মাস্কের সঙ্গে শত্রুতা কোথায়

“আসলে করোনা আমাদের জন্য না। আপনি দেখছেন কোনো রিকশাওয়ালার করোনা হইতে?”

সাবিকুন্নাহার লিপিসাবিকুন্নাহার লিপিরাসেল সরকার ওবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 April 2021, 04:25 AM
Updated : 1 April 2021, 07:06 AM

মুখে মাস্ক নেই কেন জিজ্ঞেস করতে এমন উত্তর দিলেন ঢাকার শাহবাগে আব্দুল জলিল নামের এক রিকশাচালক।

আর মিরপুরের এক হাসপাতালের অভ্যর্থনা কর্মী মোফাজ্জল হোসেন বললেন, সৃষ্টিকর্তার ওপর বিশ্বাস যাদের ‘কম’, তারাই মাস্ক নিয়ে ‘টানাটানি করে’।

সরকারপ্রধান থেকে চিকিৎসক, সবাই বার বার বলছেন একই কথা- মাস্ক ছাড়া চলবে না। কিন্তু রাস্তাঘাটে, বাজার-হাটে মানুষ তা মানছে না।

করোনাভাইরাস মহামারীর নতুন ঢেউয়ের মধ্যে মানুষকে মাস্ক পরাতে আর সুরক্ষার স্বাস্থ্যবিধি ঠিকঠাক মানাতে পথে নেমেছে আইন-আদালত। কিন্তু অনাগ্রহী মানুষের অজুহাতের শেষ নেই। 

বুধবার রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা, গণপরিবহন, বই মেলাসহ বিভিন্ন স্থানে ঘুরে দেখা গেল, মাস্ক থাকলেও অনেকে তা ঝুলিয়ে রেখেছেন থুতনির নিচে। কেউ আবার হাতে নিয়ে চলাফেরা করছেন।

পথচারী বা যাত্রীদের কেউ কেউ মাস্ক পরলেও রিকশাচালক বা গণপরিবহনকর্মীদের মুখে মাস্ক দেখা যাচ্ছে খুব কম। চায়ের দোকান বা হাট-বাজারে সামাজিক দূরত্বের বালাই নেই।

মাস্ক না পরার অজুহাত হিসেবে গরম লাগা, ঘেমে যাওয়া, শ্বাস নিতে কষ্ট- এসব নানা যুক্তি শোনা গেল।

গণপরিবহনে যাত্রী তোলার আগে স্যনিটাইজার ব্যবহার করতে দেখা যাচ্ছে না। চানখারপুল মোড়ে ঠিকানা পরিবহনের এক কর্মীকে জিজ্ঞেস করতে তিনি বললেন, “গাড়িতে স্যানিটাইজার আছে, কেউ চাইলে দিই।”

বাসে মিজানুর রহমান নামের এক যাত্রীকে মাস্ক না পরার কারণ জানতে চাইলে তিনি বললেন, “মাস্ক তো পরি, কিন্তু যেই গরম পড়ছে, সব সময়ই মাস্ক মুখে রাখা কষ্ট।”

নীলক্ষেত মোড়ে আরেক পথচারী বললেন, “সাথে মাস্ক আছে। কিন্তু অনেক্ষণ পরে থাকলে ঘেমে যায়। তাছাড়া আমার শ্বাস নিতে একটু কষ্ট হয়।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় চায়ের দোকানে মাস্ক না পরে পাশাপাশি বসে আড্ডা দিতে দেখা গেল অনেককে।

শাকিল আহমেদ নামে একজন বললেন, “মাস্ক সাথে আছে। চলাফেরার সময় পরি। কিন্তু সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা সম্ভব হচ্ছে না। আপনি কোথায় সামাজিক দূরত্ব মানবেন, সব জায়গায় মানুষের গ্যাদারিং।”

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অমর একুশে বইমেলায় প্রবেশের সময় সবার মুখেই মাস্ক থাকছে, কিন্তু মেলার ভেতরে ঢুকে সেটা আর মুখে রাখা জরুরি মনে করছেন না অনেকে।

আদিবা রহমান নামে একজন বললেন, “মাস্ক সবসময়ই পরি। কিন্তু এখন প্রচুর গরম পড়েছে, ঘেমে যাচ্ছি। তাই মাঝে মাঝে খুলতে হচ্ছে।”

শাহবাগ, টিএসসি, শহীদ মিনার এলাকায় অধিকাংশ রিকশাচালককেই মাস্ক পরতে দেখা যায়নি। তবে পুলিশ ধরলে সব রিকশাওয়ালাই মাস্ক পরে বলে জানালেন তাদের একজন।

কুর্মিটোলা বিহারী ক্যাম্পে গাদাগাদি করেই থাকেন সেখানকার বাসিন্দারা। ক্যাম্পের গলি দিয়ে বাইরের মানুষও যাতায়াত করে। তবে সেখানে কাউকেই মাস্ক পরতে দেখা যায়নি।

স্থানীয় বাসিন্দা নীলা বললেন, “মাস্ক পরলে গরম লাগে, সে কারণে পরি না।”

এই ক্যাম্পের পাশে সবজিবাজারেও ক্রেতা-বিক্রেতাদের মাস্ক পরতে দেখা যায়নি।

কালশীতে দেখা গেল, মাস্ক না পরেই অনেকে পায়চারি করছেন। কেউ আবার পকেটে মাস্ক রেখে অপেক্ষা করছেন বাসের জন্য।

মকবুল নামের এক রিকশাচালক বললেন, “পান, সিগারেট খাওয়ার জন্য খুলি। বাকি সময় তো পরি।”

কালশী থেকে গুলশানগামী একটি বাসে উঠে দেখা গেল কয়েকজন যাত্রীর মাস্ক হাতে রাখা, বাকিরা মুখেই পরেছেন। বাসের হেল্পার, ড্রাইভারদের মাস্ক ঝুলছে কানে, থুতনিতে।

মনির হোসেন নামের এক যাত্রী বললেন, “মাস্ক পরলে মুখ ঘেমে যায়, তাই খুলে রাখছি। এখন তো বাসে গ্যাদারিং নাই, নেমে পরে নেব।”

আর হেল্পার কামরুল বললেন, “মাস্ক পরে কথা বললে মানুষ শোনে না। সব সময় তো যাত্রীদের ডাকতে হয়, তখন কষ্ট হয়ে যায়।”

গুলশান-১ নম্বরে পথচারীদের মাস্ক ছাড়াই রাস্তায় ঘুরতে দেখা গেল। অনেকেই মাস্ক হাতে, পকেটে নিয়ে ঘুরছেন।

রাজু নামের এক পথচারী বললেন, “তাড়াহুড়া করে বের হতে গিয়ে ভুলে মাস্ক রেখে চলে আসছি। সব দিনই মাস্ক পরে বের হই। আর করোনা হলে এমনিও হবে, অমনিও হবে, মাস্ক পরে কি আর আটকে রাখতে পারব!”

মিরপুরের ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে মাস্ক ছাড়া প্রবেশ নিষেধ হলেও কয়েকজন মাস্ক ছাড়াই ঢুকে পরেছেন। কেউ আবার মাস্ক খুলে রেখেছেন। তবে সিংহভাগ রোগীকেই মাস্ক পরতে দেখা গেছে।

৬৫ বছর বয়সী রোগী জিন্নাত বলেন, “মাস্ক ভুলে রেখে চলে আসছি, মনে থাকে না। ঢোকার সময় হাসপাতালের লোকজনও রাগ করেছে।”

সেই হাসপাতালের অভ্যর্থনা কর্মী মোফাজ্জল হোসেনকেও থুতনিতে মাস্ক ঝুলিয়ে রাখতে দেখা যায়।

তিনি বলেন, “আমরা করোনার মধ্যে থাকি, আমাদের করোনা হবে নাকি? করোনা হবে তাদের, যারা এসির মধ্যে থাকে। যাদের আল্লাহর উপর বিশ্বাস নাই তারাই মাস্ক নিয়ে টানাটানি করে, যাদের বিশ্বাস আছে তাদের লাগে না।”

পুরবী সুপার মার্কেটে গুটিকয়েক ব্যবসায়ীকে মাস্ক পরতে দেখা গেল। কয়েকজন আবার মাস্ক ঝুলিয়ে রেখেছেন কানে, থুতনিতে।  

সেখানকার কাপড় ব্যবসায়ী মিন্টো চন্দ্র শীল বলেন, “মাস্ক পরে কি করোনা ঠেকানো যাবে? শিল্পপতিরা তো এসিতে থাকে, গাড়িতে চড়ে, তাদেরও তো অনেকে মরে গেছে; করোনা ভুয়া। মানুষ যত আনন্দে থাকবে, কর্মঠ হবে, ততই বেঁচে থাকবে। খাবার দিয়ে দিক সরকার, আনন্দে জীবনযাপন করার সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে।”

পল্লবী ডাকঘরে গিয়েও একই চিত্র দেখা গেল। গ্রাহকদের পাশাপাশি কর্মকর্তারাও কেউ কেউ মাস্ক খুলে রেখেছেন। তবে এ বিষয়ে তারা কথা বলতে চান না।

জনসচেতনতায় গতি আনার পরামর্শ

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ দ্রুত বাড়তে থাকায় মাস্ক পরতে জনগণের অনীহা কাটাতে এবং জনসচেতনতা বাড়াতে জোর দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।

প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সংক্রমণের হার বাড়ছে। কিন্তু মানুষ ওভাবে স্বাস্থ্যবিধি মানছে না। জনগণের মধ্যে একটা উদাসীন ভাব, খামখেয়ালি দেখা যাচ্ছে।

“জনগণকে মনে রাখতে হবে, নিজের সুরক্ষা তার নিজের কাছে, নিজে ভালো থাকলে অন্যে ভালো থাকবে। নিজে উদাসীনভাবে চললে নিজের ক্ষতির পাশাপাশি অন্যকেও ক্ষতিগ্রস্ত করা হবে।”

সচেতনতা বাড়ানোর ওপর জোর দিয়ে তিনি বললেন, “সমাজের নেতৃস্থানীয় মানুষের সমন্বয়ে পাড়ায়-মহল্লায় কমিটি গঠন করা যেতে পারে। এই কমিটিতে জনপ্রতিনিধি, ইমাম, মোড়ল ও ছাত্র-শিক্ষক সবাইকে রাখতে হবে, যাতে সর্বস্তরে জনসচেতনতা তৈরিতে তারা কাজ করতে পারেন।

“একই সঙ্গে টেলিভিশন, অনলাইন মিডিয়াসহ সব মাধ্যমে প্রচার-প্রচারণা বাড়াতে হবে। যাতে মানুষ তার দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন হয়, সে যেন দায়িত্ব পালন করতে উদ্বুদ্ধ হয়।”

প্রশাসনকে আরও কঠোর হওয়ার আহ্বান জানিয়ে ডা. আবদুল্লাহ বলেন, “হাট-বাজার, রাস্তা, বা পাবলিক প্লেসে স্বাস্থ্যবিধি মানতে মানুষকে বাধ্য করতে হবে। প্রয়োজনে নিরাপত্তা বাহিনীর সহায়তা নিতে হবে।”

দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বৃদ্ধির ধারায় রেকর্ড রোগী শনাক্তের খবর এসেছে বুধবার। এক দিনেই ৫ হাজার ৩৫৮ জনের মধ্যে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়েছে; মৃত্যু হয়েছে আরও ৫২ জনের।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সংক্রমণের মাত্রা খুব দ্রুত বাড়ছে। এই ঊর্ধ্বগতি ঠেকাতে আমরা যে ১৮টি নির্দেশনা দিয়েছি, তা কঠোরভাবে মেনে চলতে হবে।

“গরমের চিন্তা করলে হবে না। শতভাগ মাস্ক পরা নিশ্চিত করতে না পারলে করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে আনা খুবই চ্যালেঞ্জিং। আর যারা এখনও টিকা নিচ্ছে না, তারা যেন সবাই টিকার আওতায় আসে, সেজন্য আমাদের বিশেষ অনুরোধ থাকবে।”