সেদিন খুব হুল্লোর হলো এরপর দুপুরে ভুরিভোজের পরে সবাই একটু গড়িয়ে নিচ্ছিল, এমন সময়ে বাবা বললেন-‘তোমরা তো ঈদের নামাজ পরতে ঈদগাহে গিয়েছো, তাই না? বলো তো, বাংলাদেশে সবচে প্রাচীন ঈদগাহটি কোথায় আছে?”
ঐতিহ্যের ফুফাতো ভাই শান্ত বলে উঠলো, ‘আমি জানি মামা, এটা আমাদের ধানমণ্ডিতেই আছে। তবে আমরা এখনও দেখিনি, চলো না মামা আজ সবাই মিলে ঘুরে আসি সেখান থেকে’।
অন্যরা সবাই হৈ হৈ করে শান্তর কথায় সমর্থন দিলো। সুতরাং বিকেলের নরম রোদে সভ্যতা-ঐতিহ্যের বাবা; আবীর সাহেব একদল বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে বেড়িয়ে পরলেন ‘ধানমন্ডির শাহি ঈদগাহের’ উদ্দেশ্য। পথে যেতে যেতে ‘ঈদগাহ’ কী সেটা সহজ করে বুঝিয়ে বললেন ওদের- ‘ দ্বিতীয় হিজরিতে আরবে জামায়েতের মাধ্যমে ঈদের নামাজ আদায় করা হতো খোলা প্রান্তরে। সেই প্রান্তরের সীমানা নির্ধারণ করা হতো পাগরী এবং বর্শা দিয়ে যাদের বলা হত যথাক্রমে সুতরা এবং আনজা। এ থেকেই মূলতঃ ঈদগাহ স্থাপত্যের সূচনা হয়। ঈদগাহের সাথে মসজিদের পার্থক্য হলো, মসজিদ যেমন একটি ইমারত, ঈদগাহ তেমন কোনো ভবন বা স্থাপনা না। এটা একটা খোলা চত্বর যেখানে মিহরাব, মিম্বার ইত্যাদি মসজিদের মতো উপাদান থাকতে পারে। বাংলাদেশে প্রাচীন ঈদগাহ বলতে এই ধানমন্ডি ঈদগাহ আর সিলেটের শাহী ঈদগাহ। এর মধ্যে ধানমণ্ডির ঈদগাহটা আবার মুঘল আমলের বাংলার সর্ব প্রাচীন স্থাপত্য নিদর্শণ।
ঐতিহ্য জিজ্ঞেস করলো-‘ বাবা, এই ঈদগাহটা কে বানিয়েছিলেন’?
আবীর সাহেব বললেন-‘সেই সময়টা ছিল মুঘল আমল, রাজধানী হিসেবে ১৬১০ সালে ঢাকা সবেমাত্র গড়ে উঠছে। ধীরে ধীরে ঢাকায় অভিজাতদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছিলো, কিন্তু বড় আকারে ঈদের জামাত পড়ার জন্য তখনও তেমন কোন ঈদগাহ গড়ে ওঠেনি। ঢাকাবাসীরা তখন খোলা প্রান্তরে ঈদের নামাজটা আদায় করে নিতো। এই সব কারণে ১৬৪০ খৃষ্টাব্দে বাংলার সুবেদার শাহ সুজার নির্দেশে তাঁর প্রধান অমাত্য মীর আবুল কাসেম ঢাকার ধানমণ্ডিতে ঈদগাহটি নির্মাণ করেছিলেন। প্রথমদিকে এখানে শুধু সুবেদার, নায়েবে নাজিম ও অভিজাত মুঘল কর্মকর্তা এবং তাদের স্বজন-বান্ধবরাই নামাজ পড়তে পারতেন, সাধারণ নগরবাসীরা এতে প্রবেশ করার তেমন একটা সুযোগ পেতেন না। পরে ঈদগাহটি সকলের জন্য উন্মুক্ত করা হয়।
এসব কথা কীভাবে জানা গেল মামা? শান্তর প্রশ্ন।
আবীর সাহেব বললেন, নির্মাতার নাম এবং সে সময়ে কে শাসক ছিলেন তাঁর নাম ঈদগাহের প্রবেশদ্বারের উপর লাগানো কালো পাথরের একটা শিলালিপিতে লেখা ছিল, সেখানে আরও লেখা ছিল- "তিনি এমনই একটি ঈদগাহ নির্মাণ করেছেন, উচ্চতায় সেটি চাঁদের টুকরার ঈর্ষার বস্তু। তার মিম্বর, মিনার এবং শরীয়তের তারকার আবাসস্থল। বিশেষত ন্যায়বিচারক আল্লাহ তাআলা তাঁকে এ প্রাসাদ নির্মাণ করার ক্ষমতা দান করছেন”! তবে এখন কি অবস্থা হয়েছে দেখো, শিলালিপিতে মিনারের উচ্চতা সম্পর্কে যেমন বলা হয়েছিল এর বাস্তবে তা আর তেমন নেই। বরং এর চারপাশ দিয়ে এত সব উঁচু উঁচু ভবন উঠে গেছে যে এই ঈদগাহ আর মিনারগুলোও একেবারে কাছে গিয়ে না দাঁড়ালে আর দেখা যায় না!
বাবা বললেন, এটা বেশ ভাল প্রশ্ন করেছিস কিন্তু তুই। এই বিষয়টা নিয়ে ঐতিহাসিকগণ এখনও পুরোপুরি নিশ্চিত নন, তবে অনেকে ধারণা করেন সেই সময়ে ঢাকার মুল নগর আর্থাৎ আজ যাকে আমরা আজ পুরান ঢাকা বলি সেদিকে বেশ কিছু ঈদগাহ সুলতানী আমল থেকে চালু থাকলেও সেগুলোর কোনটিই খুব বড় ছিল না। তাই সার্বজনীন ঈদ জামাতের জন্য বড় আকারের একটা ঈদগাহ বানানোর পরিকল্পনা করা হলো। কিন্তু সমস্যা বাঁধলো কোথায় বানানো হবে সেই স্থান নির্বাচন নিয়ে। তৎকালীন প্রভাবশালী ব্যক্তিগন তাঁদের নিজ নিজ বাড়ির কাছে সেটি তৈরির ব্যাপারে প্রভাব বিস্তার করতে চেষ্টা করতে থাকেন। কিন্তু সমাধান করা যাচ্ছিল না। শেষে বাংলার তৎকালীন দেওয়ান মীর আবুল কাশিম উপায় না দেখে সিদ্বান্ত নেন মূল নগর থেকে দূরে কোন একটি খোলা স্থানে স্থানে ঈদগাহ নির্মাণ করার। বেছে নেয়া হলো ধানমণ্ডিকে, কারণ সেই সময়ে এই অঞ্চলে ছোট একটি বসতি ছিল, ছিল সাত গম্বুজ মসজিদ আবার স্থল ও জল পথে যোগাযোগের ব্যাবস্থাও ভাল ছিল- এই হলো মোটামুটি কারণ।
সেই সময়ে এই ঈদগাহের পাশ দিয়ে পান্ডু নদীর একটি শাখা প্রবাহিত ছিল, যা শাখা বর্তমানের সাতগম্বুজ মসজিদের কাছে মিলিত হতো বুড়িগঙ্গার সঙ্গে, ঐ অঞ্চলটার নাম ছিল তখন জাফরাবাদ। মুঘল সুবাদার, নায়েবে নাজিম, অমাত্য ও গণ্যমান্য ব্যক্তিরা তাঁদের পরিবার পরিজন নিয়ে জাঁকজমকের সাথে বুড়িগঙ্গা পারের ঢাকা নগর থেকে প্রায় এক ক্রোশ দূরের এই ঈদগাহে আসতেন দুই ঈদের নামাজ আদায় করতে। সেই সময় ঈদের দিন বেশ ধুমধাম করে মিছিল নিয়ে এখানে নামাজে আসতো নগরবাসীরা। এই প্রসঙ্গে মজার একটা বিবরণ পাওয়া যায়— ১৭২৯ সালের এক রমজান মাসের কথা, বাংলায় তখন শাসন করছেন সুবাদার দ্বিতীয় মুর্শিদ কুলি খাঁ। এই সময়ে ত্রিপুরা জয়ের খবর এল সুবাদারের কাছে। আনন্দে উদ্বেলিত সুবাদার তত্ক্ষণাৎ হুকুম দিলেন গরিবদের মধ্যে হাজার টাকা বিতরণের। শুধু তাই নয়, তাঁর নির্দেশে ঈদের দিনে সুবাদারের আবাস লালবাগ কিল্লা থেকে ঈদগাহে যাওয়ার পুরো পথের দুই পাশে দাঁড়ানো মানুষের মাঝে ছড়ানো হয়েছিল মুঠি মুঠি মুদ্রা!
সেই মুঘল আমল থেকে শুরু করে বিশ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত ধারাবাহিক ভাবে এখানে ঈদের নামাজ আদায়ের কথা জানা যায়। সেই সময়ে ঢাকার নওয়াব বাড়ি আহসান মঞ্জিল থেকে তোপধবনি করে চাঁদ ওঠার খবর জানানোর রেওয়াজ ছিল। ঈদের দিন নানা রঙের পতাকা হাতে নিয়ে ঈদ মিছিল সহকারে ধানমণ্ডি ঈদগাহে নামাজ পড়তে যাওয়া হতো!
প্রাচীন এই স্থাপনাটিকে রক্ষার কোন সুচিন্তিত পরিকল্পনাও করা হয়নি, ফল স্বরূপ অপরিকল্পিতভাবে স্থাপত্যটির পূর্ব পাশের দেয়াল ভেঙ্গে বানানো হয়েছে একটি মসজিদ। ঈদগাহটির খুব কাছেই নির্মাণ করা হয়েছে উঁচু উঁচু সব ভবন। এছাড়াও ওরা দেখলো পশ্চিম দিকের একেবারে দেয়াল ঘেষে টং দোকান, বস্তি ঘর, পুরানো পণ্যের ভাগাড়, গার্বেজ ট্রলি ইত্যাদিতে ভরা। চারিদিকে এত অব্যবস্থাপনা দেখে বোঝার উপায় নেই এখানে আমাদের ইতিহাসের গর্বের এক বড় নিদর্শন রয়ে গেছে!
তবে দিন বদলায়, আর আমরাও আশা করি সকলের সচেতনতায়। একদিন এই প্রায় ৪০০ বছরের প্রাচীন ঈদগাহটিকে ঘিরে পরিচ্ছন্ন একটি পরিবেশের সৃষ্টি হবে। মুঘল এই ঈদগাহে আরও শত বছর ধরে ঈদের নামাজ আদয় করতে পারবে ঢাকার ধর্মপ্রাণ মুসলিম নাগরিকগণ।