কোভিড: ওমিক্রনে হাসপাতালে চাপ পড়েনি, কেন?

ঢাকার কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে দেখা মিলল আলমগীর হোসেনের, চোখের দেখায় অসুস্থ মনে না হলেও জানালেন, তিনি ‘কোভিড পজিটিভ’।

ওবায়দুর মাসুম জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 Feb 2022, 07:14 PM
Updated : 17 Feb 2022, 07:14 PM

দক্ষিণ আফ্রিকা প্রবাসী আলমগীর থাকেন ঢাকার উত্তরখানে। কোনো ধরনের অসুস্থতা অনুভব না করলেও বিদেশ যেতে নমুনা পরীক্ষা করার পর দেখা যায়, তিনি করোনাভাইরাস সংক্রমিত।

আলমগীর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এমনিতে কোনো সমস্যা ফিল করছি না। যেহেতু কোভিড পজিটিভ, তাই ডাক্তার দেখাতে এলাম।”

আলমগীরের মতো অনেকেই আছেন, যাদের দেহে করোনাভাইরাস বাসা গাঁড়লেও অসুস্থ তারা হননি বা কোভিড রোগের আক্রান্ত হওয়ার কোনো উপসর্গ নেই।

এই রোগীরা যখন শনাক্ত হচ্ছেন, তখন ঢাকাসহ গোটা দেশেই দাপট চলছে করোনাভাইরাসের ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের। ঢাকায় এখন ৯৮ শতাংশ কোভিড রোগীই ওমিক্রনের বলে আইসিডিডিআর,বি’র গবেষণা বলছে। 

ওমিক্রমের আগে গত বছর ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের দাপট দেখেছে বাংলাদেশ। মহামারীর দ্বিতীয় বছরে দেশে তখন গুরুতর অসুস্থ রোগী বেড়ে যাওয়ায় হাসপাতালে শয্যার জন্য হাহাকার চলছিল।

গত বছরের শেষ ভাগে দ্রুত সংক্রমণশীল ওমিক্রনের বিস্তারের পর আগের ভয় থেকে হাসপাতাল প্রস্তুত করেছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, কিন্তু আগের চিত্র দেখা যায়নি।

যেদিন (গত ২৫ জানুয়ারি) সারাদেশে ১৬ হাজার ৩৩ জন শনাক্ত রোগী শনাক্ত হয়েছিল, তার চার দিন পর ২৯ জানুয়ারি ৩ হাজার ১৬১ জন কোভিড রোগী ভর্তি ছিল সারাদেশের হাসপাতালে।

ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের দাপট চলার সময় হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা সেদিনই ছিল সর্বাধিক। সেদিন হাসপাতালের ২৩ দশমিক ১৯ শতাংশ বেডে রোগী ছিল।

দেশে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের দাপটের সময় গত বছরের ২৮ জুলাই দিনে সর্বাধিক রোগী শনাক্তের যে সংখ্যা (১৬,২৩০), তা ওমিক্রনকালের কাছাকাছিই।

কিন্তু তখন হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ছিল এখনকার তিন গুণ বেশি। গত বছরের ২ অগাস্ট হাসপাতালে ভর্তি ছিল ১৩ হাজার ৫২২ জন কোভিড রোগী, যা দেশে কোভিড হাসপাতালের মোট শয্যার ৮২ দশমিক ৫৬ শতাংশ।

 

গত বছরের ১৫ জুলাই কোভিড ডেডিকেটেড নরসিংদী জেলা হাসপাতালের ৮০টি শয্যার মধ্যে ৬৫টিতে অর্থাৎ ৮১ দশমিক ২৫ শয্যায় রোগী ভর্তি ছিল।

ছয় মাস পর গত ১৫ ফেব্রুয়ারি ওই হাসপাতালের ১২০টি শয্যার মধ্যে রোগী ছিল মোটে ২১টিতে। শয্যার ৮২ দশমিক ৫ শতাংশই ছিল খালি।

নরসিংদী হাসপাতালের ফোকাল পার্সন ডা. এ এন এম মিজানুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এবার হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে কম।

“ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের সময়ের পিকের সঙ্গে যদি এখনকার পিকের তুলনা করি, তাহলে দেখা যাচ্ছে আগে ১০০ জন হাসপাতালে ভর্তি হলে এখন ১৫ থেকে ২০ জন হচ্ছে।”

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কোভিড ইউনিটের সামনে গিয়ে দেখা গেল, ভিড় গতবারের চেয়ে অনেক কম।

ঢাকা মেডিকেলের সামনে দেখা গেল ষাটোর্ধ্ব মাজেদা বেগমকে। দোহার থেকে একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে তাকে নিয়ে এসেছেন স্বামী আবদুল খালেক।

খালেক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বললেন, তার স্ত্রীর করোনাভাইরাস সংক্রমণ হয়েছে। শ্বাসকষ্ট রয়েছে।

মহামারীতে মাকে হারিয়ে ছেলের কান্না। ডেল্টার দাপটের এমন মৃত্যু ছিল অনেক বেশি। ফাইল ছবি

ডেল্টা সংক্রমণে শ্বাসকষ্ট নিয়ে অনেককে কোভিড রোগীকে আইসিইউ খুঁজতে হলেও এবার তেমনও দেখা যাচ্ছে না।

সর্বাধিক রোগী যেখানে, সেই ঢাকা মহানগরের হাসপাতালগুলোতে কোভিড রোগীদের জন্য নির্দিষ্ট ৭৭৩টি আইসিইউর মধ্যে ৬২৫টিই এখন খালি দেখা যাচ্ছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া বৃহস্পতিবারের বুলেটিনে।

করোনাভাইরাসের ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের ফুসফুসে সংক্রমণের ক্ষমতা কমে যাওয়া গুরুতর অসুস্থতা কমে যাওয়ার একটি কারণ মনে করছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীর।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, করোনাভাইরাস অনেক মিউটেন্ট হওয়ার কারণে কিছুটা দুর্বল হয়েছে। ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট আক্রান্ত ব্যক্তির ফুসফুস পর্যন্ত পৌঁছতে পারে না। ফলে আক্রান্ত ব্যক্তিকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হচ্ছে না।”

এই চিকিৎসক বলেন, “ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের ভাইরাস রোগীকে আক্রান্ত করেই ফুসফুসে চলে যেত। আর যেহেতু ভাইরাসটা ফুসফুসে সংক্রমণ ঘটাত, সে কারণে অক্সিজেন ডিমান্ড বেড়ে যাওয়ায় হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন বেশি হত। এবার যেটা হচ্ছে না।”

ওমিক্রনে তাহলে কী হচ্ছে- তার উত্তরে তিনি বলেন, “উপরের শ্বাসনালীর সংক্রমণের কারণে হাঁচি, কাশি, নাক দিয়ে পানি পড়ার মতো লক্ষণ প্রকাশ পাচ্ছে। শ্বাসতন্ত্রের উপরের অংশে যতই সংক্রমণ হোক, তাতে তো অক্সিজেনের চাহিদা তৈরি হচ্ছে না।”

ব্যাপক টিকাদান ওমিক্রনে গুরুতর অসুস্থতা ঠেকিয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

ব্যাপক টিকাদানও রোগীদের গুরুতর অসুস্থতা থেকে রক্ষা করছে বলে মনে করেন ডা. মিজানুর।

তিনি বলেন, “যারা ওমিক্রন আক্রান্ত হয়ে এখান ভর্তি হচ্ছেন, তাদের বেশিরভাগই টিকা নেননি। টিকা নেওয়া আছে, এমন ব্যক্তিরা হাসপাতালে আসলেও অক্সিজেন লাগছে, এমন সংখ্যা কম।”

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে, সারাদেশে ১০ কোটির বেশি মানুষ কোভিড টিকার প্রথম ডোজ নিয়েছেন। তাদের ৭ কোটির বেশি দ্বিতীয় ডোজও পেয়ে গেছেন। বুস্টার ডোজ পেয়েছেন প্রায় ৩০ লাখ।

সরকারি সংস্থা আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এ এস এম আলমগীর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, দেশে এখন কোভিড আক্রান্তদের ৫ শতাংশের মতো রয়েছে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট সংক্রমিত। যারা এখন হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন, তাদের মধ্যে ডেল্টায় আক্রান্তই বেশি।

ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্তদের হাসপাতালে ভর্তির পরিমাণ কম হওয়ার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, “ওমিক্রন আক্রান্ত করে অনেক, কিন্তু সিভিয়ারিটি অনেক কম। তুলনামূলকভাবে মৃত্যুর সংখ্যাও কম, এ কারণে হাসপাতালে ভর্তির সংখ্যাও কম।

“ডেল্টার সময় যদি পাঁচজন আক্রান্তের মধ্যে একজন ভর্তি হত, এখন ওমিক্রন আক্রান্তদের ৫০ জনের মধ্যে একজন ভর্তি হচ্ছে।”

ওমিক্রনের বিস্তারের এই সময়ে রোগীর সংখ্যা বাড়লেও মৃত্যু তুলনামূলকভাবে কম। ডেল্টার দাপটে দেশে দিনে মৃত্যু ২৬৪ জনে উঠলেও ওমিক্রনের সময় তা এখনও ৫০ ছাড়ায়নি।

তবে তাতেও স্বাস্থ্যবিধি ভুলে না যেতে সবাইকে সতর্ক করছেন ডা. আলমগীর।   

“ওমিক্রন আক্রান্ত হলে ভাইরাসটি ফুসফুসে তেমন আক্রান্ত করে না। কিন্তু হৃদরোগ, কিডনি রোগ, ডায়াবেটিস যাদের আছে, তাদের জন্য সমান ক্ষতিকর। ওমিক্রন আক্রান্ত হয়েছেন কিন্তু কোমর্বিডিটি আছে, রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কম, বয়স বেশি, এমন মানুষকেও হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে। এজন্য আমরা বলি সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার জন্য।”