কোভিড টিকা: অন্তঃসত্ত্বা ও স্তন্যদায়ী নারীদের ঝুঁকি কতটা?

অন্তঃসত্ত্বা ও স্তন্যদায়ী নারীদের কোভিড টিকা দেওয়া যাবে কিনা, তা নিয়ে আলোচনার মধ্যে স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোনো ঝুঁকি ছাড়াই তাদের টিকা দেওয়া যেতে পারে। মা ও শিশুকে বাড়তি সুরক্ষা দেবে এটি।

কাজী নাফিয়া রহমান নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 August 2021, 06:24 PM
Updated : 3 August 2021, 06:24 PM

টিকার প্রভাব নিশ্চিত না হওয়ায় এতদিন বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। পাশাপাশি টিকার পর্যাপ্ত জোগান না থাকাকেও কারণ হিসেবে দেখিয়েছেন সরকারের নীতি-নির্ধারকরা।

তবে এই বিলম্বে অনেক নারীকে যে উচ্চমূল্য দিতে হয়েছে। আর সেই বাস্তবতায় দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে বলছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা।

অন্তঃসত্ত্বা ও স্তন্যদায়ী নারীদের টিকা দেওয়ার দাবি আসছে বেশ কিছুদিন ধরেই। দেশে গত ফেব্রুয়ারি মাসে গণ টিকাদান শুরু হলেও অন্তঃসত্ত্বা নারীদের উপর এর পরীক্ষামূলক প্রয়োগ না হওয়ায় তাদের টিকার বাইরে রেখেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এখন অন্তঃসত্ত্বা নারীদের কোভিড টিকা দেওয়া হচ্ছে। টিকার কারণে তাদের বাড়তি কোনো সমস্যা হওয়ার তথ্য এখন পর্যন্ত মেলেনি।

যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন, যুক্তরাজ্যের জয়েন্ট কমিটি অন ভ্যাকসিনেশন অ্যান্ড ইমিউনাইজেশন এবং অস্ট্রেলিয়ার টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজরি গ্রুপ অন ইমিউনাইজেশন অন্তঃসত্ত্বা নারীদেরও কোভিড টিকা নেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছে।

আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, যেখানে টিকা নিলে বিরূপ প্রভাবের আশঙ্কার চেয়ে উপকার হওয়ার সম্ভাবনা বেশি, সেখানে অন্তঃসত্ত্বা নারীদেরও কোভিড টিকা নেওয়া উচিত।

এর মধ্যে হাই কোর্টে রিট আবেদন হলে সোমবার আদালত অন্তঃসত্ত্বা নারীদের টিকা দেওয়ার বিষয়ে সরকারের সিদ্ধান্ত ৭২ ঘণ্টার মধ্যে জানাতে বলেছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের কনভেনশন সেন্টারে সোমবার এক নারীকে দেওয়া হচ্ছে ফাইজার-বায়োএনটেকের টিকার প্রথম ডোজ। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

এদিকে গত ৩১ জুলাই অন্তঃসত্ত্বা এবং স্তন্যদায়ী নারীদের করোনাভাইরাসের টিকা দিতে সুপারিশ করেছে জাতীয় টিকা পরামর্শক কমিটি (ন্যাশনাল ইমিউনাইজেশন টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজরি গ্রুপ- নাইট্যাগ)।

এই কমিটির সদস্য বে-নজির আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সরকারের তরফ থেকে আমাদের কাছে মতামত চেয়েছিল অন্তঃসত্ত্বা ও দুধ পান  মায়েদের টিকা দেওয়া যাবে কিনা? আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে, তাদের টিকা দেওয়া যেতে পারে।“

অবস্ট্রাক্টিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের সভাপতি অধ্যাপক ফেরদৌসী বেগম জানিয়েছেন, গত ২৪ জুলাই সরকারের কাছে এ বিষয়ে অনুরোধ জানিয়েছিলেন তারা।

“আমাদের অনুরোধ থেকেই বিষয়টি জাতীয় টিকা পরামর্শক কমিটির কাছে গেছে। নাইট্যাগে গিয়ে আমি বিষয়টা বিষদভাবে তুলে ধরেছি।”

এই চিকিৎসক বলেন, “গর্ভবতী ও স্তন্যদানকারী মায়েদের টিকা দিতে আমরা রিকমেন্ড করছি। যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ড, কানাডা, ভারতসহ অন্যান্য দেশেও দেওয়া হয়েছে। আমরাও তাই বলছি, গর্ভবতী নারীদের অবশ্যই টিকা দেওয়া উচিত।”

ঝুঁকিতে মা ও সন্তান

চিকিৎসকদের ভাষ্য, টিকার আওতায় না আসায় অনেক স্তন্যদায়ী ও অন্তঃসত্ত্বা নারী এবং সন্তান ঝুঁকির মুখে পড়ছেন।

ঢাকা মেডিকেল কলেজের গাইনি বিভাগের অধ্যাপক শিখা গাঙ্গুলি বলেন, “গর্ভবতী নারী যারা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছেন, তাদের অধিকাংশের অবস্থা শোচনীয় পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। এই কারণে আমরা চাচ্ছি তারা যেন টিকা দেয়। কারণ এখন জীবন বাঁচানোই আসল।”

আইসিডিডিআরবির একটি গবেষণার তথ্য উল্লেখ করে তিনি বলেন, “যারা টিকা নিয়েছে এবং নেয়নি, দুই গ্রুপেরই করোনা হয়েছে। তাদের মধ্যে যারা টিকা নিয়েছে, তাদের মৃত্যুহার অনেক কম টিকা না নেওয়াদের তুলনায়। করোনাভাইরাস হলেও তারা জটিল পর্যায়ে যাচ্ছে না।”

স্ত্রী ও প্রসূতি রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ফেরদৌসী বেগম বলেন, “যেসব গর্ভবতী নারীর করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঘটছে, তা মারাত্মকভাবে হচ্ছে এবং তারা মারা যাচ্ছে।

“গর্ভবতীদের জন্য টিকা যতটুকু কার্যকর, যারা গর্ভবতী নয় তাদের জন্যও ততটাই। অন্যান্য দেশেও গর্ভবতীদের টিকা দেওয়া হয়েছে, কিন্তু তাদের বাচ্চার কোনো সমস্যা বা বিকলাঙ্গতা দেখা দেয়নি।”

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের কনভেনশন সেন্টারে সোমবার এক নারীকে দেওয়া হচ্ছে ফাইজার-বায়োএনটেকের টিকার প্রথম ডোজ। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

এই চিকিৎসক বলেন, “এখন যেহেতু গর্ভবতী মায়েরা অনেক ঝুঁকিতে রয়েছে, তাই তাদের টিকা দেওয়া উচিত।”

মায়েদের সুরক্ষা দিতে না পারায় শিশুরাও সংক্রমিত হচ্ছে বলে জানান ঢাকা মেডিকেল কলেজের নিওনেটোলজি বিভাগের অধ্যাপক মনিষা ব্যানার্জী।

“আমাদের এখানে নবজাতক থাকে সাধারণত ৩৫ থেকে ৪০ জন। আমরা যদি সাসপেক্টেড কেইস হিসেবে নবজাতকদের নমুনা পাঠাই, তাদেরও করোনাভাইরাস ধরা পড়ে। কারণ হচ্ছে, বাচ্চা পেটে থাকা অবস্থাতেই মা হয়ত করোনা পজিটিভ ছিলেন। মানুষ এখন এত বেশি আক্রান্ত হচ্ছে, কেউই বাদ যাচ্ছে না। এবারের ঢেউয়ে দেখা যাচ্ছে, শিশুরা অনেক বেশি আক্রান্ত হচ্ছে।”

ঢাকা কমিউনিটি মেডিকেল কলেজের স্ত্রী ও প্রসূতিবিদ্যা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক সারিয়া তাসনিম জানান, যারা গর্ভবতী ও বুকের ‍দুধ খাওয়াচ্ছেন তাদের টিকা দিতে দ্বিধার কিছু নেই।

তিনি বলেন, “বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেছে, তারা টিকা নিতে পারবেন। কেননা টিকা নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। প্রেগনেন্সির ওপর বা বাচ্চার ওপর এর ক্ষতিকর প্রভাব এখনও দেখা যায়নি। আমরা দেখেছি, যেসব গর্ভবতী টিকা নিয়েছেন, তারা কোনো ক্ষতিকর প্রভাবের সম্মুখীন হননি।”

দেরি কেন?

করোনাভাইরাস প্রতিরোধে জাতীয় পরামর্শক কমিটির সদস্য ডা. নজরুল ইসলামও বলছেন, গর্ভবতী ও স্তন্যদানকারী মায়েদের টিকা দিতে হবে। এতে কোনো ঝুঁকি থাকবে না এবং তাদের সন্তানরাও অসুবিধায় পড়বে না।

এ নিয়ে দেশের বাইরে কিছু গবেষণায়ও ক্ষতিকর কিছু পাওয়া যায়নি জানিয়ে তিনি বলেন, কমিটির পরবর্তী সভায় এ বিষয়ে সুপারিশ করবেন।

এই বিলম্বের কারণ জানতে চাইলে নজরুল ইসলাম বলেন, “টিকার পর্যাপ্ততা ছিল না বলেই এতদিন গর্ভবতী নারীদের টিকার ব্যাপারে কিছু বলা হয়নি।”

আর আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এ এম এম আলমগীর জানান, এ সংক্রান্ত গবেষণা না থাকায় সিদ্ধান্তে আসা যায়নি।

“আমরা যখন টিকাদান শুরু করেছি, তখন এমন কোনো গবেষণা ছিল না, পরে হয়েছে। সারাবিশ্বেই গর্ভবতী নারীরা টিকা নিচ্ছেন, সেক্ষেত্রে আমাদের দেশেও তারা টিকা নিতে পারবেন। গর্ভবতী মা করোনাভাইরাসের টিকা নিলে তার দেহে অ্যান্টিবডি তৈরি হবে, সেটা থেকে তার বাচ্চাও সুরক্ষা পাবে।”

সরকারের পরিকল্পনা জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক নাসিমা সুলতানা বলেন, “নাইট্যাগের কাছে পরামর্শ চাওয়া হয়েছিল, তারা পরামর্শ দিয়েছে। কিন্তু আমাদের কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন কমিটি আছে, তারা জানাবে এটা কীভাবে ইমপ্লিমেন্টেশন হবে।”

আরও পড়ুন