্ছে মিউমিউয়ের। মায়ের ওপর অভিমানও হচ্ছে খুব। তাই নিজেই আর মায়ের কাছে ঘেষেনি। কিন্তু দুপ্পুর বেলা, খা খা রোদ যখন, তখন বারান্দায় রাখা বাক্স থেকে নেমে পায়ে পায়ে মায়ের ঘরে গেল মিউমিউ। নাহ, মায়ের গায়ের গন্ধ ছাড়া ঘুম আসে না তার। তাই গেল। গিয়ে দেখে মা বিছানায় শুয়ে আছে। চোখ দুটো বন্ধ। কী করবে ভেবে পায়না মিউমিউ। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর আস্তে আস্তে মা’কে ডাকে।

>>শারমিন শামস্বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 Nov 2016, 10:20 AM
Updated : 21 Nov 2016, 01:25 PM

- ম্যাও- মাআআওও....মাআআআ....আও

মা চোখ মেলে তাকায়।

- আয় আয়...আমার সোনা...খেয়েছিস?

- ম্যাওও

- আসো মা’র কাছে আসো।

লাফ দিয়ে বিছানায় উঠে মায়ের কাছে এসে তার হাত পা মুখটা শুঁকে তারপর জিব বের করে মাকে চেটে দেয় মিউমিউ। মাও আদর করে। মাথায় গায়ে হাত বুলায়। আদর-টাদর নিয়ে মায়ের কোল ঘেঁষে শুয়ে পড়ে মিউমিউ। আরামে চোখ বুজে রাখে।

মিউমিউ একটা বিড়ালছানা। আসছে মে মাসে ওর বয়স এক বছর হবে। মা বলেছে, সেদিন কেক কাটা হবে। মিউমিউ সেইজন্য দিন গুনছে। কবে হবে জন্মদিন, কবে কাটা হবে কেক! কেক তার প্রিয়।

মিউমিউ বিড়ালছানা হলেও, তার মা মানুষ। তাতে কী? এটাই তার মা। যখন মিউমিউয়ের চোখ ফোটেনি, মাত্র দু’দিন বয়স, মা তাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে এসেছিল বাসায়। তারপর তুলো দিয়ে চোখ মুছে, যত্ন করে, ফিডারে করে দুদু খাইয়ে বড় করে তুলেছে। তার নাম রেখেছে মিউমিউ। মায়ের সাথে কথা কইতে কইতেই মিউমিউ শিখে ফেলেছে মানুষের ভাষা। এখন তো মিউমিউয়ের নিজেকে আর বিড়াল বলে মনেই হয় না। তার মনে হয়, সেও একটা মানুষের বাবু।

তো সেই মিউমিউয়ের মায়ের শরীর ভালো নয়। মিউমিউ দেখে, মা শুধু শুয়ে বসেই থাকে। অফিসেও যায় না। বাবাও খুব যত্ন নেন মায়ের। বলেন, ‘এটা খাও ওটা খাও। আস্তে হাঁটো।’ ব্যাপার কিছু বোঝে না মিউমিউ। হঠাৎ করে এ কী হলো মায়ের। মন খারাপ মন খারাপ। কিচ্ছু ভালো লাগে না ওর। খালি ইচ্ছে করে মায়ের কাছে শুয়ে থাকতে। কিন্তু বাবা রাগ করেন। বলেন, ‘যাও যাও মিউমিউ, নিজের বিছানায় গিয়ে ঘুমাও।’ আর মা’কে বলেন, ‘এই সময় বিড়ালটাকে একটু দূরে দূরে রাখো।’ তাই শুনে মাও রাগ করেন। বাবাকে বলেন, ‘আমি ভালোমতো পড়ালেখা করেছি। বিড়াল থাকলে কিচ্ছু হবে না। আমাদের মিউমিউ ইনডোর ক্যাট। তাছাড়া ওর টিকা দেয়া আছে। আর ওর লিটার তো আমি আর পরিষ্কার করি না। রুনার মা’ই তো সব করছে। তুমি এত ভেবো না।’

বাবা তাও খুশি হন না। বিছানায় উঠলেই ওকে সরিয়ে দেন। বাবার ওপর বড্ড রাগ হয় মিউমিউয়ের। যদিও বাবাও তাকে ভালোবাসেন। একবার পাঁচতলার বারান্দা থেকে পা ফসকে সে নিচে পড়ে গিয়েছিল। ইস কী ব্যথাটাই না পেয়েছিল সেবার। ভাগ্য ভালো হাত পা কিছু ভাঙেনি। কিন্তু ব্যথায় জ্বর হয়েছিল। সেবার বাবাই তাকে পাশের বাড়ির সান-শেড থেকে উদ্ধার করে এনেছিল। বাবা ফিরে দেখলেন মা খালি কাঁদছে। ভারি অপরাধ বোধ হচ্ছিল মিউমিউয়ের। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিল, আর কক্ষনো দুষ্টুমি করবে না বারান্দায় গিয়ে। যাই হোক, সেবার জ্বর হলো খুব। তখন বাবাই তাকে বারবার ওষুধ খাইয়ে দিয়েছিলেন। কোলে নিয়ে রেখেছেন। কিন্তু তারপরও মায়ের চেয়ে বেশি তাকে কেউ ভালোবাসে না। সেই মায়ের অসুখ। মিউমিউ এখন কী করে?

মায়ের এমন শরীর খারাপ নিয়েই দিন কাটছিল। সকালে মা অনেক বেলা করে ঘুমায়। এজন্য সকালের নাস্তা তাকে দেয় রুনার মা। রুনার মাকে একটুও ভালো লাগে না মিউমিউয়ে। সে তাকে ডাকে, ‘বিলাই’ বলে। বলে, ‘এ্যাই বিলাই এ্যাই, আয় খানা খা’। বলে ক্যাটফুড ঢেলে দেয় বাটিতে। পানি দেয়। মেজাজ খারাপ হয়ে যায় মিউমিউয়ের। ‘ক্যানো, আমার কি নাম নাই নাকি? মিউমিউ বলতে পারো না? বিলাই বলো কেন?’ সে অনেক ম্যাও ম্যাও করে রুনার মা’কে বলে কথাগুলো। রুনার মা শুনেও শোনে না। একটু পরে বলে, ‘হইসে, ম্যালা চিলাফাল্লা করছো, এহুন থামো, তোমার আম্মায় জাইগা যাব’।

মা জেগে যাবে জেনে মন খুশি হয়ে যায় মিউমিউয়ের। সে অপেক্ষায় থাকে কখন জাগবে মা। একটু পরে ঘুম থেকে ওঠে মা। পরোটা আর চা খায়। ডিম খায়। শরবত খায়। একটুখানি পরোটা ছিঁড়ে মিউমিউকে দেয়। মায়ের পায়ের কাছে গড়াগড়ি খায় মিউমিউ। মা হাসে। কিন্তু গায়ে হাত বুলায় না। দূর থেকে শুধু আদর আদর কথা বলে।

এমনি করেই চলছিল। হঠাৎ একদিন দেখে মা একটা ব্যাগ গুছাচ্ছেন। বাবাও হেল্প করছেন। নানুও এসেছেন। রুনার মা ছোটাছুটি করে এটা ওটা এনে দিচ্ছে। কোথায় যাচ্ছে মা? কোথায়? কবে আসবে? নাকি মিউমিউকে সাথে নিয়ে যাবে? ভারি চিন্তায় পড়ে যায় মিউমিউ। বাবা মাকে বলে, ‘তুমি বসো, আমি গুছিয়ে দিই।’ ছোট্ট ব্যাগটা গুছিয়ে মাকে আর নানুকে নিয়ে বাবা চলে যায়। যাওয়ার আগে রুনার মাকে অনেক কিছু বুঝিয়ে দিয়ে যায়। রুনার মা বলে, ‘কুনো চিন্তা করবেন না ভাইজান। আপনি আপারে দেইখেন’।

যাওয়ার আগে মা মিউমিউয়ের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ে।

- যাই সোনা, আমার বাবুটা, লক্ষ্মী হয়ে থেকো, আচ্ছা!

মিউমিউ ভারি অবাক হয়। এতসব ব্যাগ ট্যাগ নিয়ে কই যাচ্ছে মা? আর তাকে কোলেই বা নিচ্ছে না কেন? এর আগে একবার বাবা আর মা বেড়াতে গিয়েছিলেন। সেবার যাবার আগে তাকে কোলে চেপে ধরে কত্ত আদর মায়ের। এবার হলোটা কী?

আবার অভিমান চেপে বসে মিউমিউকে। মুখ ভার করে সোফার পিছনে গিয়ে লুকিয়ে থাকে। রাতের খাবার দিয়ে রুনার মা যখন তাকে ডাকে, ‘আয় আয় মিউমিউ, খেতে আয়’, তখনও সে সোফার পিছন থেকে বেরিয়ে আসে না।

তিন তিনটে দিন পার হয়, মায়ের কোনো খোঁজ নাই। বাবা আসেন একবার করে। তার দিকে ফিরেও তাকায় না। তবে রুনার মাকে জিজ্ঞেস করে, ‘মিউমিউকে খেতে দিয়েছো রুনার মা?’ এইটুকুই। রাগে অভিমানে মিউমিউ গেস্ট রুমের আলমারির উপরে উঠে বসে থাকে। রুনার মা ডাকলে সাড়া দেয় না। তাকে সারা বাড়ি খুঁজে খুঁজে হয়রান রুনার মা রাগে গজগজ করে।

তিনদিন তিনরাত পর হঠাৎ মিউমিউ দেখে নানু এসেছেন। এসেই বাসাটা ঝকঝকে তকতকে করছেন। বিছানার চাদর পাল্টাচ্ছেন। ডেটল দিয়ে ঘর মুছছে রুনার মা। ঘটনা কী? ম্যাও ম্যাও করে জানতে চায় মিউমিউ নানুর কাছ ঘেঁষে ঘেঁষে। নানু কোন উত্তর দেন না। একমনে কাজ করে যান।

হঠাৎ গাড়ির হর্ন। নানু আর রুনার মা ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। ছুটে গিয়ে দরজা খুলে দাঁড়ায়। মাকে নিয়ে ঘরে ঢোকেন বাবা। সাথে নানা আর দাদীও আছেন দেখছি। মাকে দেখে খুশিতে অস্থির মিউমিউ মাকে ঘিরে দৌড়ায় আর ম্যাও ম্যাও করে ডাকে। মা হাসে। ওমা, দাদীর কোলে ওটা কী? একটা সাদা তোয়ালে দিয়ে প্যাঁচানো? কী জিনিস? নানু আর রুনার মা তো ওটা দেখেই খুশিতে হাসছে। মিউমিউয়েরও ভারি কৌতূহল হয়। কী গো ওটা? দেখে, মা বাবা দাদী নানা নানু সবাই মিলে ওই পোটলাটা নিয়ে শোবার ঘরে ঢুকছেন। মিউমিউও ছুটে যায়। দাদী বলেন, ‘এ্যাই এ্যাই বিড়ালটাকে সরা’। বাবা বলে, ‘মিউমিউ যাও।’ মা কিচ্ছু বলে না। চুপ করে থাকে। অভিমানে গলা ধরে আসে মিউমিউয়ের। দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে ও। হঠাৎ টোপলার ভেতর থেকে ক্যা ক্যা ক্যা করে কেঁদে ওঠে কী যেন। নাহ, আর ধৈর্য রাখা সম্ভব হচ্ছে না। একলাফে বিছানায় উঠে বসে মিউমিউ। সবাই চেঁচিয়ে ওঠে সাথে সাথে। আরে আরে আরে সরাও বিড়াল। বাচ্চার অসুখ হবে। এসব কথা কানে যায় না মিউমিউয়ের। সে অবাক হয়ে দেখে কাপড়ে মোড়ানো একটা ছোট্ট কী যেন। ওমা, মা কি আরেকটা বিড়াল নিয়ে এসেছে! তাই যদি হয়, এইবার এসপার কি ওসপার হবে। হয় মিউমিউ থাকবে, নাহয় থাকবে এই বিড়াল। কিন্তু একি! এ যে মানুষের মতো লাগছে। মানুষই তো। ছোট্ট একটা মাথা। ছোট ছোট চোখ নাক কান ঠোঁট আর বড় বড় গাল। সেই মানুষটাই ট্যাঁ ট্যাঁ করে শব্দ করছে। এ কি কাণ্ড! এ কোথা থেকে এলো? মিউমিউ ম্যাও ম্যাও করে ডেকে মায়ের কাছে ছুটে যায়।

মা বলেন, এটা আমাদের নতুন বাবু। তোমার বোন।

দাদী রেগে যান। নানুও।

- এসব কী? বিড়াল সরাও। বিড়াল সরাও।

কিন্তু মা কিচ্ছু বলেন না। নিচু হয়ে মিউমিউকে কোলে তুলে নেন মা।

- মিউমিউ, সোনামণি, এইটা আমাদের ছোটবাবু। তুমি আর কয়েকদিন পরেই ওর সাথে খেলতে পারবে। কিন্তু এখন একটু ওইদিকে যাও বাবা।

মিউমিউ তো বোঝে মায়ের কথা। তাই সরে আসে। ড্রইংরুমের ডিভানে গিয়ে বসে থাকে। দেখে সবাই নতুন বাবুকে নিয়ে ব্যস্ত। তাকে কেউ খেয়াল করে না। বাবুর কাছেও যেতে দেয় না। এসব দেখতে দেখতেই কখন ঘুম পেয়ে যায় মিউমিউয়ের। সে ঘুমিয়ে পড়ে।

পরদিন দেখে বিছানায় ঘুমাচ্ছে বাবুটা। আর দাদী একটা লাঠি নিয়ে বসে আছে। পায়ে পায়ে ঘরে ঢুকতে চায় মিউমিউ। কিন্তু তেড়ে আসে দাদী। আরে! কী ভয়ংকর! ভারি রাগ হয় মিউমিউয়ের। ও তো চায় বাবুটাকে দেখতে। কিন্তু এরা এমন করছে কেন? মন খারাপ করে ঘরের বাইরে পাপোষে বসে ঝিমায় মিউমিউ। হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে যায়। দেখে পুরো বাড়ি চুপচাপ। বাবুটাকে বিছানায় ঘুম পাড়িয়ে পাশের সোফায় শুয়ে ঘুমাচ্ছে দাদী। মা গেছে বাথরুমে। রুনার মা কিংবা বাবা কেউ কোথাও নেই। সব দেখেশুনে এই সুযোগে পা টিপে টিপে বিছানায় উঠে আসে মিউমিউ। ইস, কী সুন্দর এই বাবুটা। কী সুন্দর! কী ফোলা ফোলা গাল। আর কী আদুরে! কী মিষ্টি একটা ঘ্রাণ আসছে ওর গা থেকে। আনন্দে চোখে পানি চলে আসে মিউমিউয়ের। এবার থেকে এই বাবুটার সাথেই খেলতে পারবে ও। কী আনন্দ। ওর সাথেই ঘুমাবে। ওর সাথেই বসে টিভিতে দেখবে টম এন্ড জেরি। এসব ভাবতে ভাবতেই নতুন বাবুটার গা ঘেঁষে শুয়ে পড়ে মিউমিউ। নতুন বাবুটার গায়ের ঘ্রাণ নিতে নিতেই কখন যে ঘুমিয়ে পড়ে কে জানে!

বাথরুম থেকে বের হয়ে এসে মা দেখে বাবুর পায়ের কাছে গুটিসুটি মেরে ঘুমোচ্ছে মিউমিউ। ততক্ষণে জেগে গেছে দাদী। এসেছে বাবাও। দাদী তার লাঠিটা হাতে নিতেই চোখের ইশারায় তাকে ‘না’ করেন মা।

- কিচ্ছু হবে না মা। ওকে ওর মতো থাকতে দিন। মিউমিউও আমার বাচ্চা। যদি বিড়ালছানা কুকুরছানার কারণে মানুষের কোন ক্ষতিই হতো, তবে আল্লাহ ওদের সৃষ্টিই করতেন না। ওরা তো গৃহপালিত। ওরা ঘরের কল্যাণ। দেখবেন ওরা দুজনে মিলে সুন্দর বড় হবে।

কথাগুলো বলে মিষ্টি করে হাসেন মা। দাদী চুপ করে থাকেন। মটকা মেরে শুয়ে শুয়ে সব কথা শুনতে পায় মিউমিউ। একটু পরেই টের পায় দাদী এগিয়ে এসে নতুন বাবুটার কাঁথাটা ভালো করে ওর গায়ে টেনে দিলেন। তারপর মিউমিউয়ের মাথায় ঘাড়ে পিঠে হাত বুলালেন বার দুয়েক। আদর আর আরাম পেয়ে চোখটা বুজে আসে মিউমিউয়ের। তবু দাদীকে থ্যা্ংকস দিতে ভোলে না। ঘুম মাখা গাঢ়স্বরে বলে, ‘ম্যাঅ্যাঅ্যাঅ্যা্ওওও’।