‘২০১৪ সালের ৮ অক্টোবর অর্থাৎ যেদিন ভাষাসৈনিক আবদুল মতিন মারা গেলেন, সেদিনই তারা জানালেন, আমরা পরের দিন সকাল ৮টায় যেন পৌঁছাই।’
Published : 02 Nov 2024, 04:55 PM
এক দশক আগে নিভে গেছে ভাষাসৈনিক আবদুল মতিনের জীবনপ্রদীপ। কিন্তু তার দান করা কর্নিয়া দিয়ে এখনো পৃথিবীর আলো দেখছেন ঢাকার ধামরাইয়ের রেশমা নাসরিন। পেশায় স্বাস্থ্যকর্মী রেশমা সম্প্রতি হ্যালো ডট বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে কর্নিয়া প্রতিস্থাপনের অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করেছেন।
হ্যালো: আপনার কোন চোখে সমস্যা ছিল, এবং সেটা কবে থেকে?
রেশমা নাসরিন: ছোটবেলা থেকেই সমস্যা ছিল। প্রথমে চোখে প্রচুর চুলকানি হতো। ডাক্তারের কাছে গেলে জানলাম, এলার্জির কারণে চোখে চুলকানি হচ্ছে। ধীরে ধীরে দেখি, আমি বাম চোখে ভালোভাবে দেখতে পাচ্ছি না, তবে ডান চোখে কোনো সমস্যা ছিল না। ফলে প্রথম দিকে এতটা অসুবিধা বুঝিনি। তবে কলেজে উঠার পর বুঝতে পারি যে আমি বাম চোখে প্রায় দেখতে পাচ্ছি না।
হ্যালো: তখন এই সমস্যার কোনো চিকিৎসা নিচ্ছিলেন কি?
রেশমা নাসরিন: হ্যাঁ, অনেক ডাক্তার দেখিয়েছি। কিন্তু কেউ বলেননি যে কর্নিয়া ড্যামেজ হয়ে গেছে। ২০১৩ সালের দিকে প্রথম জানতে পারি যে কর্নিয়াটা নষ্ট হয়ে গেছে। এর আগে ডাক্তারেরা শুধু চুলকানি কমানোর ওষুধ দিতেন। একসময় পরিস্থিতি খুব খারাপ হয়—ঘুম থেকে উঠে চোখে ব্যথা, ফুলে যাওয়া, লাল হয়ে থাকা, আর চোখ খুলতে পারতাম না। তখন মিরপুরে আমার এক আত্মীয়ের মাধ্যমে ভালো ট্রিটমেন্ট পাওয়ার কথা জানতে পারি এবং সেখানে গিয়ে দেখি যে আমার কর্নিয়া ড্যামেজ হয়ে গেছে।
হ্যালো: ভাষাসৈনিক আবদুল মতিনের কর্নিয়ার খবর কীভাবে পেলেন?
রেশমা নাসরিন: কর্নিয়া প্রতিস্থাপনের জন্য সেখানে চিকিৎসকের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বাংলাদেশে কর্নিয়া পাওয়া অনেক কঠিন। চাইলে ভারতের চিকিৎসকদের সঙ্গে যোগাযোগ করা যেতে পারে। আমি ২০১১ সালের অক্টোবর থেকে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আওতাধীন কমিউনিটি ক্লিনিকে চাকরি করি। আমাদের ক্লিনিকের এক ডাক্তার কর্নিয়া বিশেষজ্ঞের সঙ্গে যোগাযোগ করতে সহায়তা করেন, আর সেই সূত্রে সন্ধানী চক্ষু হাসপাতালে নিবন্ধন করি। সিরিয়াল খুব বড় ছিল, প্রায় পাঁচ হাজারের কাছাকাছি। দু-তিন মাস পর হঠাৎ টিভির খবরে দেখি ভাষাসৈনিক আবদুল মতিন মারা গেছেন এবং তার কর্নিয়া দান করে গেছেন। এরপরই আমরা সন্ধানী চক্ষু হাসপাতালের সঙ্গে যোগাযোগ করি।
হ্যালো: তার কর্নিয়া আপনার চোখে প্রতিস্থাপন করা হয় কবে?
রেশমা নাসরিন: ২০১৪ সালের ৮ অক্টোবর অর্থাৎ যেদিন ভাষাসৈনিক আবদুল মতিন মারা গেলেন, সেদিনই তারা জানালেন, আমরা পরের দিন সকাল ৮টায় যেন পৌঁছাই। সেই অনুযায়ী গেলাম সেখানে। ডাক্তার অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষা করলেন যে ৮৮ বছর বয়সী ভাষা সৈনিক আব্দুল মতিনের চোখের কর্নিয়ার সঙ্গে আমার এডজাস্ট হবে কিনা। পরে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে জানালেন যে সব ঠিক আছে, এডজাস্ট হবে। এরপর আমি সন্ধানী চক্ষু হাসপাতালে ভর্তি হই। ৯ তারিখেই অপারেশন হয়, আর পরদিন দুপুরে ব্যান্ডেজ খোলা হয়।
হ্যালো: কর্নিয়া প্রতিস্থাপনের পর প্রথম কাকে দেখতে পেয়েছিলেন এবং অনুভূতি কেমন ছিল?
রেশমা নাসরিন: ব্যান্ডেজ খোলার পর মা, বাবা, স্বামী আর মেয়েকে প্রথম দেখতে পাই। ভারতে গিয়ে কর্নিয়া প্রতিস্থাপন অনেক ব্যয়বহুল ছিল, তাই ভেবেছিলাম হয়ত দেখা আর সম্ভব হবে না। তাই হতাশ হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু এভাবে সহজে কর্নিয়া পেয়ে যাব ভাবিনি। অপারেশনের পর আবার দেখার অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন।
হ্যালো: বর্তমানে কেমন আছেন? চোখে কোনো অসুবিধা হয়?
রেশমা নাসরিন: এখন আমি আমার স্বামী, ছেলে-মেয়েকে নিয়ে সময় কাটাই। ডাক্তার বলেছেন, নিয়ম মেনে যত্ন নিলে কর্নিয়া ১০ থেকে ১৫ বছর বা তারও বেশি ভালো থাকবে। এরপর যদি কোনো কারণে কর্ণিয়া নষ্ট হয়ে যায় তাহলে আবার লাগানো সম্ভব। এখনও ডাক্তারের পরামর্শক্রমে ছয় মাস পর পর ক্লিনিকে যাই আমি। ওখানে যাওয়ার পর ডাক্তার দেখেন এবং বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে বুঝিয়ে বলেন।
হ্যালো: সমাজের প্রতি কোনো বার্তা পৌঁছে দিতে চান?
রেশমা নাসরিন: আমি স্বাস্থ্যসেবা দিতে গিয়ে প্রায়ই সবাইকে উদাহরণ দেই যে মরণোত্তর চক্ষুদান করলে একজন অন্ধ মানুষ পৃথিবীর দেখতে পারে। এর চেয়ে মহৎ কাজ আর কী হতে পারে। তাই মানুষকে চক্ষুদানে উৎসাহিত করি।
হ্যালো: আমাদেরকে সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।
রেশমা নাসরিন: তোমাকেও ধন্যবাদ।
প্রতিবেদকের বয়স: ১৩। জেলা: ঢাকা।