অব্যবস্থাপনায় ডুবছে হলি ফ্যামিলি হাসপাতাল

পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা, চিকিৎসার সুনাম থাকার পরও চরম আর্থিক সঙ্কটে ধুঁকছে রাজধানীর অন্যতম পুরনো হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতাল। আর্থিক সঙ্কট চরমে পৌঁছেছে এ বছর।

ওবায়দুর মাসুম জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 Sept 2020, 06:50 PM
Updated : 17 Sept 2020, 06:50 PM

অর্থাভাবে গত কয়েক বছর ধরে হাসপাতালের চিকিৎসক-কর্মীদের বেতন অনিয়মিত হয়ে পড়েছে। পাঁচ মাসের বকেয়া বেতনভাতার দাবিতে গত ৮ সেপ্টেম্বর হাসপাতালের পরিচালককে অবরুদ্ধ করে বিক্ষোভও করেছেন চিকিৎসক-কর্মীরা।

ক্ষুব্ধ চিকিৎসক-কর্মচারীররা হাসপাতালের বর্তমান দুরবস্থার জন্য গভর্নিং বডির অদক্ষতা-অব্যবস্থাপনাকে দায়ী করেছেন।

তাদের অভিযোগ, দলীয় বিবেচনায় অদক্ষ লোকদের গভর্নিং বডিতে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তাদের প্রশাসনিক অদক্ষতা রয়েছে। গভর্নিং বডি বিভিন্ন সময় প্রয়োজনের অতিরিক্ত জনবল নিয়োগ দিয়েছে। হাসপাতালের আয় বাড়াতে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

আর হাসপাতালের বর্তমান অবস্থার জন্য আগের গভর্নিং বডির ব্যর্থতাকে দায়ী করেছেন বর্তমান পরিচালক এবং একজন সদস্য।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ হাসপাতালে কর্মীদের বেতনভাতা বাবদ প্রতি মাসে তিন কোটি টাকার বেশি লাগে। ঈদুল ফিতরের বোনাস এক কোটি ৭০ লাখ ৫৪ হাজার ৭০ টাকা, জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি ও মার্চ এই তিন মাসের বেতনের সাত কোটি ৬৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা (জানুয়ারির আংশিক এক কোটি ৬২ লাখ ৪৮ হাজার, ফেব্রুয়ারির তিন কোটি এক লাখ ৮৫ হাজার এবং মার্চের তিন কোটি এক লাখ ১৬ হাজার টাকা) বকেয়া আছে।

গত ১৭ মে এ হাসপাতালে কোভিড-১৯ আক্রান্তদের চিকিৎসা চালু করে সরকার। এরপর জুন মাসের বেতন বাবদ তিন কোটি এক লাখ ৫৬ হাজার টাকা এবং অন্যান্য খরচ বাবদ চার কোটি ২৩ লাখ টাকা একটি বিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে জমা দেওয়া হয়। গত ১০ সেপ্টেম্বর স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে বিল পাওয়ার পর জুন মাসের বেতন পরিশোধ করা হয়েছে। জুলাই, অগাস্টের বিল এখনও তৈরি হয়নি।

এর মধ্যে গত বুধবার কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসায় হাসপাতালটির সঙ্গে করা চুক্তি থেকে বেরিয়ে এসেছে সরকার।

রাজধানীর মগবাজারে ১৯৫৫ সালে গড়ে তোলা হলি ফ্যামিলি হাসপাতাল বর্তমানে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির একটি প্রতিষ্ঠান। তবে হাসপাতালকে নিজেদের আয় থেকে খরচ করতে হয়। রেড ক্রিসেন্ট কোনো আর্থিক সহায়তা দেয় না।

বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির গভর্নিং বডি হাসপাতাল পরিচালনা করেন। ১৫ সদস্যের গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান নিয়োগ দেন রাষ্ট্রপতি। বর্তমান চেয়ারম্যান সিলেট-৫ আসনের সংসদ সদস্য হাফিজ আহমেদ মজুমদার। জেলা কমিটির প্রতিনিধিরা ১৪ জন সদস্য নির্বাচিত করেন। ১৪ জনের মধ্য থেকেই দুজন ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।

হাসপাতালের মোট জনবলের মধ্যে ১০৩ জন চিকিৎসক, ২৫৬ জন নার্স এবং কর্মকর্তা-কর্মচারী ৪০৬ জন। গত পাঁচ বছর ধরে কোনো নিয়োগ হচ্ছে না। এর মধ্যে অনেকেই অবসরে গেছেন।

প্রভাষক থেকে অধ্যাপক পর্যন্ত চিকিৎসকরা কলেজের কোষাগার থেকে বেতন পান। রেজিস্ট্রার, কনসালটেন্ট, মেডিকেল অফিসার এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন হয় হাসপাতালের আয় থেকে।

হলি ফ্যামিলি হাসপাতালকে নিজেদের আয় থেকে খরচ করতে হয়। রেড ক্রিসেন্ট কোনো আর্থিক সহায়তা দেয় না।

বেতন অনিয়মিত হওয়ায় বিপাকে আছেন বলে জানিয়েছেন শিশু বিভাগের একজন চিকিৎসক। ওই চিকিৎসক জানান, তিন-চার বছর ধরে বেতন অনিয়মিত হওয়ার ঘটনা ঘটছে, তবে একটানা পাঁচ মাস ধরে বেতন বন্ধের ঘটনা এই প্রথম। বাধ্য হয়ে অনেকেই চাকরি ছাড়ার চিন্তা করছেন।

“করোনাভাইরাস চলে এসেছে বলে অনেকে চাকরি ছাড়তে পারছে না। নইলে অনেকেই চলে যেতেন। নতুন জায়গায় যাওয়া সমস্যা।”

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কনসালটেন্ট বলেন, এই হাসপাতালের সেবার মান ভালো। তবে পুরোনো হাসপাতাল ভবন, অবকাঠামোগত কিছু সমস্যার কারণে রোগী কমে গেছে।

ওই চিকিৎসক জানান, এক সময় বেশকিছু বড় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে হাসপাতালের চুক্তি ছিল; তাদের ওইসব প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের চিকিৎসা হত এখানে। তবে নতুন আরও ভালো মানের হাসপাতাল হওয়ায় সেসব প্রতিষ্ঠান চলে গেছে। তিনি বলেন, রোগী নিয়ে আসা বা ধরে রাখতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কার্যকর কোনো উদ্যোগ নিতে পারছে না।

“রোগী ফেরাতে হাসপাতাল রিনোভেশন করা যায়, যেসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি ছিল তা নবায়নে উদ্যোগ নেওয়া যায়। কিন্তু কেউ উদ্যোগ নিতে চায় না। কিভাবে কী করলে প্রতিষ্ঠানটি লাভের মুখ দেখবে তা দেখার কেউ এখানে নেই।”

দলীয় পরিচয়ে লোক নিয়োগ এই হাসপাতালের ভরাডুবির সবচেয়ে বড় কারণ বলে জানান আরেক চিকিৎসক। তিনি বলেন, হাসপাতালের চেয়ারম্যানসহ গভর্নিং বডির বেশিরভাগ নিয়োগ হয় রাজনৈতিক পরিচয়ে। আগের প্রায় সব চেয়ারম্যানের সময়ই দলীয় পরিচয়ে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি লোক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

গাইনি বিভাগের ওই চিকিৎসক বলেন, “চেয়ারম্যানরা আসেন রাজনৈতিক পরিচয়ে। ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকরা এটা নিয়ন্ত্রণ করেন। বিভিন্ন সময় চেয়ারম্যানরা তাদের নিজেদের লোক বসাতে অপ্রয়োজনীয় নিয়োগ দিয়েছেন। আবার অনেক বিভাগে লোকই নেই। এমন অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন যাদের কোনো কাজ নেই। বসে বসে বড় অংকের বেতন নিচ্ছেন।”

বর্তমান পরিস্থিতির জন্য গভর্নিং বডির দক্ষতার অভাবকে দায়ী করেন একজন অধ্যাপক। চাকরি জীবনের শেষদিকে থাকা এই অধ্যাপক বলেন, এসব কারণে রোগীরা এই হাসপাতাল বিমুখ হয়ে গেছেন।

তিনি বলেন, “ভালো স্পেশালিস্ট আনতে হবে। রোগীদের আস্থা বাড়াতে হবে। কোথাও অতিরিক্ত পেমেন্ট থাকলে তা সমন্বয় করতে হবে। এখানে এই জিনিসটা (পরিকল্পনা) হয় না। আমাদের জীবনের সবচেয়ে ভালো সময়টা এখানে কাটিয়েছি। ছেড়ে যাওয়ার সময় প্রিয় প্রতিষ্ঠানকে ভঙ্গুর অবস্থায় দেখতে হচ্ছে, এটাই খুব দুঃখের।”

চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা বকেয়া বেতনের দাবিতে গত ৯ সেপ্টেম্বর হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো মোরশেদকে তার কক্ষে অবরুদ্ধ করেন। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

এদিকে হাসপাতালের আয় বাড়াতে বর্তমান পরিচালনা পরিষদ ব্যর্থ- চিকিৎসক-কর্মচারীদের এমন অভিযোগের বিষয়ে হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ মোর্শেদ বলেছেন, পরিচালক হিসেবে দায় তার কাঁধেই চলে আসে।

“হাসপাতালের ক্যাপ্টেন হিসেবে এর ব্যর্থতার দায় আমার কাঁধে চলে আসে। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই।”

বর্তমান অবস্থার জন্য লোকবল ও বেতন বেড়ে যাওয়াকে দায়ী করে তিনি বলেন, ১৯৯১ সালে নিয়োগ পাওয়া একজন চেয়ারম্যানের সময়কাল থেকেই অতিরিক্ত লোকবল নিয়োগ দেওয়া শুরু হয়েছে। পরের সবাই মোটামুটি একইভাবে নিয়োগ দিয়েছে। তবে বর্তমান গভর্নিং বডি গত পাঁচ বছরে কোনো নিয়োগ দেয়নি।

তিনি বলেন, লোকবল ও বেতন বাড়লেও হাসপাতালের আয় বাড়েনি। তারা আয় বাড়ানোর চেষ্টা করছেন।

“আমরা আগেও চেষ্টা করেছি নানাভাবে। কোভিড পরিস্থিতি কিছুটা ভালো হলে আবারও চেষ্টা করব। আমরা আইসিইউ বাড়াচ্ছি, আলাদা ডায়ালাইসিস ইউনিট চালু করছি।”

এ ব্যাপারে গভর্নিং বডির ভাইস চেয়ারম্যান হাবিবে মিল্লাত বলেন, বিভিন্ন সময় হাসপাতালে প্রয়োজনের চেয়ে সাড়ে তিন থেকে চারশ জনবল নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল।

“আগের কমিটিতে যারা ছিলেন তারা এগুলো করেছেন। কিন্তু আয় বাড়েনি। এটা একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠান, বাইরে থেকে টাকা আসবে না। নিজেদের আয় নিজেরাই করতে হবে। আগে আরও অনেক বেশি দেনা ছিল। সেটা কমিয়ে এই পর্যায়ে নিয়ে আসা হয়েছে।”

তিনি বলেন, হাসপাতালের আয় বাড়ানো ছাড়া সমস্যা সমাধানের আর কোনো পথ নেই। তারা চেষ্টা করছেন।

“আমাদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে বসব শিগগিরই। এখন প্রতিযোগিতা বেশি অন্যান্য বেসরকারি হাসপাতালের সঙ্গে। সবাই মিলে কাজ করলে, হাসপাতালকে আরেকটু আধুনিক করলে এটা সম্ভব।”