সায়মা নামের এক কিশোরী জানায়, শুধু পিতৃ পরিচয় তাদেরকে এদেশের অন্য শিশুদের থেকে আলাদা করেছে।
Published : 04 Dec 2024, 09:54 PM
বিহারি ক্যাম্পের শিশুদের সম্পর্কে বিশদ জানতে আমি গিয়েছিলাম রাজধানীর মোহাম্মদপুরের জেনিভা ক্যাম্পে। সেখানে যাওয়ার পর তাদের কঠিন এক জীবনের দৃশ্যই আমার নজরে এসেছে।
বছরের পর বছর ধরে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের সঙ্গে লড়াই করছে এখানকার বাসিন্দারা। শিক্ষাবঞ্চিত হওয়ার পাশাপাশি শ্রম ও বাল্যবিয়ের সঙ্গেও জড়িয়ে যায় এখানকার অনেক শিশু।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশে আটকে পড়া এসব বিহারি পরিবারের শিশুরা প্রায় সব রকম অধিকার থেকেই বঞ্চিত। দারিদ্র্য ও বঞ্চনার সঙ্গে মাথা উঁচু করে আত্মপরিচয় দিতে না পারার কষ্টও আছে তাদের।
ক্যাম্পের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে তাদের সম্পর্কে জানার ও বোঝার চেষ্টা করেছি। কথা হয় ১৪ বছর বয়সী সায়মা নামের এক কিশোরীর সঙ্গে।
সে জানায়, শুধু পিতৃ পরিচয় তাদেরকে এদেশের অন্য শিশুদের থেকে আলাদা করেছে। তার মতে এই ক্যাম্পে জন্মগ্রহণ করাই যেন একটা অপরাধ।
১২ বছর বয়সী আলিফার সঙ্গে কথা শুরু করতেই সে আমাকে নিয়ে যায় তাদের ঘরে। আট ফুট দৈর্ঘ্য ও আট ফুট প্রস্থের ছোট সেই ঘরটিতে সূর্যের আলো প্রবেশ করে না বললেই চলে। সেখানে গাদাগাদি করে বাস করে ৬ জন।
কী কষ্টের জীবন এখানে না দেখলে বোঝানো কঠিন। এখানেই যদি শেষ হত সেটাও মানা যেত, কিন্তু এখানেই শেষ নয়। এই ক্যাম্পে নাকি সারা বছরই পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সংকট লেগে থাকে।
কথা হয় ৭৫ বছর বয়সী আকবর আলীর সঙ্গে। তিনি বলছিলেন, ভারত ভাগের পর বিহারের পাটনা থেকে পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশ) আসেন তার বাবা। এরপর একাত্তরে বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও তাদের আর পাকিস্তানে ফেরা হয়নি।
তার ভাষায়, “ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান কেউই আমার আপন হইল না।”
আকবর আলী জানান, এখানে একশর বেশি মানুষকে একটি টয়লেট ব্যবহার করতে হয়। তার চাওয়া, ক্যাম্পের ভবিষ্যৎ শিশুদের ভাগ্য যেন তাদের মত না হয়। সরকার যেন তাদের কথা ভাবে।
জেনিভা ক্যাম্পের মেয়েদের সঙ্গে কথা বলে আত্মনির্ভরশীল হতে চায় এমন কাউকে খুঁজে পাইনি আমি। কথা বলে ধারণা পেয়েছি, অল্প বয়সে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হবে এটাকে নিয়তি বলেই মেনে নিয়েছে এখানকার মেয়েরা।
রাজিয়া নামের এক নারীর সঙ্গে কথা হয়। তিনি জানান, ১৫ বছর বয়সে তাকে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়। এক বছর পরই প্রথম সন্তানের মা হয়েছেন। ক্যাম্পজুড়ে নাকি তার মতো গল্প অসংখ্য মানুষের রয়েছে।
এখানে কাজের ক্ষেত্রগুলোও যেন অনেকটাই সীমিত। সেলুন, মাংস বিক্রি, গ্যারেজ, বাবুর্চি এমন আরো দু-একটি কাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ তাদের পেশাগত জীবন।
শুরুর দিকে সায়মা নামের যে কিশোরীর কথা বলেছি তার কথা দিয়েই শেষ করছি।
সায়মা বলছিল, “আমরা খুপরিতে থাকি। আমাদের স্বপ্ন, সুখ-শান্তি সব এই খুপরি ঘরের মতই ছোট। আমাদের জীবনে কোনো আলো বাতাস নেই।”
তার প্রশ্ন, “বাংলাদেশ কবে আমাদেরও হবে?”
প্রতিবেদকের বয়স: ১৬। জেলা: ঢাকা।