তহবিল জটিলতা: অনিশ্চয়তায় সিনোভ্যাকের টিকার ট্রায়াল

বাংলাদেশে নতুন করোনাভাইরাসের টিকার ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের জন্য চীনের সিনোভ্যাক বায়োটেক লিমিটেড সরকারের অর্থায়ন (কো-ফান্ডিং) চাইলেও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তাতে রাজি না হওয়ায় পুরো বিষয়টি অনিশ্চয়তায় পড়েছে।

ওবায়দুর মাসুম জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 Oct 2020, 06:16 PM
Updated : 12 Oct 2020, 06:16 PM

গত ২২ সেপ্টেম্বর স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে একটি চিঠি দিয়ে সিনোভ্যাক জানায়, অগাস্টের শুরুতে বাংলাদেশে ট্রায়াল শুরু করার পরিকল্পনা ছিল তাদের। কিন্তু অনুমোদন পেতে দেরি হওয়ায় কোম্পানি তাদের তহবিল অন্য দেশে দিয়ে দিয়েছে।

বাংলাদেশে ট্রায়ালের জন্য দ্য কোয়ালিশন ফর এপিডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস ইনোভেশনস বা সেপির কাছে তহবিলের জন্য আবেদন করলেও সেখান থেকে সহায়তা না পাওয়ার কথা ওই চিঠিতে জানায় সিনোভ্যাক। এ অবস্থায় চীনা ওই কোম্পানি বাংলাদেশে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের জন্য সরকারের কাছ থেকে ‘কো-ফান্ডিং’ চায়।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছেন, সিনোভ্যাককে নিজেদের অর্থেই ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল করতে হবে।

“ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের অনুমতি চাওয়ার সময় সিনোভ্যাক নিজেদের খরচে তা করবে বলেছিল। সে কারণেই তাদেরকে অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। এটাও বলেছিল, তারা আমাদের এক লাখ ডোজ ফ্রি দেবে। এসব নিয়ে আলোচনার পর তারা অনুমতি চেয়ে চিঠি দিলে আমরা ট্রায়ালের অনুমোদন দিয়েছি।”

মন্ত্রী জানান, অনুমতি পাওয়ার পর পরীক্ষামূলক প্রয়োগ শুরু করতে দেরি হওয়ায় আইসিডিডিআর’বির মাধ্যমে দেরির কারণ জানতে চেয়েছিল মন্ত্রণালয়।

“আমরা জানতে চাওয়ার বেশ কিছু দিন পর তারা জানাল, তাদের টাকাপয়সার স্বল্পতা। যেখান থেকে তাদের টাকা পাওয়ার কথা সেখান থেকে পায় নাই। এ অবস্থায় আমাদের কাছে ফান্ডিং চেয়েছে।”

স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, যেহেতু সিনোভ্যাক ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল করবে, সেহেতু টাকার যোগান তাদেরকেই দিতে হবে।

“তারা ওইভাবেই বলেছিল শুরুতে। একটা দেশ ট্রায়ালের অনুমোদন দিয়েছে- সেটাই তো একটা বড় বিষয়। তারা ট্রায়ালের অনুমতি নিয়েছে, সেখানে কো-ফান্ডিংয়ের কথা ছিল না। বিষয়টি নিয়ে চীন সরকারের সঙ্গে তো চুক্তি না। এটা তো প্রাইভেট কোম্পানি, প্রাইভেট কোম্পানির সঙ্গে কো-ফান্ডিং সম্ভব না।”

তবে সরকারের এই অবস্থানের কথা সিনোভ্যাককে এখনও লিখিতভাবে জানায়নি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।

এ কারণে টিকার পরীক্ষামূলক প্রয়োগের প্রক্রিয়াটি থেমে গেল কি না জানতে চাইলে জাহিদ মালেক বলেন, “এটা নির্ভর করছে সিনোভ্যাকের ওপর।”

সিনোভ্যাকের অবস্থান বদলানোর কারণ ‘বুঝতে পারছেন না’ বলে মন্তব্য করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী।

“এ ব্যাপারে আমরা কিছুই বলতে চাচ্ছি না। সেটা তাদের ওপর নির্ভর করছে। তারা কেন এমন করছে তা তো বুঝতে পারছি না। তারা তো বড় প্রতিষ্ঠান, তাদের তো টাকার অভাব হওয়ার কথা না।”

সিনোভ্যাকের টিকার ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল বাংলাদেশে না হলেও তাদের টিকা পেতে কোনো সমস্যা হবে না বলে মনে করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী।

তিনি বলেন, সিনোভ্যাক আরও কয়েকটি দেশে ট্রায়াল চালাচ্ছে। তাদের টিকা কার্যকর প্রমাণিত হলে বাংলাদেশও তা পাবে।

“যদি এমন হয়, তাদের টিকা অনুমোদন পেয়েছে, তখন আমরা কিনে নিতে পারব, সেই অপশন তো খোলাই আছে। টিকা কার্যকর হলে ডব্লিউএইচওর সঙ্গেই কাজ করবে। ডব্লিউএইচও বিভিন্ন দেশকে টিকা দেবে, সে হিসেবে আমরাও পাচ্ছি।”

বিশ্বে গত একশ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বড় মহামারী ডেকে এনেছে নতুন করোনাভাইরাস। এতে ১০ লাখ ৭৫ হাজারের বেশি মানুষ ইতোমধ্যে মারা গেছে। বাংলাদেশেও মৃত্যুর সংখ্যা সাড়ে ৫ হাজার ছাড়িয়েছে।

এই রোগের কোনো ওষুধ এখনও আবিষ্কৃত না হওয়ায় টিকার গবেষণার ‍দিকেই তাকিয়ে আছে বিশ্ববাসী। রাশিয়া ও চীন ইতোমধ্যে টিকা তৈরি করে তার প্রয়োগও শুরু করেছে। আরও কয়েকটি দেশের টিকাও রয়েছে চূড়ান্ত পর্যায়ে। তবে এর কোনোটি এখনও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার চূড়ান্ত অনুমোদন পায়নি।

বিশ্বের নানা দেশের নানা কোম্পানি কোভিড-১৯ টিকা তৈরি করলেও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার স্বীকৃতিবিহীন কোনো টিকা না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ সরকার।

টিকা পাওয়ার জন্য ইতোমধ্যে গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিন অ্যান্ড ইমুনাইজেশনের (গ্যাভি) কাছে আবেদন করে রেখেছে বাংলাদেশ। তবে বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে শুরুতে বিনা খরচে টিকা পাওয়া যাবে না ধরে নিয়ে তা কেনার জন্য ৬০০ কোটি টাকা রেখেছে সরকার।

চীনের সিনোভ্যাক বায়োটেক লিমিটেডের ওই টিকা বাংলাদেশে পরীক্ষামূলক প্রয়োগের কাজটি আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র আইসিডিডিআর,বির সঙ্গে করার কথা ছিল। টিকার তৃতীয় ধাপের পরীক্ষা চালাতে গত এপ্রিল থেকে আইসিডিডিআর,বির সঙ্গে কাজ শুরু করে সিনোভ্যাক।

গত ১৮ জুলাই এই টিকা বাংলাদেশে পরীক্ষামূলক প্রয়োগের অনুমোদনও দেয় বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিল, বিএমআরসি। তবে সরকারের সিদ্ধান্তহীনতায় বেশ কিছুদিন বিষয়টি ঝুলে থাকে।

পরে ২৭ অগাস্ট চীনের তৈরি এ টিকা বাংলাদেশে পরীক্ষামূলক প্রয়োগের অনুমতি দেয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। মন্ত্রী জাহিদ মালেকই সে খবর সংবাদমাধ্যমকে জানান।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইউনিট-১ ও ইউনিট ২, মুগদা জেনারেল হাসপাতাল, মহানগর জেনারেল হাসপাতাল, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতাল এবং হলিফ্যামিলি হাসপাতালে এই টিকার পরীক্ষামূলক প্রয়োগের কথা বলা হয় সে সময়। তখন জানানো হয়, ১৮ মাস ধরে দেশের স্বাস্থ্যকর্মীদের ওপর ওই টিকার পরীক্ষামূলক প্রয়োগে চলবে।

সিনোভ্যাক বায়োটেক লিমিটেড দাবি করেছে, তারা প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপে ৭৪৩ জনের উপর এই টিকার পরীক্ষামূলক প্রয়োগ করে সফলতা দেখেছে। তাদের টিকা ওই ট্রায়ালে অংশগ্রহণকারীদের দেহে নতুন করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এবং করোনাভাইরাস প্রতিরোধে গঠিত জাতীয় কারিগরী পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. মো. নজরুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সরকার অনুমোদন দিতে ‘দেরি করায়’ সিনোভ্যাকের টিকা নিয়ে এই জটিলতা তৈরি হল।

“ভ্যাকসিনের ট্রায়ালটা আগে দিতে পারলে আমাদের সুবিধা হত। আস্তে আস্তে এসব জটিলতা তৈরি হল। বাংলাদেশের সুযোগ ছিল। ১ লাখের বেশি ডোজ ফ্রি দেবে, বাংলাদেশের কোনো কোম্পানিকে ভ্যাকসিন তৈরি করতে দেবে- এসব কথাও তখন শুনেছি। ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল না হলে হয়ত এসব সুবিধা পাওয়া যাবে না। আগে তৈরি হলে আগে ব্যবহার করতে পারতাম।”