অক্সফোর্ডের টিকা আমদানি-ব্যবহারের অনুমোদন দিল বাংলাদেশ

ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটে উৎপাদিত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রেজেনেকার করোনাভাইরাসের টিকা আমদানি ও জরুরি ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশের ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 Jan 2021, 03:31 PM
Updated : 7 Jan 2021, 06:06 PM

এই প্রথম করোনাভাইরাসের কোনো টিকা বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুমোদন পেল। এখন ভারত থেকে টিকার চালান পেলেই বড় আকারে টিকাদান কর্মসূচি শুরু করতে পারবে সরকার, যা ভাইরাসের বিস্তার নিয়ন্ত্রণে নতুন আশার আলো জ্বালবে।

সেরাম ইনস্টিটিউটে উৎপাদিত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রেজেনেকার টিকার তিন কোটি ডোজ কিনতে দুই মাস আগেই চুক্তি করেছিল বাংলাদেশ। এই তিন কোটি ডোজ নাগরিকদের বিনামূল্যে দেওয়া হবে বলে ইতোমধ্যে সরকারের তরফ থেকে জানানো হয়েছে।   

ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক মো. আইয়ুব হোসেন সোমবার রাতে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা এই টিকা আমদানির জন্য একটা এনওসি দিয়েছি। এখন বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের তৈরি টিকা আমদানি করতে পারবে। এখন এই টিকা আমদানিতে আর কোনো বাধা নাই।”

ব্রিটিশ ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি অ্যাস্ট্রাজেনেকাকে সঙ্গে নিয়ে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের তৈরি করা এই টিকার ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল হয়েছে যুক্তরাজ্য, ভারত, ব্রাজিলসহ কয়েকটি দেশে। তাতে এই টিকা গড়ে ৭০ শতাংশ ক্ষেত্রে কার্যকর সুরক্ষা দিতে পেরেছে বলে গবেষকরা জানিয়েছেন।

ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটে উৎপাদিত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রেজেনেকার করোনাভাইরাসের টিকা।

কোভিশিল্ড নামে এই টিকার উৎপাদন ও বিপণনের সঙ্গ যুক্ত রয়েছে সেরাম ইনস্টিটিউট অফ ইন্ডিয়া। তাদের সঙ্গে সরকারের করা চুক্তি অনুযায়ী, প্রতি মাসে টিকার ৫০ লাখ ডোজ পাওয়ার কথা বাংলাদেশের।

ওই তিন কোটি ডোজ টিকার জন্য অগ্রিম হিসেবে ৬০০ কোটি টাকা পাঠানোর প্রক্রিয়াও ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে বলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক জানিয়েছেন।

বাংলাদেশে সেরাম ইনস্টিটিউটে উৎপাদিত ভ্যাকসিনের ‘এক্সক্লুসিভ ডিস্ট্রিবিউটর’বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড জানিয়েছে, চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশে এই টিকা অনুমোদন পাওয়ার এক মাসের মধ্যে সেরাম ইনস্টিটিউটের টিকার প্রথম চালান পাঠানোর কথা। 

টিকা আমদানির অনুমতির জন্য প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র গত বৃহস্পতিবারই ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরে জমা দিয়েছিল বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস। এরপর সোমবার আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমোদন চাওয়া হয়।

জরুরি ব্যবহারের জন্য এই টিকা আমদানির অনুমোদন চাওয়া হয়েছিল জানিয়ে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক আইয়ুব বলেন, “‘নো অবজেকশনে’র মাধ্যমে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে এ কারণে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের প্রয়োজন নেই।

“এই টিকা এখন আমাদের দেশের মানুষের দরকার। এই টিকা এখন যুক্তরাজ্য ও ভারতে অনুমোদন পেয়েছে, সেসব জায়গায় ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল হয়েছে, বিভিন্ন ধরনের স্টাডি আছে। এছাড়া আমাদের এক্সপার্ট কমিটির দেওয়া সিদ্ধান্ত বিচার বিশ্লেষণ করেই অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।”

দেশের মোট জনসংখ্যার ৮০ শতাংশ, অর্থাৎ ১৩ কোটি ৮২ লাখ ৪৭ হাজার ৫০৮ জন মানুষকে নতুন করোনাভাইরাসের টিকা দেওয়ার জন্য ইতোমধ্যে একটি খসড়া পরিকল্পনা তৈরি করেছে সরকার।

তিন ভাগে (ফেইজ) মোট পাঁচ ধাপে এসব টিকা দেওয়া হবে, যেখানে প্রাধান্য পাবে কোভিড-১৯ মহামারী প্রতিরোধে সামনের কাতারে থাকা মানুষ। আর এজন্য প্রয়োজন হবে ২৭ কোটি ৬৪ লাখ ৯৫ হাজার ১৬ ডোজ টিকা (একজনকে দুই ডোজ করে)।

সেরাম ইনস্টিটিউটের কাছ থেকে অক্সফোর্ডের টিকা কেনার পাশাপাশি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিনস অ্যান্ড ইমিউনাইজেশনস বা গ্যাভি এবং কোয়ালিশন ফর এপিডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস ইনোভেশনসের গড়া প্ল্যাটফর্ম কোভ্যাক্স এর আওতায় আরও আড়াই কোটি ডোজ টিকা আগামী জুনের মধ্যে বাংলাদেশ পাবে বলে সরকার আশা করছে।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক গত শনিবার জানিয়েছিলেন, সেরাম ইনস্টিটিউটে উৎপাদিত প্রতি ডোজ টিকার ক্রয়মূল্য হবে ৪ ডলার। সব খরচ মিলিয়ে দাম পড়বে ৫ ডলার। বাংলাদেশি টাকায় হিসাব করলে ৪২৫ টাকার মত।

প্রত্যেককে অক্সফোর্ডের টিকার দুটো করে ডোজ নিতে হবে। দুই ডোজের মধ্যে ব্যবধান থাকবে ২৮ দিন

অক্সফোর্ডের টিকা রেফ্রিজারেটরের সাধারণ তাপমাত্রাতেই সংরক্ষণ করা যায়; ফলে যে কোনো জায়গায় এই টিকা পৌঁছানো তুলনামূলক সহজ। এ কারণে অনেক দেশেরই এ টিকা নিয়ে আগ্রহ বেশি।

নয়া দিল্লির ইন্দিরা গান্ধী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো টার্মিনাল ২ এ রাখা কনটেইনারের সামনে দিয়ে যাচ্ছেন একজন কর্মী। এখান থেকেই বিভিন্ন দেশে করোনাভাইরাসের টিকা পাঠানো হবে বলে জানানো হয়েছে। ছবি-রয়টার্স

বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে যুক্তরাজ্য গত ৩০ ডিসেম্বর অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার করোনাভাইরাসের টিকা ব্যবহারের অনুমোদন দেয়। এরপর এ টিকা আর্জেন্টিনাতেও অনুমোদন পায়।

এরপর বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম জনসংখ্যার দেশ ভারত রোববার সেরাম ইনস্টিটিউটে উৎপাদিত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা ব্যবহারের চূড়ান্ত অনুমোদন দিলে বাংলাদেশেও তা দ্রুত পাওয়ার আশা তৈরি হয়।

কিন্তু সেরাম ইনস্টিটিউটের প্রধান নির্বাহী আদর পূনাওয়ালার বরাত দিয়ে রোববার রাতে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়, রপ্তানি শুরুর আগে আগামী দুই মাস তারা ভারতের স্থানীয় চাহিদা পূরণ করতেই জোর দেবে। ওই খবরে বাংলাদেশের টিকা পাওয়া বিলম্বিত হতে পারে বলে শঙ্কা তৈরি হয়।

এই প্রেক্ষাপটে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক সোমবার দুপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “এ বিষয় নিয়ে সকাল থেকে কাজ করছি। বেক্সিমকো, ফরেন মিনিস্ট্রি ও ভারতের মিশনের সাথে আলোচনা হয়েছে। তারা আশ্বস্ত করেছেন, আমাদের সাথে যে চুক্তি হয়েছে সেই চুক্তি ব্যাহত হবে না। কোনো সমস্যা হবে না, আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি।”

আর স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিব মো. আবদুল মান্নান বলেন, “যে নিষেধাজ্ঞার কথা বলা হয়েছে, এই নিষেধাজ্ঞার কথা ভারত সরকার বলেছে শুধুমাত্র কর্মাশিয়াল অ্যাকটিভিটিজের ওপর, আমাদেরগুলোর ওপর না। কারণ আমাদেরটা সরকার টু সরকার।”

টিকা নিয়ে ‘আশঙ্কার কিছু নেই’ বলে আশ্বস্ত করে সচিব বলেন, “সেরাম ইনস্টিটিউট অব ইনডিয়া ভারত সরকারের অনুমোদন পেয়েছে। এ অনুমোদন পাওয়ার পর তারা ডব্লিউএইচওর কাছে অনুমোদনের জন্য যাবে, সেখানে তিন সপ্তারের মত সময় লাগবে। আমাদের সময় বলা ছিল ফেব্রুয়ারিতে পাব। এ তিন সপ্তাহ পর, অর্থাৎ ডিলে হওয়ার কোনো অবকাশ নেই। দুঃচিন্তা হওয়ার মত এখনো কিছু হয়নি।”

আর পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বিকালে সাংবাদিকদের বলেন, “ওরা (ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়) বলেছেন যে, টিকার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত যেহেতু সর্বোচ্চ পর্যায়ের ছিল, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সাথে আলাপ করেই এটা হয়েছে, বাংলাদেশ প্রথম টিকা পাবে। সুতরাং কোনো ধরনের ব্যান এটার উপরে হবে না। এটা নিয়ে চিন্তার কোনো কারণ নাই। উনারা বলেছেন যে, বাংলাদেশ মাস্ট নট বি কনসার্নড।”

বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাজমুল হাসানও সন্ধ্যায় নিজের বাসায় সংবাদ সম্মেলনে আসেন। তিনি বলেন, চুক্তি অনুযায়ী ‘নির্ধারিত সময়েই’ বাংলাদেশ টিকা পাবে, দেরি হওয়ার কোনো ইংগিত তারা সেরাম ইনস্টিটিউটের কাছ থেকে পাননি।

“সত্যি কথা বলতে কি, আমি বা আমরা এটা নিয়ে অতটা চিন্তিত না। কারণ আমার এগ্রিমেন্টটা হয়ে গেছে। ওই চুক্তিতে ক্লিয়ারকাট বলা আছে, আমাদের দেশে অ্যাপ্রুভাল দেওয়ার এক মাসের মধ্যে তারা আমাদের টিকা পাঠাবে।”

তবে সেরাম ইন্সটিটিউটের জনসংযোগ কর্মকর্তা মায়াঙ্ক সেনের বরাত দিয়ে বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, টিকা রপ্তানির ওপর ভারত সরকারের কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। তবে সেরাম ইন্সটিটিউট এখনও টিকা রপ্তানির অনুমতি পাওয়ার প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে, যা পেতে ‘কয়েক মাস পর্যন্ত’ সময় লেগে যেতে পারে।