আইসিডিডিআর,বিতে এক সপ্তাহে ৮৫১০ ডায়রিয়া রোগী

গরমের শুরুতেই রাজধানীতে ডায়রিয়ার প্রকোপ মারাত্মক আকার ধারণ করেছে, গত এক সপ্তাহে ঢাকার আইসিডিডিআর,বি হাসপাতালেই পেটের পীড়া নিয়ে ভর্তি হয়েছে সাড়ে আট হাজার রোগী।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 March 2022, 04:38 PM
Updated : 28 March 2022, 04:38 PM

সোমবারও এ হাসপাতালে দেখা গেছে রোগীদের ভিড়। সোমবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ভর্তি হয়েছেন ৯৯২ জন নতুন রোগী।

আইসিডিডিআর,বি বলছে, প্রতি বছরই দুই মওসুমে ডায়রিয়ার প্রাদুর্ভাব বাড়ে, তবে প্রতিদিন এত রোগী কখনোই এ হাসপাতালে ভর্তি হয়নি।

মহামারীর বিধিনিষেধ উঠে যাওয়ার পর মানুষের অসাবধানতা, বাইরের খাবার ও পানীয় গ্রহণে অসর্কতার কারণে এবার ডায়রিয়ার প্রকোপ বেড়েছে বলে চিকিৎসকদের ধারণা।

এই সংক্রামক রোগ থেকে বাঁচতে বাইরের খাবার না খাওয়া এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকার পরামর্শ দিচ্ছেন তারা।

আইসিডিডিআর,বির তথ্যে দেখা যাচ্ছে, গত সোমবার ১২১৬, মঙ্গলবার ১২৭২, বুধবার ১২৩৩, বৃহস্পতিবার ১১৭৬, শুক্রবার ১১৩৮, শনিবার ১২৪৫ এবং রোববার ১২৩০ জন রোগী ভর্তি হয়েছে এ হাসপাতালে।

সাত দিনে এ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন মোট আট হাজার ৫১০ জন ডায়রিয়া রোগী, অর্থাৎ দৈনিক গড়ে ১২১৫ জন।

বুধবার দুপুরে মহাখালীর আইসিডিডিআর,বিতে ভর্তি ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগীরা। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

রাজধানীর মিরপুর ১১ নম্বর সেকশনের বাসিন্দা জিনাত আরার পেট ব্যথা এবং পাতলা পায়খানা শুরু হয় শনিবার রাতে। অবস্থা খারাপের দিকে গেলে তাকে আইসিডিডিআর,বিতে নিয়ে আসা হয়।

জিন্নাতের মা রাশিদা খাতুন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, হাসপাতালে চিকিৎসা শেষে রোববার রাতে বাসায় নিয়ে যাওয়া হয় জিনাতকে। কিন্তু আবার পাতলা পায়খানা বেড়ে গেলে সোমবার ফের তাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছে।

“ওই দিন সন্ধ্যাবেলা বাইরে থেকে পুরি, সিঙাড়া খাইছিল, রাইতে আর ভাত খায় নাই, বলে শরীর ভালো না। পায়খানা শুরু হইলে শনিবার রাইত ১১টায়, পরে এইখানে নিয়া আহি। রবিবার সন্ধ্যায় ছুটি দিয়া দিছিল। বাসায় নিয়া যাওয়ার পরে রাতে আবার পাতলা পায়খানা। পরে আবার নিয়া আসছি।”

মিরপুরের শেওড়াপাড়ার বাসিন্দা লাবণ্য হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন রোববার সকালে। কীভাবে পেটের পীড়ায় আক্রান্ত হলেন, তা বুঝতে পারছেন না এই তৈরি পোশাক কর্মী।

“আমি বাইরের কোনো খাবার খাই নাই। সবসময় ফুটানো পানি খাই, অফিসেও ফিল্টারের পানির ব্যবস্থা আাছে। হঠাৎ করেই পেট খারাপ করল।”

উত্তরার হাউজবিল্ডিং এলাকার বাসিন্দা কাজিম উদ্দিনের স্ত্রী এবং মেয়ে দুজনকে ভর্তি করা হয়েছে আইসিডিডিআর,বির ঢাকা হাসপাতালে। মাকে ভেতরের ওয়ার্ডে রাখা হয়েছে, মেয়ে আছেন তাঁবু দিয়ে তৈরি করা অস্থায়ী ওয়ার্ডে। কাজিম উদ্দিন কিছুক্ষণ মেয়ের কাছে থাকেন, আবার স্ত্রীকেও গিয়ে দেখে আসেন। 

সোমবার দুপুরে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে কাজিম উদ্দিন জানান, শনিবার রাতে বাসায় খাবার পর থেকে স্ত্রী-মেয়ের অসুস্থতা শুরু হয়।

মহাখালীর আইসিডিডিআর,বিতে ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় বাইরে তাঁবু টানিয়ে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

“বাসায় ডাল-ভাত খাইছে। ভাত, তরকারি তো বাসি ছিল না। কিন্তু শনিবার রাত থেকেই সমস্যা শুরু হয়। অবস্থা খারাপ হলে গতকাল (রোববার) সকালে আমার স্ত্রীকে ভর্তি করেছি। পরে মেয়ের অবস্থাও খারাপ হল, সকালে তাকেও হাসপাতালে নিয়ে এসেছি।”

রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা আল আমিন এবং তার স্ত্রী তাদের ছয় বছর বয়সী সন্তান সিয়ামকে নিয়ে আইসিডিডিআর,বিতে এসেছেন।

আল আমিন বলেন, পেট খারাপ হওয়ার পর বাসায় ওরস্যালাইন খাইয়েছেন ছেলেকে, তবে পায়খানা ও বমি না কমায় হাসপাতালে নিয়ে আসতে হয়েছে।

“পায়খানা বন্ধই হচ্ছে না। একটু পরপর বাথরুমে যাচ্ছিল। ওষুধ খাইয়েছি, স্যালাইন খাওয়াচ্ছি, তাও পাযখানা কমছে না। দুই ঘণ্টার মধ্যেই বাচ্চাটা খুব কাহিল হয়ে পড়েছে। এজন্য দেরি না করে এখানে নিয়ে এসেছি।”

ঢাকার বিভিন্ন এলাকা এবং আশপাশের জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগীদের নিয়ে আইসিডিডিআর’বিতে ছুটে আসছেন স্বজনরা। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

আইসিডিডিআর,বির সহযোগী গবেষক ডা. লুবাবা শাহরিন জানান, প্রতি বছর অন্তত দুইবার ডায়রিয়ার প্রকোপ বেড়ে যায়। সে সময় চারশ থেকে পাঁচশ রোগী আইসিডিডিআর,বিতে আসেন। তবে এবার রোগী অনেক বেশি।

ঢাকার যাত্রাবাড়ী, মুগদা, শনিরআখড়া, মানিকনগর, উত্তরখান, দক্ষিণখান, কড়াইল, মোহাম্মদপুর, মিরপুর এবং ঢাকার বাইরের নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর থেকেও রোগী আসছে বলে জানালেন এই চিকিৎসক।

তিনি বলেন, “মানুষ অসাবধান হয়ে গেছে, বাইরের খাবার বেশি খাচ্ছে বলে ডায়রিয়া ছড়িয়েছে বেশি। আমাদের পরামর্শ হচ্ছে, বাইরের খাবার, পানি না খাওয়া। বাইরে কোথাও গেলে খাবার এবং পানি বাসা থেকে নিয়ে যাওয়া। ডায়রিয়া থেকে বাঁচার এটাই সবচেয়ে ভালো উপায়।”

লুবাবা শাহরিন জানান, এখন বেশিরভাগ রোগী আসছেন মারাত্মক পানিশূন্যতা নিয়ে। এ কারণে হাসপাতালে আনার আগে অবশ্যই রোগীর পানিশুন্যতা দূর করার ব্যবস্থা নিতে হবে।

“মারাত্মক পানিশূন্যতা একটা ক্রিটিক্যাল কন্ডিশন। যদি সঙ্গে সঙ্গে রোগীকে স্যালাইন দেওয়া না হয়, তাহলে হাসপাতালে আনার পথেও মারা যেতে পারে। এজন্য ডায়রিয়া হলে বাসায় স্যালাইন খাওয়ানো শুরু করতে হবে।

“যদি স্যালাইন খেতে না পারে, তাহলে কাছাকাছি কোনো হাসপাতালে নিয়ে শিরায় স্যালাইন চালু করতে হবে। এসব ব্যবস্থা না নিয়ে যদি রোগীকে শুধু কলেরা হাসপাতালে নিয়ে আসি, তাহলে পানিশূন্যতা পূরণ করা যাবে না।”