ডব্লিউএইচও স্বীকৃত কোভিড-১৯ টিকাই কেবল নেবে বাংলাদেশ

বিশ্বের নানা দেশের নানা কোম্পানি কোভিড-১৯ টিকা তৈরি করলেও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার স্বীকৃতিবিহীন কোনো টিকা না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ সরকার।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 Oct 2020, 11:12 AM
Updated : 7 Oct 2020, 11:15 AM

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে বুধবার মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম সরকারের এই সিদ্ধান্ত জানিয়েছেন।

সারাবিশ্ব যখন মহামারীতে জেরবার, তখন টিকা শুরুতে বিনা খরচে পাওয়া যাবে না ধরে নিয়ে তা কেনার জন্য ৬০০ কোটি টাকা রেখেছে সরকার।

মন্ত্রিপরিষদ সচিব জানান, দেশে সবাইকে না পারলেও দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে বিনামূল্যে টিকা দেওয়ার পরিকল্পনা সরকারের রয়েছে।

বিশ্বে গত একশ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বড় মহামারী ডেকে এনেছে নতুন করোনাভাইরাস। এতে ১০ লাখের বেশি মানুষ ইতোমধ্যে মারা গেছে। বাংলাদেশেও মৃত্যুর সংখ্যা ৫ হাজার ছাড়িয়েছে।

এই রোগের কোনো ওষুধ এখনও আবিষ্কৃত না হওয়ায় টিকার ‍দিকেই চেয়ে আছে বিশ্ববাসী। রাশিয়া ও চীন ইতোমধ্যে টিকা তৈরি করে তার প্রয়োগও শুরু করেছে। আরও কয়েকটি দেশের টিকাও রয়েছে চূড়ান্ত পর্যায়ে। তবে এর কোনোট এখনও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার চূড়ান্ত অনুমোদন পায়নি।

বুধবারের বৈঠকে কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন বা টিকা সংগ্রহের বিষয়ে সর্বশেষ পরিস্থিতি স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ মন্ত্রিসভাকে জানায়।

মন্ত্রিসভার ভার্চুয়াল বৈঠক শেষে সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব আনোয়ারুল ইসলাম বিশ্বে টিকা তৈরির অগ্রগতি এবং টিকা পেতে বাংলাদেশের পদক্ষেপগুলো তুলে ধরেন।

তিনি বলেন, ভ্যাকসিনের জন্য বিভিন্ন দেশে উঠেপড়ে লেগেছে। ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল হয়েছে ৪৬টি ভ্যাকসিনের, আর প্রি-ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চলছে ৯১টি ভ্যাকসিনের।

যারা টিকা তৈরি করছে, শুরু থেকেই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে জানিয়েই মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, “আমাদের একটা বেইজলাইন হল ডব্লিউএইচও যেটাকে রিকগনাইজ না করবে, সেটাকে আমরা একসেপ্ট করব না।

“এটাকে বেজলাইন ধরে আমাদের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ডিপার্টমেন্টগুলো এবং আমাদের ফার্মাসিটিক্যালস কোম্পানি পার্সোনালি বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যোগাযোগ করছে এখানে প্রোডাকশনের জন্য।”

টিকা পেতে দৌড়ঝাঁপ

স্বাস্থ্য বিভাগ পদক্ষেপের বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, গত ৪ জুন যুক্তরাজ্যের উদ্যোগে লন্ডনে ‘গ্লোবাল ভ্যাকসিন সামিট-২০২০’ অনুষ্ঠিত হয়, এই সামিটে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ভিডিও বার্তা প্রেরণ করেন, বিশেষ করে গ্যাভির (গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিন অ্যান্ড ইমুনাইজেশন) পক্ষ থেকে ভ্যাকসিন পাওয়ার যোগ্য দেশ হিসেবে ঘোষণার যে আবেদন জানানো হয়, তা গ্রহণ করা হয়েছে।

চীনের বেসরকারি কোম্পানি সিনোভ্যাকের টিকার বিষয়ে তিনি বলেন, “সরকারের কাছে আইসিডিডিআর,বি আবেদন জানানোর পর তা অনুমোদন করা হয়েছে। এখানে সিনোভ্যাকের ভ্যাকসিনের একটা ট্রায়ালের ব্যবস্থা করার চেষ্টা করছে।”

বাংলাদেশে পরীক্ষামূলক প্রয়োগ হলে টিকা কম দামে পাওয়ার সুযোগ তৈরি হবে বলে জানান তিনি।

“বাংলাদেশ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে একটু লেস প্রাইসে আমরা ভ্যাকসিন পাবে। শুধু তাই না, আমাদের এখানকার এক বা একাধিক ফার্মাসিটিক্যালস কোম্পানি ইন্ট্রোডিউস করবে।”

রাশিয়া টিকা প্রয়োগ শুরু করলেও তার কার্যকারিতা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের সন্দেহ রয়েছে। ছবি: রয়টার্স

রাশিয়ার টিকার বিষয়ে তিনি বলেন, “রাশিয়ার ক্যামেলিয়া ন্যাশনাল রিসার্চ সেন্টারের এপিডেমিওলজি এবং মাইক্রোবায়োলজি ‘স্পুটনিক’ ভ্যাকসিন প্রযুক্তি বাংলাদেশে হস্তান্তরের জন্য অফার দিয়েছে। এটাও বিবেচনা করা হচ্ছে।

“এ বিষয়ে রাশিয়ার সঙ্গে আমাদের পুরো যোগাযোগ আছে। কিন্তু আমরা কন্ডিশন দিয়েছি এটার জন্য ডব্লিউএইচও’র অ্যাপ্রুভাল লাগবে।”

ভারতের টিকার বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, “আরেকটি হচ্ছে ভারতের বায়োটেক, সেটা তারা আমাদের এখানে ট্রায়াল করার আগ্রহ দেখিয়েছে। এ বিষয়ে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ ও ভ্যাকসিন কার্যক্রম এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। ৩৬ জনের প্রশিক্ষণের প্রস্তাব করেছে। অনলাইনে অরিয়েন্টেশন ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে।”

ফ্রান্স ও বেলজিয়ামভিত্তিক সানোফি অ্যান্ড জিএসকে উদ্ভাবিত টিকা উৎপাদনের জন্য বাংলাদেশের দুটি ওষুধ কোম্পানি আগ্রহ দেখিয়েছে বলে জানান তিনি।

টিকা কিনতে বরাদ্দ

কোভড-১৯ টিকা কেনার জন্য বাজেটে একটি প্রকল্পের আওতায় ৬০০ কোটি টাকার সংস্থান রাখা হয়েছে বলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব জানান।

তিনি বলেন, “অর্থ সচিব আমাদের নিশ্চিত করেছেন, কোনো কারণে যদি ফরেন কারেন্সি নাও পাওয়া যায়, আমাদের বাজেটে সেটার সংস্থান রাখা হয়েছে। ভ্যাকসিন কেনার জন্য টাকা-পয়সার কোনো সমস্যা ইনশাআল্লাহ হবে না।”

সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কথা স্মরণ করিয়ে তিনি বলেন, ““জাতীয় সংসদের নবম অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী যখন ভাষণ দেন, তখন তিনি বলেছিলেন, কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন তৈরিকারী সকল দেশের সঙ্গে যোগাযোগ করে ভ্যাকসিন নিতে অর্থ বরাদ্দ করেছি। যেখানে ভ্যাকসিনটি প্রথম পাওয়া যাবে সেখান থেকে সংগ্রহ করা হবে।”

বাংলাদেশে বিনা পয়সায় টিকা পাওয়ার সুযোগ নষ্ট করছে বলে যে কথা উঠেছে, তা নিয়েও বলেন খন্দকার আনোয়ারুল।

“বিনা পয়সায় ভ্যাকসিন আসার ইমিডিয়েট কোনো সম্ভাবনা নেই, এটা আমাদেরকে বুঝতে হবে। সারা পৃথিবীতে একটা কম্পিটিশন চলছে। বিনা পয়সায় এই ভ্যাকসিন পাওয়ার এখনই কোনো সুযোগ নেই। যদি আসে গ্যাভির মাধ্যমে সেটাও একটু দেরি হবে।”

কবে নাগাদ টিকা

মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, টিকা কখন কবে বাজারে আসবে, সেটা সুনির্দিষ্টভাবে কোনো কোম্পানি বলতে পারছে না।

“আমি যে তালিকাটা দেখলাম, ২০২১ সালের এপ্রিল-মে-জুনের আগে মার্কেটে আসবে বলে তারা নিশ্চয়তা দিতে পারছে না। যদি এর আগে সাকসেসফুল হয়ে যায়, তবে ইনশাল্লাহ সবার সঙ্গেই আমাদের যোগাযোগ আছে।”

এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “কিছু কিছু টেকনিক্যাল সাইডও আমাদের দেখতে হচ্ছে। দু-একটা ভ্যাকসিন আছে যেটা মাইনাস ৮০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করতে হবে। এটা খুব ডিফিকাল্ট আমাদের মতো দেশে। বেশিরভাগ যেগুলো আমাদের দেশের জন্য সুইটেবল সেগুলো ২ থেকে ৮ ডিগ্রির মধ্যে সংরক্ষণ করতে হয়।”

সবাইকে বিনামূল্যে নয়

করোনাভাইরাস টিকা পেলেও তা দেশে সবাই বিনামূল্যে পাচ্ছেন না বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব।

সাংবাদিকদের প্রশ্নে তিনি বলেন, “ভ্যাকসিনের প্রাইসটা তো এখনো ফিক্সড যায়নি। সব কিছু দেখা যাক।”

তবে গরিব মানুষদের বিনামূল্যে দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানান খন্দকার আনোয়রুল।

“সাধারণ মানুষ যারা কিনতে পারবে না সেজন্য ডেফিনেটলি একটা বড় পোরশন ফ্রি দেওয়া হবে। এটা প্রাইমারি চিন্তাভাবনায় আছে।”

সিনোভ্যাক বিনিয়োগের কথা বলছে, সরকার বিনিয়োগ না করায় এক ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে বলে খবর ছড়িয়েছে।

সে বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, “অনিশ্চয়তা কিছুই নেই। তারা বলেছে কিছু একটা ফান্ডিং করার জন্য। আমরা এটা নিয়ে আলোচনা করছি।

“তারা যে ফান্ডিং চাচ্ছে সেটা র‌্যাশনাল কিনা, একটা সরকারি পর্যায়ে করতে হবে নাকি বেসরকারি কোনো জায়গা থেকে করতে হবে, এগুলো নিয়ে আলোচনা করছি।”