ফসল নষ্ট হয়ে যাওয়ায় আঘাত আসে কৃষকদের জীবন ও জীবিকায়।
Published : 13 Jan 2025, 10:02 PM
জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব গোটা বিশ্বের জন্যই আজ এক বড় হুমকি। আর বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশের জন্য এই হুমকি কতটা ভয়ানক তা সহজেই অনুমেয়।
জলবায়ুর ক্ষতিকর প্রভাবের অভিশাপ বয়ে বেড়াতে হচ্ছে আমাদের কৃষিখাতকেও। ফলে কৃষির সঙ্গে জড়িতদের জীবন ও জীবিকার মান পিছিয়েই যাচ্ছে।
কিছুদিন আগে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটে গিয়েছিলাম আমি। কৃষির উপর নির্ভরশীল এমন বেশ কয়েকজনের সঙ্গে সেখানে আমার কথা হয়। তাদের কথায় স্পষ্ট একটাই বার্তা পাওয়া যায়- চাষাবাদের উপযোগী আবহাওয়া না থাকায় আসছে দিনে কৃষি নিয়ে বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে যাবে।
কৃষকরা জানান, তারা সাধারণত জুন ও জুলাই মাসজুড়ে আমন ধানের বীজ বপন করেন। অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে সেই ধান পাকতে শুরু করে। নভেম্বর আর ডিসেম্বর মাসজুড়ে চলে ধান কাটার কাজ। যে বছর ফলন ভালো হয়, সে সময় আনন্দে মেতে থাকে কৃষক।
এবার তাদের চোখেমুখে তেমন আনন্দ আমি দেখতে পাইনি। এর পেছনে কারণ খুঁজে পাই- গেল বছরের সেপ্টেম্বরে পাহাড়ি ঢল আর অতিবৃষ্টিতে এই এলাকায় বন্যা দেখা দেয়, তলিয়ে যায় ক্ষেতের ফসল।
নাজমা বেগম নামে ৪০ বছর বয়সী এক নারী বলছিলেন, “বন্যায় বেবাক ফসল খাইয়া গেছেগা, ঋণ কইরা গেরস্থি করছিলাম, কী খাইয়াম, কী করবাম কিছুই বুঝবার পারতাছি না।”
নিজের দুঃখের কথা বলছিলেন মোহিনি রাকসাম নামের এক ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী নারী।
তিনি বলেন, “এই যে বন্যা হইছে, ক্ষতি হইয়া গেছে, ঘরে খাওন নাই, বাইরে কাম নাই, এত গুলান মুখ কী দিয়া ভরি, গরুর লাইগ্গা আবার বন কিনন লাগে।”
ফসল নষ্ট হয়ে যাওয়ায় আঘাত আসে কৃষকদের জীবন ও জীবিকায়। এতে ভুগতে হচ্ছে কৃষকের পুরো পরিবারকে। অন্যদের সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশুরাও।
এই উপজেলার মহাজনীকান্দা গ্রামে জব্বার মিয়া নামে এক ব্যক্তি বন্যায় তার ক্ষয়ক্ষতির বর্ণনা দেন। তার ১১ ও ১৫ বছর বয়সী দুই কন্যাকে দেখিয়ে বলেন, “এহন যদি ভালা কোনো সমন্দ পাওয়া যায় তাইলে কে না চাইব ঘারের বোঝা কমাইতে?”
আমি একটি গবেষণাপত্র পড়ে জানতে পারি, বাংলাদেশে প্রতি বছর অপ্রত্যাশিত বন্যায় প্রায় ২ দশমিক ৬০ মিলিয়ন হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব শুধু এই ফসল নষ্ট হবার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। সেই গবেষণাপত্রে বলা হয়, বায়ুমণ্ডলে কার্বন বৃদ্ধির ফলে বিভিন্ন খাদ্যশস্যে থাকা প্রোটিনের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। এর ফলে বাড়ছে চিকুনগুনিয়া, ডেঙ্গুসহ নানা রোগের প্রাদুর্ভাব।
প্রাকৃতিক দুর্যোগের আঘাতে বারবার জীবনের খেই হারানো এই কৃষকেরা এখন জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে সচেতন হতে আগ্রহী।
এই গ্রামেরই তরুণ কৃষক সিদ্দিক মিয়া বলছিলেন, “কী কাজ জলবায়ু পরিবর্তনে বড় ভূমিকা রাখছে সে বিষয়ে প্রান্তিক পর্যায়ে সচেতনতা বৃদ্ধিতে মনযোগ দিতে হবে। মাঠে জ্ঞানকে বিবেচনায় নিতে হবে।”
জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুপ প্রভাবে খোলা চোখে যতটুকু ক্ষতি দেখা যায় প্রকৃত ক্ষতি তারচেয়ে অনেক বেশি হয়ে থাকে। হালুয়াঘাটে গেল বছরের বন্যায় সাধারণভাবে দেখলে মনে হবে শুধু ফসলের ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে শিক্ষা ব্যবস্থা, যোগাযোগ ব্যবস্থা, অবকাঠামো, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যসহ আরও অনেক কিছু। ফসল নষ্ট হয়ে অর্থনৈতিক সংকট শুধু বেড়েছে তা নয়, শিশুদের সুষ্ঠু ও স্বাভাবিক বিকাশেও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে।
প্রতিবেদকের বয়স: ১৬। জেলা: ঢাকা।