রেড জোন-ছুটিতে গলদ দেখছেন বিশেষজ্ঞরা

সাধারণ ছুটির আবরণে দুই মাস লকডাউন শেষে করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে সংক্রমণপ্রবণ এলাকাগুলো সুনির্দিষ্ট করে সেখানে বিধিনিষেধ আরোপের যে কৌশল সরকার নিয়েছে, তার বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে এলোমেলোভাবে।

ওবায়দুর মাসুম জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 June 2020, 06:54 PM
Updated : 23 June 2020, 07:02 PM

এরই মধ্যে ১৯ জেলার ৪৫টি এলাকাকে ‘রেড জোন’ ঘোষণার পর সেখানে সাধারণ ছুটি দিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।

তবে এর মধ্যে অনেক এলাকায় সাধারণ ছুটি ঘোষণার অন্তত এক সপ্তাহ আগে ‘রেড জোন’ হিসেবে চিহ্নিত করার কথা জানানো হয়। ফলে এতদিন ওই এলাকায় মানুষের বিচরণ নিয়ন্ত্রণে ছিল না কোনো পদক্ষেপ।

আবার অনেক রোগী শনাক্ত হয়েছে, এমন জেলায় সাধারণ ছুটি ঘোষণা না করে কম রোগী রয়েছে, এমন জেলায় ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে।

শনাক্ত রোগীর অর্ধেকের বেশি ঢাকায় হলেও এখনও পূর্ব রাজাবাজার অবরুদ্ধ করা ছাড়া রাজধানী নিয়ে কোনো পদক্ষেপ আসেনি।

অথচ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেশি রোগী পাওয়া গেছে এমন জেলাই আগে অবরুদ্ধ করা দরকার।

সরকারের এই কাজটি তথ্যনির্ভর হচ্ছে না বলে মনে করেন আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন।

তিনি মঙ্গলবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সবার আগে ঢাকাসহ শহরাঞ্চল যেখানে রোগীর সংখ্যা বেশি সেখানে লাল অঞ্চল ঘোষণা করা দরকার ছিল।

“শহরাঞ্চলে সংক্রমণের ঘনত্ব সবচেয়ে বেশি, মৃত্যুর সংখ্যাও বেশি। এগুলোকে লকডাউন করার জন্য সব ধরনের প্রস্তুতিও নেওয়া ছিল। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এলাকা বাদ দিয়ে কেন সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে, তা বুঝতে পারছি না।”

“এই প্রশ্নটা করতে হবে যে কেউ কি চাচ্ছে না ঢাকা শহরে নিরাপত্তা বেষ্টনি হোক?”

সারাদেশে দুই মাস সাধারণ ছুটি জারি রাখার পর ৩১ মে থেকে বেশিরভাগ বিধিনিষেধ তুলে নেয় সরকার।

এরপর প্রতিদিন সংক্রমণ বাড়তে বাড়তে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা লাখ ছাড়িয়ে যাওয়ায় এলাকা ধরে ধরে সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার অনুযায়ী লাল, সবুজ ও হলুদ জোনে ভাগ করে প্রয়োজন অনুযায়ী বিধিনিষেধ আরোপের সিদ্ধান্ত হয়।

এরপর করোনাভাইরাস প্রতিরোধে গঠিত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি ঢাকা শহরে ৪৫টি, চট্টগ্রাম শহরে ১১টিসহ নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও নরসিংদীর বিভিন্ন এলাকা রেড জোন হিসেবে চিহ্নিত করে।

কিন্তু এরপর নানা পদক্ষেপে দেখা দিতে থাকে বিভ্রান্তি। যা নিরসনে সরকারকে তথ্য বিবরণী দিয়ে জানাতে হয়, প্রয়োজন অনুযায়ী রেড জোন ঘোষণা হবে।

এরপর গত ২১ জুন মধ্যরাতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ২৭টি ‘রেড জোন’ এলাকায় সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে আদেশ জারি করে। তবে ওই আদেশেই দেখা যায়, এর কোনো কোনো এলাকাকে ১৪ জুন রেড জোন ঘোষণা করা হয়েছে।

এরপর আরেক দফায় আরও কিছু রেড জোনে সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর মঙ্গলবার ৪ জেলার ৭ রেড জোনে সাধারণ ছুটির ঘোষণা আসে। তাতেও দেখা যায়, একটি এলাকাকে পাঁচ দিন আগে ১৮ জুন রেড জোন ঘোষণা করা হয়েছিল।

বিষয়টি নিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক মঙ্গলবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের জিজ্ঞাসায় বলেন, “সাধারণ ছুটি একই সময়ে হওয়ার কথা। কিন্তু সেটা কেন হয়নি বিষয়টি আমার জানা নেই।”

দেশে করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের পর তা মোকাবেলায় যে জাতীয় কমিটি গঠন করা হয়েছিল, তার চেয়ারম্যান স্বাস্থ্যমন্ত্রী স্বয়ং।

তিনি বলেন, “আমাদের কাজ হলো যেসব এলাকায় সংক্রমণ বেশি সেসব এলাকা দেখিয়ে দেওয়া, লোকজনকে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। বাকি কাজ করবে স্থানীয় সরকার, পুলিশ বাহিনীসহ অন্যান্য এজেন্সি।”

ঢাকার বিষয়ে কারগরি কমিটির সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রয়েছেন বলে জানান জাহিদ মালেক।

“ঢাকা শহরে দুটি এলাকা পরীক্ষামূলকভাবে লকডাউন হয়েছে। লকডাউনের এলাকা নিয়ে কিছু পরিবর্তন করা হয়েছে। আমরা তো চাই যত তাড়াতাড়ি হোক। কিন্তু কারিগরি কমিটি এখনও সিদ্ধান্ত জানায়নি।”

অবরুদ্ধ ঢাকার পূর্ব রাজাবাজার

কোথায় আছে, কোথায় নেই

মঙ্গলবার কক্সবাজার, মাগুরা, খুলনা ও হবিগঞ্জের সাতটি ‘রেড জোনে’ ২৪ জুন থেকে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে।

চট্টগ্রাম, বগুড়া, চুয়াডাঙ্গা, মৌলভীবাজার, নারায়ণগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, কুমিল্লা, যশোর ও মাদারীপুর ২৭টি ‘রেড জোন’ এলাকায় সাধারণ ছুটির ঘোষণা আসে গত রোববার।

সোমবার ফরিদপুর, মানিকগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নরসিংদী, ও কুষ্টিয়ার ১১ রেড জোনে ছুটির ঘোষণা আসে।

ঢাকার বিভাগের নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, নরসিংদী, মাদারীপুর, ফরিদপুর, মানিকগঞ্জ জেলার কয়েকটি এলাকা রেড জোন হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।

মানিকগঞ্জে ৪৯৬, মাদারীপুরে ৬০৮ জন রোগী শনাক্ত হয়েছে। ঢাকা জেলায় (মহানগরী বাদে) ২৮০৫, গাজীপুরে ২৫১১, কিশোরগঞ্জে ১০৮৩ জন শনাক্ত হলেও এসব জেলায় সাধারণ ছুটি এখনও আসেনি।

চট্টগ্রাম বিভাগের ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা ৫২১ জন। তা রেড জোনের আওতায় পড়েছে। লক্ষ্মীপুরে ৬০৯, নোয়াখালীতে ১৭৪০, ফেনীতে ৬৫৩, চাঁদপুরে ৬১০ সংক্রমিত হলেও সেসব জেলাকে এখনও ছুটির ঘোষণা দেওয়া হয়নি।

সিলেট বিভাগের হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজারের চেয়ে বেশি রোগী সুনামগঞ্জ জেলায়। হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজার রেড জোনে পড়লেও সুনামগঞ্জ আসেনি।

রংপুর বিভাগের রংপুর জেলায় সবচেয়ে বেশি ৭৮৩ জন রোগী চিহ্নিত হয়েছে। এই জেলাকে রেড জোন ঘোষণা হয়নি এখনও।

খুলনা বিভাগের খুলনা, যশোর, কুষ্টিয়া, মাগুরা, চুয়াডাঙ্গা জেলা রেড জোনে পড়েছে। মাগুরায় এখন পর্যন্ত ৬৪ জন রোগী শনাক্ত হয়েছে। এরচেয়ে বেশি রোগী শনাক্ত হলেও সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, ঝিনাইদহ ও নড়াইল জেলা নিয়ে কোনো পদক্ষেপ আসেনি।

ময়মনসিংহে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ১৩১৫ জন। ময়মনসিংহ বিভাগের অন্য জেলায়ও কোভিড-১৯ শনাক্ত হয়েছে। তবে কোনো জেলাই বিধিনিষেধের ছুটিতে আসেনি।

বরিশাল জেলায় ১১২৯ জন শনাক্ত হলেও এই বিভাগের কোথাও রেড জোনের ঘোষণা আসেনি।

আর রেড জোনের খবর মিললেও দেশে কোন কোন এলাকা ইয়েলো জোনে কিংবা কোন কোন এলাকা নিরাপদ অর্থাৎ গ্রিন জোনে, তা এখনও জানা যায়নি।

ব্রাহ্মষবাড়িয়ার কসবার অবরুদ্ধ এলাকা

রেড জোনে কী হাল

কোভিড-১৯ সংক্রমণের হার বিবেচনায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলকে যে তিনটি জোনে ভাগ করা হচ্ছে, তার মধ্যে ‘রেড জোনে’ সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হবে বলে আগেই জানানো হয়েছিল।

জনপ্রশাসন থেকে পরে প্রজ্ঞাপন হলেও স্থানীয়ভাবে রেড জোন ঘোষিত তারিখ থেকেই মাঠ পর্যায়ের তদারক কার্যক্রম চলছে বলে স্থানীয় সূত্রের খবর।

চুয়াডাঙ্গা জেলা সিভিল সার্জন ডা. এ এস এম মারুফ হাসান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, দামুড়হুদা উপজেলার দর্শনা পৌরসভার দুটি ওয়ার্ড রেড জোন ঘোষণা করা হয়েছে।

“ওই এলাকার জনসংখ্যা বিবেচনায় পজিটিভ রোগীর সংখ্যা দেখেই ১৭ জুনই রেড জোন ঘোষণা করেছি। ডিসি এ নিয়ে বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে; পুলিশ ইমপ্লিমেন্ট করছে; স্থানীয় প্রশাসন নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশানুযায়ী লোকাল ব্যবস্থাপনা কমিটি তা বাস্তবায়ন করছে।”

অবরুদ্ধ এলাকায় খাদ্য সরবরাহ ও ওষুধ বিতরণের বিষয়টি জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশ দেখছে জানিয়ে সিভিল সার্জন বলেন, কাজে কোনো সমন্বয়হীনতা নেই।

দামুড়হুদা উপজেলা চেয়ারম্যান মো. আলী মুনছুর বলেন, “আমরা সব ধরনের সহায়তা করছি স্থানীয় প্রশাসনকে। ডিসি-এসপিসহ প্রশাসনের তৎপরতায় এখন পরিস্থিতি উন্নতির দিকে।”

হবিগঞ্জ পৌরসভার দুটি ওয়ার্ড, চুনারুঘাট উপজেলার চারটি এলাকা; আজমিরীগঞ্জ এলাকার একটি ও মাধবপুর পৌরসভা রেড জোন ঘোষিত হয়েছে।

হবিগঞ্জের সিভিল সার্জন ডা. এ কে এম মোস্তাফিজুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গত বৃহস্পতিবার ১৮ জুন আমরা মন্ত্রণালয়ের ক্রাইটেরিয়া অনুযায়ী রেড জোন ঘোষণা করেছি। প্রশাসন-পুলিশসহ সংশ্লিষ্টদের লকডাউন বাস্তবায়নে পুরো নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।”

মাধবপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তাসনূভা নাশতারান বলেন, সব ধরনের কাজ সমন্বিতভাবে করা হচ্ছে।

মাধবপুর পৌর মেয়র হীরেন্দ্র লাল সাহা বলেন, “৯টা ওয়ার্ডের মধ্যে ৫টা ওয়ার্ড লকডডাউন। প্রথম কয়েকদিন ঢিলেঢালা ভাব ছিল বাজারে। ডিসির নির্দেশে সব দোকানপাটও বন্ধ করে দেওয়া হয়।”

হবিগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান মো. মোতাচ্ছিরুল ইসলাম বলেন, তার এলাকা রেড জোন ঘোষণা না হলেও সার্বিক পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য বিধি মানাতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে।

যশোরের অভয়নগর, চৌগাছা, ঝিকরগাছা, কেশবপুর, যশোর সদর, শার্শা উপজেলার অনেক এলাকা রেড জোন ঘোষণা করেন সিভিল সার্জন ডা. শেখ আবু শাহীন।

তিনি বলেন, “আমরা ১৫ জুনই এসব এলাকা রেড জোন ঘোষণা করেছি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে এ সংক্রান্ত প্রস্তাব পাঠানোর পর অনুমোদন সাপেক্ষে রেড জোন ঘোষণা করা হয়। এরপর লকডাউনের বিষয়টি আসছে। যথাসময়ে প্রচারণা করা হয়েছে। স্বাস্থ্যবিভাগ থেকে নির্দেশনা পেয়ে ডিসি-এসপিকে পাঠাচ্ছি।”

জনসংখ্যা ও পজিটিভ রোগী- এ দুটি নির্দেশক দেখে জোন নির্দিষ্ট করা হচ্ছে জানিয়ে সিভিল সার্জন বলেন, “বাস্তবায়ন করছে উপজেলা বাস্তবায়ন কমিটি। আমাদের যতটুকু সীমিত ক্ষমতা-সম্পদ রয়েছে, আমরা সবাই চেষ্টা করেছি যাচ্ছি সর্বোচ্চভাবে।”

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কয়েকটি এলাকা ১৩ জুন থেকে লকডডাউন। তবে সাধারণ ছুটি কার্যকর হয়েছে মঙ্গলবার থেকে।

সেখানকার পরিস্থিতি সম্পর্কে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি পিযুষ কান্তি আচার্য বলেন, লকডাউন বাস্তবায়নে বিক্ষিপ্তভাবে কিছু কাজ করা হয়েছে।

“কিছু এলাকা বাঁশ দিয়ে আটকে দেওয়া হয়েছে। আগমণ ও নির্গমন এলাকায় একজন করে আনসার মোতায়েন করা হয়েছে। খাবার ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য পৌঁছে দেওয়ার মতো কাজ করা হচ্ছে না। আর মানুষকেও ঘরে রাখা যাচ্ছে না।”