করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ধাক্কা কি আসছে?

করোনাভাইরাস মহামারী শেষ হতে অনেক দেরি। কিছু দেশ এখনও মহামারী নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খাচ্ছে। আর ভাইরাসটির বিস্তার নিয়ন্ত্রণ করতে পারা দেশগুলো এখন শঙ্কায় আছে ‘সেকেন্ড ওয়েভ’ বা করোনাভাইরাস মহামারীর পরের পর্যায়ের ধাক্কা নিয়ে।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 June 2020, 06:43 AM
Updated : 21 June 2020, 06:43 AM

এক শতাব্দি আগে স্প্যানিশ ফ্লু মহামারীর দ্বিতীয় পর্যায় প্রথমটির চেয়ে মারাত্মক ছিল। সুতরাং করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় পর্যায় কি অনিবার্য? আর এলে এটি কত খারাপ হতে পারে? – ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করা হয়েছে বিবিসির একটি প্রতিবেদনে।

সেকেন্ড ওয়েভ কী?

এটাকে সাগরের ঢেউয়ের মত ধরা যেতে পারে। সংক্রমণের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার পর আবার কমে যায়– এই চক্র একটি ঢেউ। সংক্রমণ আবার উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে যাওয়াটা তাহলে হবে দ্বিতীয় ঢেউ।

ওয়ারউইক বিশ্ববিদ্যালয়ের ডা. মাইক টিল্ডসলে বিবিসিকে বলেন, করোনাভাইরাস মহামারীর ক্ষেত্রে দ্বিতীয় পর্যায়ের আনুষ্ঠানিক কোনো সংজ্ঞা নেই।

কেউ কেউ মহামারীর প্রকোপ কমার পর একটু বেড়ে গেলেই তাকে দ্বিতীয় পর্যায় হিসাবে ধরেন। কিন্তু আসলে তা প্রথম পর্যায়েরই অংশ। যেমনটা এখন দেখা যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি রাজ্যে।

ভাইরাসটি নিয়ন্ত্রণে আনা গেলে এবং আক্রান্তের সংখ্যা যথেষ্ট পরিমাণে হ্রাস পেলে একটি পর্যায় বা ধাক্কা শেষ হয়ে গেছে বলা যাবে।

দ্বিতীয় পর্যায় শুরু করার জন্য সংক্রমণ ক্রমাগত বাড়তে হবে। নিউ জিল্যান্ড ২৪ দিন করোনাভাইরাস মুক্ত থাকার পর আবার দেশটিতে কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হয়েছে। বেইজিং ৫০ দিন ভাইরাস মুক্ত থাকার পর আবার চীনের রাজধানীতে প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। এগুলোকে মহামারীর দ্বিতীয় পর্যায় বলা যায় না।

তবে কিছু বিজ্ঞানী বলছেন, ইরানে আবার উল্লেখযোগ্য পরিমাণে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়াটা মহামারীর দ্বিতীয় পর্যায় হতে পারে।

যুক্তরাজ্যে করোনাভাইরাস মহামারীর দ্বিতীয় পর্যায় আসার সম্ভাবনা নিয়ে ড. টিল্ডসলে বলেন, “আমি এই মুহূর্তে সত্যিই মনে করি যে এ নিয়ে বিশাল অনিশ্চয়তা আছে ... তবে সত্যি কথা বলতে কি, এটা নিয়ে আমি খুব উদ্বিগ্ন।”

ভাইরাস এখনও চারপাশে রয়েছে এবং এটি এ বছরের শুরুর চেয়ে কম মারাত্মক বা সংক্রামক হয়ে যায়নি। তাই মহামারীর দ্বিতীয় পর্যায় আসার সম্ভাবনা স্পষ্ট।

এ পর্যন্ত যুক্তরাজ্যের মাত্র ৫ শতাংশ মানুষ সংক্রামিত হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। আর তারা যে আবার এ ভাইরাসে আক্রান্ত হবেন না - তারও কোনো নিশ্চয়তাও নেই।

লন্ডনের হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিকাল মেডিসিনের ডা. অ্যাডাম কুচারস্কি বলেন, “সিংহভাগ মানুষ এখনও সংক্রমণের ঝুঁকির মধ্যে আছে। সংক্ষেপে বলতে গেলে আমরা সব বিধিনিষেধ তুলে নিলে ফেব্রুয়ারিতে যেখানে ছিলাম সেখানে ফিরে যাব।

“এটি আবার শূন্য থেকে শুরু করার মত।”

দ্বিতীয় পর্যায়ের সূচনা কীভাবে হবে?

লকডাউনের বিধিনিষেধগুলো দ্রুত তুলে ফেললে দ্বিতীয় পর্যায় দেখা দিতে পারে।

লকডাউন বিশ্বজুড়ে ব্যাপক বিঘ্ন ঘটিয়েছে- বহু মানুষ কাজ হারিয়েছে, স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলেছে, শিশুদের স্কুল থেকে দূরে রেখেছে। তবে তাতে ভাইরাস নিয়ন্ত্রণের চেষ্টাও হয়েছে।

ডা. কুচারস্কি বলেন “চূড়ান্ত ধাঁধা হলো দৈনিক কাজে বিঘ্ন না ঘটিয়ে কীভাবে নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা যায়”

এভাবে কতদূর যাওয়া যাবে তা নিয়ে কেউ শতভাগ নিশ্চিত নযন। এজন্যই কযেকটি ধাপে লকডাউনের বিধিনিষেধগুলো তোলা হচ্ছে এবং করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণের নতুন নতুন উপায় চালু করা হচ্ছে।

ডা. কুচারস্কি বলেন নিয়ন্ত্রণ বজায় না রেখে বিধিনিষেধ শিথিল করা হলে যুক্তরাজ্য এবং প্রতিবেশী দেশগুলোতে হঠাৎ প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাবে।

জার্মানিতে এরই মধ্যে প্রাদুর্ভাব বাড়ার উদাহরণ দেখা গেছে। দেশটিতে মাংস প্রক্রিয়াজাতকরণের একটি কারখানায় ১ হাজারের বেশি কর্মী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন।

যদি ক্লাস্টারগুলো দ্রুত চিহ্নিত করা যায়, স্থানীয়ভাবে লকডাউন চালু হয় এবং ভাইরাসের বিস্তার বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে হয়ত বড় কোনো সমস্যা হবে না। কিন্তু তা না হলে এগুলোই দ্বিতীয় পর্যায়ের মহামারীর সূচনা ঘটাবে।

করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে জন্য প্রশংসিত দক্ষিণ কোরিয়া এ জাতীয় ক্লাস্টারের কারণে কিছু বিধিনিষেধ আবার জারি করেছিল।

দ্বিতীয় পর্যায় কি প্রথমটির মত হবে?

যদি সেরকম হয়, তবে তা হবে মানুষের গুরুতর কোনো ভুলের জন্য।

মহামারী শুরুর দিকে একজন আক্রান্ত মানুষ থেকে গড়ে তিনজনের মধ্যে ভাইরাস ছড়িয়েছে। এর অর্থ ভাইরাসটি খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছিল।

তবে এখন মানুষের আচরণ বদলেছে, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার সচেতনা বেড়েছে। তাই সংক্রমণের গতি এবার বেশি হবে না বলে ধরে নেওয়া যায়।

ডা. কুচারস্কি বলেন, কোনো দেশ এখন সব বিধিনিষেধ তুলে নিয়ে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যাবে না। এমনকি ব্রাজিল এবং ভারতের মত দেশ, যেখানে করোনাভাইরাস মহামারীর ওপর নিয়ন্ত্রণ নেই, সেখানেও এখন একজন থেকে তিনজনে ভাইরাস ছড়াচ্ছে না।

দ্বিতীয় পর্যায়ে যদি আবার আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ে, তবে তা হতে পারে অপেক্ষাকৃত ধীর গতিতে। তবে তাত্ত্বিকভাবে দ্বিতীয় পর্যায়ে আক্রান্তের সংখ্যা এখনও প্রথমবারের চেয়ে বেশি হতে পারে, কারণ বিপুল সংখ্যক মানুষ এখনও ঝুঁকিতে আছে।

ড. টিল্ডসলের মতে, আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে শুরু করলে আবার লকডাউনে যেতে হবে।

২১ জুন পর্যন্ত বিশ্বে দৈনিক শনাক্ত কোভিড-১৯ রোগীর সংখ্যার গ্রাফ, জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়

শীতকালে কি পরিস্থিতি খারাপ হবে?

ডা. কুচারস্কি মনে করেন, স্থানীয়ভাবে ভাইরাসের প্রকোপ বেড়ে যাওয়ার ঘটনা দেখা দিতে পারে যে কোনো সময়। তবে এর মানে এই নয় যে এটাই দ্বিতীয় পর্যায়।

ড. টিল্ডসেলি বলেন, “যদি বিধিনিষেধগুলো উল্লেখযোগ্যভাবে শিথিল করা হয় তবে আমরা হয়ত আগস্টের শেষের দিকে বা সেপ্টেম্বরের শুরুতে দ্বিতীয় পর্যায় দেখব।”

আগামী শীত মৌসুম গুরুত্বপূর্ণ সময় হতে পারে, কারণ অন্যান্য করোনাভাইরাস ওই সময় সহজেই ছড়িয়ে পড়ে।

নটিংহ্যাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক জোনাথন বল বলেন, “বসন্ত (ইউরোপে করোনাভাইরাস মহামারীর শুরুর সময়) নিঃসন্দেহে আমাদের সহায়তা করেছিল।"

“দ্বিতীয় পর্যায় প্রায় অনিবার্য, বিশেষ করে যখন আমরা শীতের মাসগুলোতে যাব।”

ভাইরাস কি দুর্বল হয়ে পড়বে?

দ্বিতীয় পর্যায়ের সংক্রমণ মারাত্মক হবে- এর বিপক্ষে একটি যুক্তি হচ্ছে আরও ভালোভাবে মানুষকে সংক্রমিত করতে নিজেদের বদলাতে গিয়ে ভাইরাসগুলো সাধারণত কম বিপজ্জনক হয়ে ওঠে।

এমনকি এইচআইভিও দুর্বল হয়ে যাচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে। এই তত্ত্ব অনুযায়ী, ভাইরাসগুলো যদি মানুষকে না মারে, তবে তারা আরও ছড়াতে পারবে। তাই তারা দুর্বল হয়ে পড়ে।

তবে অধ্যাপক বল বলছেন, “এর কোনো নিশ্চয়তা নেই। কিছু ভাইরোলজিস্ট দেখিয়েছেন এটা খুবই ধীর প্রক্রিয়া।”

এটি এমন এক বিষয়, যা দীর্ঘ সময় ধরে ঘটে। ছয় মাসের বেশি সময় ধরে চলা মহামারীতে নতুন এই করোনাভাইরাসের শক্তি কমেছে- এমন কোনো প্রমাণ এখনও মেলেনি।