কোভিড-১৯: সংক্রমণ কমাতে সক্রিয় ব্র্যাকের সামাজিক সহায়তা দল

দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা যখন সাড়ে তিন লাখ ছাড়িয়ে ক্রমেই উর্ধ্বগামী, তখন সামাজিক সংক্রমণ ঠেকাতে রাজধানীতে সক্রিয় হয়ে উঠছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় এনজিও ব্র্যাকের সামাজিক সহায়তা দল।

জয়ন্ত সাহা নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 Sept 2020, 06:23 PM
Updated : 29 Sept 2020, 07:14 PM

করোনাভাইরাসে সামাজিক সংক্রমণ ঠেকাতে সরকারের নানা বিধিনিষেধ, লকডাউন ও জোনিং পদ্ধতি যখন কাজে আসছে না, তখন ব্র্যাক তাদের স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জনসংখ্যা বিষয়ক কর্মসূচির অধীনে ‘কোভিড-১৯ রেসপন্স: কমিউনিটি সাপোর্ট টিম (সিএসটি)’ প্রকল্প শুরুর উদ্যোগ নেয়।

চলতি বছর এপ্রিলে ঢাকা ও খুলনায় দুই সপ্তাহের জন্য পাইলট প্রকল্প হিসেবে পরিচালনার পর জুনের শেষ সপ্তাহে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের নানা এলাকায় ‘কোভিড-১৯ রেসপন্স: কমিউনিটি সাপোর্ট টিম (সিএসটি)’ প্রকল্পটির কাজ জোরেশোরে শুরু হয়েছে।

ব্র্যাক জানিয়েছে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের অধীনে পরিচালিত এই প্রকল্পটিতে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা, জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিল, শিশু তহবিল, বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি অর্থায়ন করছে।

স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে প্লাটফর্ম, হিমু ও ইয়ুথ বাংলা কাজ করছে এই কর্মসূচিতে। প্রযুক্তি সহযোগিতায় রয়েছে অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন-এটুআই ও স্বাস্থ্য মনিটরিং ব্যবস্থা সিমেড।
মঙ্গলবার ব্র্যাক রাজধানীর মিরপুরে তাদের এ কর্মসূচি সাংবাদিকদের ঘুরিয়ে দেখায়। পরে ব্র্যাক কার্যালয়ে প্রকল্পের বিস্তারিত তুলে ধরেন ব্র্যাকের স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জনসংখ্যা বিষয়ক কর্মসূচির সহযোগী পরিচালক মোরশেদা চৌধুরী।

এপ্রিল-জুনে দেশের সরকারি, বেসরকারি হাসপাতালগুলো করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের ভিড় সামাল দিতে যখন হিমশিম খাচ্ছিল, তখন ব্র্যাক এই কর্মসূচি ত্বরান্বিত করার উদ্যোগ নেয় বলে জানান তিনি।

মোরশেদা বলেন, “আমরা মডেল তৈরি করলাম, যেন আমাদের কমিউনিট হেলথ ওয়ার্কাররা বাড়ি বাড়ি গিয়ে করে মানুষের লক্ষণ-উপসর্গ দেখবে। তখন তারাই শনাক্ত করবে, সে ব্যক্তির কি করোনা হতে পারে নাকি নাও হতে পারে? সে বিবেচনায় হেলথ ওয়ার্কাররা তাকে আইসোলেটেড করবে ও তার পরিবারের সদস্যদের কোয়ারেন্টিন করতে বলবে।

“সবাইকে তো টেস্ট করা সম্ভব না। সবাইকে হাসপাতালে পাঠানো সম্ভব না। হসপিটালে এত রোগী যেত, চিকিৎসা পেত না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও কিন্তু বলছে, বাড়িতেই করোনা রোগীর চিকিৎসা সম্ভব। আমরা সেদিকেই মন দিলাম।”

কোভিড-১৯ রোগীকে বিবেচনায় না নিয়ে সিএসটি কেন সন্দেহভাজন রোগীদের সেবায় নিয়োজিত, সে প্রশ্নের ব্যাখ্যা দেন মোরশেদা।

ব্র্যাকের সহযোগী পরিচালক এ প্রসঙ্গে তুলে ধরেন আইসিডিডিআর,বি ও আইইডিসিআরের যৌথ গবেষণার তথ্য।

গত অগাস্টের মধ্যভাগে প্রকাশিত সে গবেষণায় বলা হয়, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় সোয়া তিন হাজার পরিবারের ১২ হাজার মানুষের ওপর জরিপ চালিয়ে ৯ শতাংশের করোনাভাইরাস সংক্রমণ ধরা পড়ে।

মোরশেদা বলেন, “কোভিড চিহ্নিত হয় খুব কম মানুষ। প্রতিদিন ১১-১২ হাজার টেস্ট মাত্র হয়, তার মধ্যে থেকে ২ হাজার, ৩ হাজার মাত্র আইডেন্টিফাইড হয়।

ব্র্যাকের স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জনসংখ্যা বিষয়ক কর্মসূচির সহযোগী পরিচালক মোরশেদা চৌধুরী।

“যদি আইসিডিডিআর বি’র গবেষণাপত্র দেখেছেন, সিটিতে ৯ পারসেন্ট পজিটিভ। এদের ৯৪ পারসেন্টের মধ্যে কিন্তু লক্ষণ নাই। লক্ষণবিহীন এ রোগীরা সমাজে রোগ ছড়াচ্ছে। এদের যেহেতু কোনো লক্ষণ-উপসর্গ নাই, তারা কিন্তু টেস্ট করতেও যাবে না।

“চিহ্নিত করার পাশাপাশি আমরা যদি মৃদু লক্ষণ-উপসর্গ রোগীদের সচেতন করতে পারি, যদি তাদের আইসোলেটেড করতে পারি, তাহলে কিন্তু ইনফেকশন রেটটা কিন্তু আমরা কমাতে পারব।”

“আমরা ইনফেকশন রেট একের নিচে নামাতে চাই। তাহলেই আমরা বলতে পারব, করোনার সংক্রমনের গ্রাফটা নিচে নেমে আসছে,” বলেন তিনি।

আগামী নভেম্বর মাস পর্যন্ত মেয়াদ ব্র্যাকের ‘কোভিড-১৯ রেসপন্স : কমিউনিটি সাপোর্ট টিম (সিএসটি)’ কর্মসূচির।

এ কর্মসূচির মাধ্যমে সামাজিক নেতৃত্ব তৈরি করাও ব্র্যাকের লক্ষ্য বলে জানালেন মোরশেদা।

“আমরা যদি কমিউটিনিতে কতগুলো মানুষকে শিখিয়ে দিতে পারি, কীভাবে করোনা রোগ শনাক্ত করতে হয়, কীভাবে প্রতিরোধ করতে হয়….. মাস্ক পরা, হাত ধোয়া, ফিজিক্যাল ডিসটেন্স এ ব্যাপারগুলো……..তাহলে আমরা তাদের মধ্যে প্রতিনিধি বা নেতৃত্ব তৈরি করতে পারব। এ কর্মসূচি শেষ হয়ে গেলেও পরে তারা এটাকে চালিয়ে নিয়ে যাবে।”

যেভাবে কাজ করে সিএসটি

করোনাভাইরাসের সেবা পেতে সরকারি তথ্য সেবার হটলাইন নাম্বার ‘৩৩৩’ ও স্বাস্থ্য বাতায়ন ‘১৬২৬৩’ নম্বরে যে ফোন কলগুলো আসে, তা নিয়েই মূলত কাজ করে ‘কোভিড-১৯ রেসপন্স: কমিউনিটি সাপোর্ট টিম (সিএসটি)’।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে সে তালিকা নিয়ে ব্র্যাক সিএসটি রাজধানীর উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকার ৫৪টি ওয়ার্ডের প্রতিটিতে দুয়ারে দুয়ারে ঘুরছে।

ব্র্যাকের স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জনসংখ্যা বিষয়ক প্রোগ্রামের ব্যবস্থাপক ইমরান আহমেদ চৌধুরী জানান, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে ৫৪টি ওয়ার্ডে সিএসটির ২৯৫টি দল কাজ করছে। ব্র্যাক এ কর্মসূচিতে সরকারের স্বাস্থ্যকর্মীদেরই অন্তর্ভুক্ত করেছে।

তবে যেখানে সরকারি স্বাস্থ্যকর্মী নেই, সেখানে স্থানীয় নানা এনজিওর কর্মীদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যেখানে তাও নাই, সেখানে মেডিকেল ও নন-মেডিকেল ভলান্টিয়ার নেওয়া হয়েছে। সিএসটির প্রতিটি সদস্যকে তিন দিনের ‘এক্সটেনসিভ রেসিডেনসিয়াল ট্রেনিং’ নিতে হয়।

ইমরান জানান, ঢাকায় বিভিন্ন এলাকায় সিএসটি টিম ৬২ হাজার নাগরিককে পরীক্ষা করেছে, যাদের মধ্যে ১৫ হাজার ৪০০ জনকে ‘কোভিড সাসপেক্টেড’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে।

এই সন্দেহভাজন রোগীদের ‘পটেনশিয়াল ভাইরাস ফাইটার-পিভিএফ’ হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের স্বাস্থ্যগত সহযোগিতার কাজ ত্বরান্বিত করে সিএসটি।

গত ১ সেপ্টেম্বর থেকে এই পিভিএফদের খাদ্য সহযোগিতা দিচ্ছে সিএসটি। ইতোমধ্যে ৭ হাজার পিভিএফকে খাদ্য সহায়তা দেওয়া হয়েছে বলে জানান ইমরান।

ব্র্যাকের স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জনসংখ্যা বিষয়ক প্রোগ্রাম-মানসীর অধীনে পল্লবী এলাকায় সিনিয়র ব্রাঞ্চ ম্যানেজার হিসেবে কাজ করছেন ফরিদা ইয়াসমিন সঙ্গীতা।

তিনি জানান, সিএসটির সদস্যরা প্রতিদিন বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রাপ্ত তথ্য একটি মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে ‘ভেরিফাইড ভাইরাস ফাইটার রেজিস্ট্রার’ এ আপলোড করছেন। তারা যাদের শনাক্ত করছেন, তাদের স্বাস্থ্য সচেতনতায় নানাভাবে সতর্ক করার পাশাপাশি নিয়মিত পর্যবেক্ষণেও রাখছেন।

আইসোলেটেড করা কোনো রোগীর যদি নমুনা পরীক্ষার প্রয়োজন হয়, তবে কোথাও গিয়ে সহজে পরীক্ষা করতে পারবে, সে বিষয়েও সহযোগিতা করছে সিএসটি টিমের সদস্যরা।

সঙ্গীতা জানান, পিভিএফদের চাল, ডাল, তেলের পাশাপাশি সবুজ শাকসবজি ও দেওয়া হচ্ছে। যাদের ওষুধ কিনে খাওয়ার মতো আর্থিক সামর্থ্য নেই, তাদের তারা ওষুধও কিনে দিচ্ছেন।

‘ব্র্যাকই তো পাশে দাঁড়াইল’

পল্লবীর ই ব্লকের বস্তির বাসিন্দা রহিমা খাতুন ব্র্যাকের সিএসটি কর্মসূচির উপকারভোগী।

তিনি বলেন, “গত সপ্তাহে প্রচণ্ড জ্বর আসছিল আমার। আমার ছোট্ট একটা ঘর, তাতে তিন জন মহিলা প্রেগন্যান্ট। আমি তো কী করুম, কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। পরে সিএসটির এক আপা আইল। তিনি আমারে কইল, কী কী করতে হইবে। তারপর আপা (সিএসটির স্বাস্থ্যকর্মী) যা যা কইল, আমি মাইন্যা চললাম।

“এখন আমার জ্বর নাই। তবুও আরও ৭ দিন আমারে একলা (কোয়ারেন্টিনে) থাকতে হইবে। কাজ কাম নাই, অভাবের দিন। এ সময়ে ব্র্যাকই আইস্যা আমাগো পাশে দাঁড়াইল।”

কালসী এলাকার একটি বস্তিতে ৭৫ বছর বয়সী মো. কাশেম এখন শয্যাশায়ী। কালসী এলাকার একটি ছোট্ট দোকান চালিয়ে ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনীসহ সাত জনের পরিবারের ভরণপোষণ করতেন।

তার নাতনী লায়লা খাতুন জানান, কিছুদিন আগে স্ট্রোক করার পর তার নানা একেবারে শয্যাশায়ী।

অর্থাভাবে সঙ্কটে পড়ে যাওয়া নানাকে নিয়ে কী করবেন যখন ভেবে পাচ্ছিলেন না লায়লা, তখন তার যোগাযোগ হয় সিএসটি কর্মীদের সঙ্গে।

লায়লা বলেন, “ব্র্যাক থেকে এখন আমাদের দেখভাল করতাছে। প্রতি দিন একজন আপা আসেন। নানার স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে তিনি দেখভাল করেন। আমাদের কারে কী করতে হবে, তা তারা বলে দেন। ওষুধও দেন। এ সময়ে ব্র্যাক যে উপকার করছে, তা ভুলব না।”