স্বাস্থ্য বাজেটের স্বাস্থ্য নিয়ে হতাশা

নতুন অর্থবছরের বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দের পরিমাণ টাকার অংকে বাড়লেও মোট বরাদ্দের আনুপাতিক হারে তা না বাড়ায় হতাশা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। 

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 June 2022, 07:34 PM
Updated : 9 June 2022, 07:38 PM

তারা বলছেন, স্বাস্থ্য খাতের 'গতানুগতিক' বরাদ্দে বেতন-ভাতা সামলে তেমন কোনো সংস্কারের সুযোগ আর থাকবে না।

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বৃহস্পতিবার ‘কোভিডের অভিঘাত পেরিয়ে উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় প্রত্যাবর্তন’ শিরোনামে ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার যে বাজেট জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করেছেন, সেখানে স্বাস্থ্য খাতে ৩৬ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।

এ হিসাবে স্বাস্থ্য খাত বরাদ্দ পেয়েছে প্রস্তাবিত বাজেটের ৫ দশমিক ৪ শতাংশ, বিদায়ী অর্থবছরের বাজেটেও এই হার একই ছিল।

চলতি অর্থবছরে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ ছিল ৩২ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা। সংশোধনে তা কিছুটা কমে ৩২ হাজার ২৭৪ কোটি টাকা হয়। সেই হিসেবে নতুন অর্থবছরে টাকার অংকে বরাদ্দ বেড়েছে ৪ হাজার ১৩২ কোটি টাকা, ১৪ দশমিক ২১ শতাংশ।

নতুন অর্থবছরের ৩৬ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা বরাদ্দের মধ্যে ৭ হাজার ৫৮২ কোটি টাকা আবার রাখা হয়েছে স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণের জন্য। অর্থাৎ, স্বাস্থ্য সেবার জন্য থাকছে ২৯ হাজার ২৮১ কোটি টাকা, যা জিডিপির ১ শতাংশেরও কম।

এর ১৩ হাজার ৪৩০ কোটি টাকা খরচ হবে পরিচালন বাবদে, উন্নয়ন পাবে ১৫ হাজার ৮৫১ কোটি টাকা।

গত দুই বছর করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে স্বাস্থ্য খাতে জরুরি প্রয়োজনে ১০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হলেও সংক্রমণ কমে আসায় এবার তা অর্ধেকে নামিয়ে আনা হয়েছে।

কোভিড-১৯ মোকাবেলায় ও স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে যে ক্ষতি হয়েছে, তা পুষিয়ে নেওয়ার জন্য আগামী অর্থবছরে স্বাস্থ্যখাতের জরুরি চাহিদা মেটানোর জন্য ৫ হাজার কোটি টাকার থোক বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ মনে করেন, জরুরি প্রয়োজনে বরাদ্দ রাখা ‘ইতিবাচক’, তবে বাজেটে এবার তেমন কোনো গুণগত পরিবর্তন তিনি দেখছেন না।

“বাজেটে থোক বরাদ্দ রয়েছে, এটা ভালো। যদি কোনো জরুরি পরিস্থিতি আসে, তখন এটা ব্যবহার করা যাবে। এটা রাখার অভ্যাসটা ভালো।"

তবে সামগ্রিকভাবে স্বাস্থ্যের বরাদ্দের বিষয়ে প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, “বাজেটে তেমন কোনো পরিবর্তন আসেনি। টাকার পরিমাণে যা বেড়েছে, তার বেশিরভাগ অংশই খরচ হয়ে যাবে বেতনভাতা বাবদ। বড় অংশ চলে যাবে সেখানে। নতুন কিছু করার সুযোগ হবে না এই বাজেট থেকে।”

জনগণের স্বাস্থ্য আন্দোলন-বাংলাদেশের সমন্বয়কারী আমিনুর রসুলের মতে, স্বাস্থ্য খাতের এই বরাদ্দ যথেষ্ট নয়।

“আমরা বাজেট বাড়াতে বলেছিলাম। কিন্তু সেটা আগের মতই থাকল। ফলে এই বাজেটের মাধ্যমে স্বাস্থ্য খাতের প্রত্যাশা পূরণ হবে না।"

যা আছে স্বাস্থ্যের বাজেটে

স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে সরকারের উদ্যোগের চিত্র তুলে ধরে অর্থমন্ত্রী বলেন, ঢাকা শিশু হাসপাতালসহ ১৬টি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শিশু বিকাশ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে এবং আরও ১৫টি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও ৯টি জেলা হাসপাতালে তা স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে।

কোভিডকালে অটিস্টিক শিশুদের নিরাপত্তা ও উন্নয়নের জন্য ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে এবং আগামী অর্থবছরেও প্রয়োজনীয় বরাদ্দ থাকবে।

দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীকে থেরাপিউটিক সেবা দিতে বিদ্যমান ১০৩টি প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্রের বাইরে আরও ২১১টি কেন্দ্র স্থাপনের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এছাড়া প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠী এবং প্রতিবন্ধিতার ঝুঁকিতে থাকা ব্যক্তিদের ৪০টি মোবাইলথেরাপি ভ্যানের মাধ্যমে বিনামূল্যে থেরাপিউটিক সেবা দেওয়া হচ্ছে।

‘ইউনিভার্সাল হেলথ কেয়ার কাভারেজ’ অর্জনের অংশ হিসেবে ‘স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইন’ প্রণয়ণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কমিউনিটি ক্লিনিকের জন্য ‘ইনফেকসন প্রিভেনসন গাইডলাইন’ তৈরি করা হয়েছে। ‘গভর্নমেন্ট আউটডোর ডিসপেনসারি অপারেশনাল গাইডলাইন’ ইতোমধ্যে চূড়ান্ত করা হয়েছে এবং আগামী অর্থবছরে এর আওতায় ন্যূনপক্ষে ৮টি জিওডি-এর কার্যক্রম শুরু করা হবে। এছাড়া মহাখালীতে বঙ্গবন্ধু হেলথ সিটি স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে।

দেশে চিকিৎসা বিজ্ঞানের মৌলিক ও প্রায়োগিক গবেষণার অবকাঠামো তৈরি ও গবেষণা কার্যক্রম প্রবর্তন করা, গবেষণালব্ধ জ্ঞান দেশের স্বাস্থ্যসেবা, স্বাস্থ্য শিক্ষা, জনস্বাস্থ্য, অনুজীব বিদ্যা, রোগ তত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদির সার্বিক উন্নয়নে ও স্বাস্থ্য খাতের নতুন উদ্ভাবনের সক্ষমতা বৃদ্ধি ইত্যাদি লক্ষ্যকে সামনে রেখে চলতি বিগত অর্থবছরের মত এবারও ১০০ কোটি টাকার বরাদ্দ থাকছে।

টিকাদান কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে পারাকে মহামারী থেকে দ্রুত অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার অর্জনের পেছনে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অনুঘটক বলে মনে করেন অর্থমন্ত্রী।

এ পর্যন্ত ১২ কোটি ৯০ লাখ প্রথম ডোজ, ১১ কোটি ৮০ লাখ দ্বিতীয় ডোজ এবং দেড় কোটি মানুষকে বুস্টার ডোজ দেয়া হয়েছে বলে বাজেট বক্তৃতায় তিনি দিয়েছেন।  

টিকাদানের ক্ষেত্রে সরকারের সাফল্যের দুটি দিক তুলে ধরে তিনি বলেন, “আমরা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদন ছাড়া কোনো টিকা বাংলাদেশে ব্যবহার করতে দিইনি। অর্থাৎ দেশে ব্যবহৃত সকল কোভিড-১৯ টিকা বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক কার্যকর ও নিরাপদ হিসেবে অনুমোদিত।

“আমাদের দ্বিতীয় সাফল্যটি হল, টিকার ক্ষেত্রে আমরা শহর-গ্রাম, ধনী-গরিব ও নারী-পুরুষের সাম্য নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়েছি।”

 এ পর্যন্ত টিকা দেওয়া প্রায় ২৫ কোটি ৮০ লাখ ডোজ টিকার প্রায় ৫০ দশমিক ১ শতাংশ টিকা নারীরা নিয়েছেন বলে জানান অর্থমন্ত্রী।

“আমরা প্রান্তিক জনগোষ্ঠী যেমন ছিন্নমূল মানুষ, বেদে সম্প্রদায়, তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠী ইত্যাদির জন্য বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণ করে তাদেরকে টিকার আওতায় আনতে সক্ষম হয়েছি।”

ব্যাপকভাবে টিকাদানের ফলে দেশে সংক্রমণের হার দ্রুত কমে এসেছে এবং একইসাথে হাসপাতালে ভর্তি ও মৃত্যুর হার কমেছে বলে দাবি করেন তিনি।

“এসবের ফলে করোনার স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি ও মানুষের মধ্যে করোনার ভীতিও কমে এসেছে। ফলে, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়ে দেশ উচ্চ প্রবৃদ্ধির ধারায় ফিরে এসেছে।”

কোভিড-১৯ মহামারী থেকে উত্তরণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ১২১টি দেশের মধ্যে পঞ্চম শীর্ষস্থান ও দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে শীর্ষস্থানে রয়েছে বলে তথ্য দেন মুস্তাফা কামাল।

“এ সূচকে বাংলাদেশের সুদৃঢ় অবস্থান প্রমাণ করে যে, আমরা বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় অনেক ভালোভাবে করোনা মোকাবেলা করতে সক্ষম হয়েছি এবং আমাদের আর্থ-সামাজিক কর্মকাণ্ড স্বাভাবিক ধারায় ফিরে এসেছে। বিগত বাজেটে দেওয়া আমার ঘোষণা অনুযায়ী আমরা জীবন ও জীবিকার সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পেরেছি।”