হাসপাতালে সঙ্গে থাকা মা শিল্পী নিজেও যেন ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন; জানালেন দুর্বলতার জন্য মেয়েকে দেওয়া হচ্ছে স্যালাইন।
বুধবার ঢাকা শিশু হাসপাতালের ডেঙ্গু ওয়ার্ডে দেখা যায়, তার মতো আরও অনেক শিশুর হাতেই ক্যানুলা, বেডের স্ট্যান্ডে ঝুলছে স্যালাইনের ব্যাগ।
ঢাকার কল্যাণপুরেরে বাসিন্দা শিল্পী জানান, গত বছর জাকিয়া ছাড়া পরিবারের সবাই ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছিলেন। এবার পরিবারের অন্য কেউ আক্রান্ত হননি।
“ওর ১০২, ১০৩, ১০৪ এর মত জ্বর ছিল। জ্বর একেবারেই কমছিল না। পরে তো পরীক্ষা করায় ডেঙ্গু ধরা পড়ল। এখন কিছুটা ভালো আছে।”
এ হাসপাতালে যখন ভর্তি হতে আসে তখন কাফরুলের নয় বছর বয়সী সুমাইয়ার অবস্থাও ছিল নাজুক। শনিবার থেকে জ্বর, বমি, মাথাব্যথা, পেট ব্যাথা, পাতলা পায়খানায় ভুগছে।
তার মা শিলা আক্তার জানান, চিকিৎসকের কাছে নেওয়ার পর সুমাইয়া সেখানেই বমি করে মাথা ঘুরে পড়ে যায়। এরপরই ডেঙ্গুর পরীক্ষা করিয়ে শিশু হাসপাতালে ভর্তির পরামর্শ দেন চিকিৎসক।
এবার দেশে ডেঙ্গুর ব্যাপক সংক্রমণের মধ্যে এদের মতো ১০ বছরের কম বয়সী শিশুদের সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হওয়ার তথ্য আসছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যথাযথ উদ্যোগ না থাকায় এইডিশ মশার বিস্তার ঠেকানো যাচ্ছে না। এবার এর সবচেয়ে বড় শিকার হচ্ছে শিশুরা। মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে।
বুধবার ঢাকা শিশু হাসপাতালের ডেঙ্গু ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, ছয় মাস থেকে বিভিন্ন বয়সী শিশুরা এইডিশ মশাবাহিত এ রোগে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি রয়েছে। ওষুধ ও ইনজেকশনের পাশাপাশি এদের অনেককে স্যালাইনও দিতে হচ্ছে।
হাসপাতালে আসা ডেঙ্গু রোগীদের অভিভাবকরা মশা নিধনে সিটি করপোরেশনের তৎপরতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
মশা নিধনে সিটি করপোরেশনের তৎপরতা নিয়ে অসন্তুষ্ট কাফরুলের এ বাসিন্দা বলেন, “আমরা বাসা যতই পরিষ্কার রাখি, বাড়ির আশেপাশে, রাস্তাঘাটে তো মশার ওষুধ ছিটানোর দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের। তাদের তো সেই দায়িত্বটা পালন করতে হবে।
“না হলে আজকে আমার মেয়ের হইছে, কালকে আরেকজনের বাচ্চার হবে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রমটা যেন সব সময় থাকে।”
আরেক শিশু জাকিয়ার মা শিল্পী ডেঙ্গু ঠেকাতে সবাইকে সচেতন হওয়ার তাগিদ দিয়ে বলেন, “শুধু আমি তো বাসা পরিষ্কার রাখলেই হবে না। সবাইকে রাখতে হবে। কোথাও না কোথাও থেকে এইডিস মশা জন্মাইছে, নইলে ডেঙ্গু হবে কেমনে?”
শিশু হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, ডেঙ্গু ওয়ার্ডে ভর্তি থাকা অনেক শিশুই জ্বরের ধাক্কায় দুর্বল হয়ে পড়েছে। চিৎকার ও কান্নাকাটি করতে দেখা যায় অনেক শিশুকেই।
অভিভাবকরা জানান, তাদের অধিকাংশই জ্বর ও বমি নিয়ে হাসপাতালে এসেছে।
নয় দিন ধরে ডেঙ্গুজ্বর নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি থাকা মিরপুরের পাইকপাড়ার ছয় বছর বয়সী ফাহিমের মা খাদিজা বেগম জানান, তার ছেলের প্রচণ্ড জ্বর ছিল, যা কমছিলই না।
“১০৩ এর নিচে জ্বর নামছিলই না। সাপোজিটরি দিয়ে ১০ থেকে ১৫ মিনিট ঠিক থাকার পর আবার জ্বর উঠতে। পরে ডাক্তার পরীক্ষা করে দেখল ডেঙ্গু হয়েছে। প্লেটলেইট কমে গিয়েছিল, তখনই হাসপাতালে ভর্তি করি।”
তার ধারণা, বাইরে বাচ্চাদের সঙ্গে খেলতে গিয়ে এই শিশু ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়েছে।
রাজধানীতে ডেঙ্গু রোগী বাড়তে থাকায় সিটি করপোরেশনের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ফাহিমের ভাই হাবিবুর রহমান।
তিনি বলেন, “আমাদের বাসাটা মধ্য পাইকপাড়ায়। পাশেই একটা বিল্ডিং করার জন্য মাটি খুঁড়ে রাখছে, ওখানে পানি জমে আছে। আমার মনে হয় ওখান থেকেই ডেঙ্গু মশার উৎপত্তি।
“ওখানে সিটি করপোরেশনের মশানিধনের কার্যক্রম নাই বললেই চলে। হয়ত মাসে একদিন আসল, এরকম।”
বুধবার কিছু সময় শিশু হাসপাতালের থাকা অবস্থাতেই জরুরি বিভাগে একের পর এক শিশু আসতে দেখা যায়।
জরুরি বিভাগের দায়িত্বে থাকা মেডিকেল অফিসার সাথী সুলতানা রিমা জানান, অগাস্ট থেকে প্রচুর ডেঙ্গু রোগী পাচ্ছেন তারা, যাদের বেশিরভাগই ১০ বছরের কম বয়সী।
“তারা জ্বর নিয়েই বেশি আসছে। কেউ কেউ বমি, মাথাব্যাথা, পাতলা পায়খানার সমস্যা নিয়ে আসছে। যাদের অবস্থা খারাপ, তাদের আমরা ভর্তি নিচ্ছি। বাকিদের বাসায় চিকিৎসা নিয়ে টেস্ট করার পর আবার ডাক্তার দেখাতে বলছি।”
যা বলছে নগর কর্তৃপক্ষ
ঢাকার দুই অংশের নগর কর্তৃপক্ষ দাবি করছে, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে তারা কাজ করলেও এতে সফলতা পেতে আরও বেশি জনসচেতনতা প্রয়োজন।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফরিদ আহাম্মদ বলেন, “আমরা চিরুণি অভিযান চালাচ্ছি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর তথ্য দিচ্ছে। সে অনুযায়ী বিভিন্ন বাসার আশেপাশে ওষধ ছিটানো হচ্ছে, ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।”
আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আসার আশা জানিয়ে তিনি বলেন, “আগে মানুষ সচেতন ছিল না। এখন কিছুটা হচ্ছে। তারা সচেতন হলেই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। এটা নিয়ন্ত্রণের ৭০ শতাংশই নির্ভর করে জনসচেতনতার উপর।”
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জোবায়দুর রহমান জানিয়েছেন, তারা প্রতি এলাকায় এক সপ্তাহ পর পর মশক নিধন কর্মসূচি চালাচ্ছেন।
“ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আমরা অনেক ব্যবস্থাই নিচ্ছি, সবকিছু মিলিয়ে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছি। আমরা মানুষকে জানাচ্ছি, বুঝাচ্ছি। যখন মানুষ আরও বেশি সচেতন হবে, তখন এমনিতেই ডেঙ্গু কমে যাবে।”
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে জনগণের অংশগ্রহণ ‘খুব জরুরি’ জানিয়ে তিনি বলেন, “কেউ ঘরের টবে বা ছাদ বাগানের কোথাও পানি জমিয়ে রাখলে সেটা তো আমরা ফেলে দিতে পারছি না। সেখানে তো আমাদের এক্সেস নাই। এই জায়গাগুলোতে নিজেদেরই সচেতন হতে হবে।”
আক্রান্ত কত?
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর এখন পর্যন্ত ১৬ হাজার ৭০৫ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন, যা গত ২২ বছরে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।
এর মধ্যে সেপ্টেম্বরের ২২ দিনে ছয় হাজার ৩৪৯ জন ডেঙ্গু রোগী এসেছে হাসপাতালে, মারা গেছেন ১৩ জন।
সবশেষ বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় আরও ২৫৪ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে এসেছেন।
যাদের ২৪ দশমিক ৭ শতাংশেরই বয়স ১০ বছরের মধ্যে, এর মধ্যে ২ দশমিক ৬ শতাংশ শিশুর বয়স এক বছরের মধ্যে। এদিন চিকিৎসা নিতে আসা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২২ দশমিক ১ শতাংশ রোগীর বয়সসীমা ১১ থেকে ২০ বছর।
এ নিয়ে টানা চারদিন ১০ বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু রোগী পেয়েছে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলো।
আগের দিন বুধবার ২৩ দশমিক ৯ শতাংশ ডেঙ্গু রোগীর বয়স ছিল ১০ বছরের মধ্যে, এর মধ্যে ৩ দশমিক ২ শতাংশ শিশুর বয়স এক বছরের কম। এছাড়া ২০ দশমিক ৬ শতাংশ রোগীর বয়সসীমা ছিল ১১ থেকে ২০ বছরের মধ্যে।
এর আগে মঙ্গলবার সর্বোচ্চ ২৮ দশমিক ৪ শতাংশ ও সোমবার ২৩ দশমিক ৩ শতাংশ ডেঙ্গু রোগীর বয়স ১০ বছরের মধ্যে থাকার তথ্য দিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
এ তথ্য শুধু হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের। এর বাইরেও প্রচুর মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছেন, যারা বাসায় চিকিৎসা নিচ্ছেন বলে চিকিৎসকরা বলছেন।
যা করতে হবে
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী মনে করেন, ১০ বছরের কম বয়সী শিশুদের দিনের অধিকাংশ সময়ই শরীরের বেশিরভাগ অংশ খোলা থাকে বলে তারা মশার আক্রমণের শিকার হচ্ছে বেশি।
“দেখা যায়, একটি পরিবারের শুধু শিশুই আক্রান্ত হচ্ছে। কারণ পরিবারের যারা বাইরে যাচ্ছে, ফুল ড্রেসে যাচ্ছে। মা বাসায় থাকলে, শরীরের অধিকাংশ অংশই ঢাকা থাকছে। চলাচল করছে, এক কাজ থেকে অন্য কাজ করছে।
“কিন্তু বাচ্চাটা কার্টুন দেখবে, খেলবে বা ঘুমাবে। যেটাই করুক, তাদের শরীরে কিন্তু ছোট কাপড়; গরমের সময় খালি গায়েও থাকে। ফলে তাদেরকে মশা সহজে কামড়াতে পারে।”
এইডিস মশার শিকার থেকে রক্ষায় প্রথমেই আক্রমণকারী মশাকে নির্মূল করা এবং নিয়ন্ত্রণে রাখতে বলছেন এই চিকিৎসক।
তিনি বলেন, “বাড়ির চারপাশে, বাড়ির ভেতরে যেন পরিষ্কার পানি জমে না থাকে সেটা নিশ্চিত করতে হবে। মশা ও লার্ভা মারার ওষুধ ছিটানোর ব্যবস্থা করতে হবে। স্থানীয় প্রশাসন ও সিটি করপোরেশনকে নিয়মিত এ কাজটি করতে হবে।”
লেলিন চৌধুরী বলেন, “বাড়ির চারপাশ পরিষ্কার রাখলে, বাড়িতে পানি জমা না থাকলে; সেখানে এইডিস মশাটা জন্মানোর কোনো পরিবেশ নাই। কিন্তু মশাটা তো ১০০-২০০ মিটার উড়তে পারে। বাসার কয়েক গজ দূরে পাবলিক প্লেসে মশা জন্ম নিয়ে আমাদের কামড়াতে পারে। তাই এটা ব্যক্তির একক কোনো দায়িত্ব না।
“নাগরিক ও স্থানীয় সরকার কর্তৃপক্ষসহ যারা শহরের ব্যবস্থাপনার সাথে যুক্ত, সবাইকে নিজের জায়গা থেকে ভূমিকা পালন করতে হবে। এটা করলেই আমরা এইডিস মশা থেকে রক্ষা পাব।”
তিনি শিশুদের ফুল হাতা ড্রেস, ফুল প্যান্ট পরানো এবং দিনের বেলায় মশারি টানিয়ে ঘুমানোর ব্যবস্থা করার পরামর্শ দিয়েছেন।
আরও পড়ুন