ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি ঢাকার ‘নিচু এলাকায়’

করোনাভাইরাস মহামারীর ভয়াবহ বিস্তারের মধ্যে নতুন করে শঙ্কা জাগানো ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্তদের বেশিরভাগই ঢাকার তুলনামূলক নিচু এলাকার বাসিন্দা বলে হাসপাতাল থেকে পাওয়া তথ্যে উঠে এসেছে।

কাজী মোবারক হোসেনবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 August 2021, 06:04 PM
Updated : 9 August 2021, 06:14 PM

বর্ষা মৌসুমের শুরু থেকে দেশে এইডিস মশাবাহিত এই ভাইরাস জ্বরের প্রাদুর্ভাব বাড়ছে। করোনাভাইরাসের মহামারীর মধ্যে গত জুলাই থেকে হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী বাড়তে থাকায় উদ্বেগে রয়েছেন স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্টরা।

অগাস্টের শুরুতে প্রতিদিন দুইশর বেশি ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ‘হেলথ ইমারেজন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের’ তথ্য অনুযায়ী, চলতি সপ্তাহে ২০৯৫ জন রোগী হাসপাতালে গেছেন ডেঙ্গু নিয়ে।

সোমবার সকাল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ঢাকায় নতুন রোগী ভর্তি হয়েছেন ১৮১ জন; আর ঢাকার বাইরে ২৯ জন।

ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনে যেসব এলাকায় ডেঙ্গুর জীবাণুবাহিত এইডিস মশার উপদ্রব বেড়েছে, তার মধ্যে রয়েছে- রামপুরা, বাড্ডা, মিরপুর, শনির আখড়া, কমলাপুর ও দক্ষিণখান এলাকা।

শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীদের বিশেষ ওয়ার্ডে মশারির ভেতরে ডেঙ্গুরোগী। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

ডেঙ্গু রোগীর কারণে হাসপাতাল ব্যবস্থাপনায় চাপ বাড়ছে জানিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএমএসএইউ) উপাচার্য অধ্যাপক শরফুদ্দিন আহমেদ বলেন, প্রতিদিন অনেক ডেঙ্গু রোগী আসায় আলাদা করে ‘ডেঙ্গু কর্নার’ খুলেছেন তারা।

“যেসব এলাকা থেকে বেশি রোগী আসছে, তার মধ্যে জলাবদ্ধতার এলাকা, বিশেষ করে মিরপুর, বাড্ডা, রামপুরাসহ বিভিন্ন এলাকার রোগী বেশি। আসলে যেখানে পানি জমে থাকবে সেখানেই এইডিস মশা জন্মাবে, সেটা ধানমন্ডি, বনানীতেও হতে পারে।

“কারণ ফুলের টব, গাছের টব, টায়ার, বোতলে পানি জমে থাকলেই এইডিস মশা জন্ম নেবে। তবে নিম্নাঞ্চলে যেহেতু পানি বেশি জমে থাকে, সেখানে বেশি হচ্ছে। আমাদের এখানে রোগী বেশি নিচু এলাকারই।”

ঢাকার সিভিল সার্জন ডা. আবু হোসেন মো. মঈনুল আহসান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সাধারণত ঘরে বা আশপাশে বোতল, টায়ার, ফুলের টব, কিংবা ছাদবাগনে জমে থাকা পরিষ্কার পানিতে এইডিস মশা বংশবিস্তার করে। তবে সব জায়গাতেই সেটা হতে পারে। ফলে যেসব এলাকায় পানি জমে থাকে, সেসব এলাকায় এইডিস মথার বিস্তারের ঝুঁকিও বেশি।

এ পরিস্থিতিতে দ্রুত এইডিস মশা নির্মূলে নগরবাসীর সহযোগিতা চেয়েছেন ঢাকার দুই সিটি করর্পোরেশনের মেয়র। মশার প্রজননস্থলের তথ্য দেওয়ার পাশাপাশি নিজ এলাকা পরিচ্ছন্ন রাখার আহ্বান জানিয়েছেন তারা। জনগণের সচেতনতা বাড়লে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আনা ‘তেমন কঠিন কিছু নয়; বলে মনে করেন দুই মেয়রই।

 

দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের পরিস্থিত

ঢাকার নিম্নাঞ্চল ও জলাবদ্ধ এলাকা এইডিস মশা বিস্তারের কারণে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে বলে মনে করেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “নিম্নাঞ্চল ও জলাবদ্ধ এলাকা এইডিস মশার বিস্তারে খুবই উপযোগী। তাছাড়া থেমে থেমে প্রায় প্রতিদিনই বৃষ্টি হচ্ছে।”

যাত্রাবাড়ীতে বাসাবাড়ির জানালা থেকে ছুঁড়ে ফেলা এসব প্লাস্টিক সামগ্রীও বর্ষা মৌসুমে মশার প্রজননের কারণ হতে পারে। ছবি: কাজী সালাহউদ্দিন

তাছাড়া ছাদবাগান, বাড়িতে বাড়িতে পানির আধার, বোতল, বাতিল টায়ার কিংবা পরিত্যক্ত জায়গা ও নির্মাণাধীন ভবনসহ দুই বাড়ির মধ্যবর্তী অংশে এইডিস মশার বংশবিস্তারের পরিবেশ গড়ে ওঠার বিষয়ে সতর্ক করেছেন তিনি।

মেয়র তাপস দাবি করেন, দুই বছর আগের তুলনায় এখন পর্যন্ত ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে তারা ‘সফল’। জনগণের সচেতনতা বাড়লে সে সফলতা ধরে রাখা সম্ভব হবে।

“জুলাইয়ের শেষ দিকে এবং অগাস্টের প্রথম কয়েকদিন ডেঙ্গু রোগ ঊর্ধ্বমুখী ছিল। এই প্রেক্ষিতে আরও বৃহৎ পরিসরে চিরুনি অভিযান শুরু করি এবং নিয়ন্ত্রণ কক্ষের মাধ্যমে আমাদের সেসব অভিযানের তদারকি ও সমন্বয় করি।

“নিয়ন্ত্রণ কক্ষ চালু করার দ্বিতীয় দিন থেকেই ডেঙ্গু রোগের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা রোধ হয়েছে এবং সেটাকে আমরা নিম্নমুখী করতে সক্ষম হয়েছি। আশা করি, ডেঙ্গুর প্রকোপ ধীরে ধীরে কমতে থাকবে এবং অচিরেই শূন্যের কোঠায় নেমে আসবে।”

ঢাকার ধলপুরের এক বাড়ির ছাদে গাছ লাগিয়েছেন কোনো এক বৃক্ষপ্রেমিক, কিন্তু সেই গাছের টবে জমে থাকা পানিতেও জন্ম নিতে পারে এইডিস মশা। ছবি: কাজী সালাহউদ্দিন

২০১৯ সালে বাংলাদেশে ডেঙ্গু মারাত্নক আকার ধারণ করায় এক লাখের বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছিলেন। পরের বছর তা অনেকটা কমে আসায় হাসপাতালগুলো ১ হাজার ৪০৫ জন ডেঙ্গু রোগী পেয়েছিল।

ডেঙ্গুর জীবানুবাহী এইডিস মশার উৎসস্থল ধ্বংসে নিয়ন্ত্রণ কক্ষের ০১৭০৯৯০০৮৮৮ ও ০২৯৫৫৬০১৪ নম্বরে টেলিফোন করে কিংবা ওয়েবসাইটে নির্ধারিত ফরমে মশার প্রজননস্থল ও ডেঙ্গু রোগীর তথ্য দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।

ঢাকাবাসীর উদ্দেশে মেয়র বলেন, “আপনারা এগিয়ে এলে আমরা একটি নিরাপদ ঢাকা উপহার দিতে পারব। আমাদের সেই আন্তরিকতা আছে, জনবল আছে, যন্ত্রপাতি আছে। দরকার শুধু তথ্য।”

উত্তর সিটি কর্পোরেশনের পরিস্থিতি

ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম দাবি করেছেন, জনসচেতনতার কারণে অন্যান্য এলাকার তুলনায় তার সিটিতে এখনও ডেঙ্গু রোগী ‘তুলনামূলক কম’।

রোববার সকালে রাজধানীর বেরাইদ এলাকায় এইডিস মশা, ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া প্রতিরোধের লক্ষ্যে জনসচেতনতামূলক কার্যক্রমে গিয়ে তিনি বলেন, “ডিএনসিসির ৪২ নম্বর ওয়ার্ডে এখনও ডেঙ্গু রোগী চিহ্নিত হয়নি, তাই যেসব এলাকা এখনও ডেঙ্গুমুক্ত রয়েছে, সেসব এলাকার কেউ যাতে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত না হয় সেজন্য সকলের সহযোগিতায় প্রতিরোধমূলক কার্যক্রম আরও জোরদার করতে হবে।” 

রাজধানীজুড়ে বেড়েছে ডেঙ্গুর প্রকোপ। তই মশার হাত থেকে বাঁচতে পুরান ঢাকার ধুপখোলার এই বাসিন্দা বারান্দার চারপাশ ঢেকে দিয়েছেন মশারি দিয়ে। ছবি: কাজী সালাহউদ্দিন

রাজধানীর আশকোনা হাজী ক্যাম্প, দক্ষিণখান এলাকায় ‘চিরুনি অভিযান ও জনসচেতনতামূলক কার্যক্রমে’ গিয়ে এইডিস মশা, ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া প্রতিরোধে  সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা আহ্বান জানান উত্তরের মেয়র।

“সুস্থতার জন্য সুস্থ পরিবেশের কোনো বিকল্প নাই, আর সুস্থ পরিবেশ নিশ্চিত করতে হলে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম সংক্রান্ত সামাজিক আন্দোলনে সমাজের সর্বস্তরের জনগণকে সম্পৃক্ত করতে হবে।”

ব্যক্তিগত, সরকারি কিংবা বেসরকারি যে কোনো ভবনে এইডিস মশার লার্ভার পাওয়া গেলে জরিমানাসহ প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও তিনি হুঁশিয়ার করেছেন।

মেয়র আতিক বলেন, “বাসাবাড়িতে ফুলের টব, অব্যবহৃত টায়ার, ডাবের খোসা, চিপসের খোলা প্যাকেট, বিভিন্ন ধরনের খোলা পাত্র, ছাদ কিংবা অন্য কোথাও যাতে তিন দিনের বেশি পানি জমে না থাকে সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে।”

উত্তর সিটি কর্পোরেশনের জনসংযোগ শাখার এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ২৭ জুলাই থেকে ৭ অগাস্ট পর্যন্ত চিরুনি অভিযানে ৫৪টি ওয়ার্ডে ৯৬৩টি বাড়ি ও স্থাপনায় লার্ভা শনাক্ত করা হয়েছে।

এ অভিযানে ২৮টি নিয়মিত মামলা ও ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে ২২৯টি মামলা করা হয়েছে। এ সময় ৪২ লাখ ১৪ হাজার ৭০০ টাকা জরিমানা করা হয় বলেও বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে।