করোনাভাইরাস: শততম দিন পেরিয়ে বিশেষজ্ঞদের কণ্ঠে হতাশা

করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরু হওয়ার তিন মাসের মাথায় যেখানে অনেক দেশে রোগীর সংখ্যা কমেছে, সেখানে বাংলাদেশে তা ক্রমশ বাড়তে থাকায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

জয়ন্ত সাহা নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 June 2020, 05:27 PM
Updated : 16 June 2020, 05:45 PM

মহামারী মোকাবেলায় যে প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, তার কার্যকারিতা নিয়ে ঘোর সংশয় রয়েছে তাদের।

করোনাভাইরাসের প্রকোপ থেকে বেরিয়ে আসতে দেশে দেশে লকডাউন যেভাবে কাজে দিয়েছে, সেই লকডাউন বাস্তবায়নের সক্ষমতা বাংলাদেশ সরকারের আছে কি না, সেই প্রশ্নও তুলেছেন তাদের কেউ কেউ।

গত ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হওয়ার পর ওই মাসের শেষ দিকেই দেশজুড়ে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সব কিছু বন্ধ করে দেয় সরকার, যা চলে টানা দুই মাস।

৩১ মে সাধারণ ছুটি শেষ হওয়ার কিছু দিন আগে ঈদ সামনে রেখে বিধি-নিষেধ শিথিল করে বিপণি বিতান ও দোকানপাট খুলতে শুরু করার পর বাড়তে থাকে সংক্রমণ।

১ জুন থেকে অফিসের পাশাপাশি গণপরিবহনও চালু হওয়ার পর প্রায় প্রতিদিনই করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগী শনাক্ত ও এতে মৃত্যুর রেকর্ড হচ্ছে বাংলাদেশে।এই কয়েক দিনে মৃত্যুও বেড়েছে কয়েক গুণ।

গত ২৬ মে পর্যন্ত ৭৯ দিনে যেখানে শনাক্ত কোভিড-১৯ রোগীর সংখ্যা ছিল ২৮ হাজার ৬৫০ জন, সেখানে ‘স্বাভাবিক জীবনের’ এই ২১ দিনে রোগী ৬৫ হাজার ৮৩১ জন বেড়ে মোট শনাক্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৯৪ হাজার ৪৮১ জনে। মৃতের সংখ্যাও বেড়ে ১ হাজার ২৬২ জন হয়েছে।

এ নিয়ে হতাশা প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এ বি এম আবদুল্লাহ মঙ্গলবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এ সময় রোগীর সংখ্যা কমে যাওয়ার কথা, কিন্তু জনগণের মধ্যে উদাসীনতা, অসহযোগিতার কারণে সংক্রমণ কমল না। তারা লকডাউন মানছে না। তাদের শিথিলতার কারণে সংক্রমণের হার বেড়ে যাচ্ছে।”

বিধি-নিষেধ শিথিলের পর সংক্রমণ বাড়তে থাকায় এখন এলাকা ধরে ধরে ‘রেড জোন’ চিহ্নিত করে লকডাউনের যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে তার বাস্তবায়ন কতটা ঘটবে, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক নজরুল ইসলাম।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অযথা লকডাউন লকডাউন খেলা করে লাভ নেই। লকডাউন করতে গেলে সিরিয়াসলি কাজ করতে হবে।”

রাজধানীর পূর্ব রাজাবাজারে পরীক্ষামূলক লকডাউনে কী সুফল পাওয়া গেল, তা প্রকাশ না করায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন অধ্যাপক নজরুল।

“সংক্রমণ কমাতে রাজাবাজারে পরীক্ষামূলক লকডাউন করা হল। কিন্তু লকডাউনে কী হল, কতজন রোগী আক্রান্ত হল, কতজনকে হাসপাতালকে নিয়ে যাওয়া হল- তা সরকারকে ওপেনলি বলতে হবে।” 

এলাকাভিত্তিক লকডাউনের পরিকল্পনায় ঢাকার প্রথম এলাকা হিসেবে পূর্ব রাজাবাজারের গলিপথগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে

 

এখন সারা দেশে বিভিন্ন জোন শনাক্ত করতে গিয়ে যে ‘সমন্বয়হীনতা প্রকাশ পাচ্ছে’, তাতে লকডাউন কী হবে সেই প্রশ্ন তোলেন অধ্যাপক নজরুল ইসলাম।

তিনি বলেন, “সরকার যে লকডাউনের কথা বলছে… কখনও বলছে সাধারণ ছুটি, কখনও বলে লকডাউন, কখনও বলে ইয়েলো জোনে হবে না, লাল জোনে হবে। লাল জোন যে কোথায়, কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।

“লকডাউনের আগে এই যখন অবস্থা হয়েছে, আমি অত্যন্ত শঙ্কিত লকডাউন ঠিকমতো করতে পারবে কি না? লকডাউন করার সক্ষমতা সরকারের আছে কি না, এটা আমার সন্দেহ হচ্ছে।”

রোগী ব্যবস্থাপনায় ঘাটতি

করোনাভাইরাস মোকাবেলায় শনাক্ত রোগীকে অন্যদের থেকে দ্রুত আলাদা করে তার ঠিকমতো চিকিৎসা দেওয়াও জরুরি জানিয়ে এক্ষেত্রেও ঘাটতি দেখছেন অধ্যাপক নজরুল ইসলাম।

তিনি বলেন, “আমাদের চিকিৎসা পদ্ধতিতে ঘাটতি আছে। এতে আমাদের পেশেন্টদের ক্ষতি হচ্ছে।”

কোভিড-১৯ এ আক্রান্তদের মধ্যে যারা হাসপাতালে ভর্তি তাদের শ্বাসপ্রশ্বাসের জন্য হাইপোন্যাজাল ক্যানুলা জরুরি হলেও তার সংকট রয়েছে বলে জানান অধ্যাপক নজরুল।

 “হাইপোন্যাজাল ক্যানুলার মাধ্যমে আমরা ভালোমতো অক্সিজেন নিতে পারি। আমাদের দেশে দু-একটা জায়গায় সোহরাওয়ার্দী, ঢাকা মেডিকেলে কিছু আছে। এই ক্যানুলা তাড়াতাড়ি বিদেশ থেকে কিনতে হবে, সাপ্লাই দিতে হবে।”

করোনাভাইরাস আক্রান্ত ব্যক্তির চিকিৎসা নিয়ে স্বজনদে চরম ধকল পোহাতে হচ্ছে এখনও

মহামারী মোকাবেলায় সরকার দেশের স্বাস্থ্যখাতের সামর্থ্যের পুরোটুকু ব্যবহার করতে পারছে না বলে মনে করেন স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলন সম্পর্কিত জাতীয় কমিটির চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশীদ-ই-মাহবুব।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের যে সক্ষমতা যা আছে তার সর্বোচ্চ ব্যবহার হয়নি। হয়ত কয়েকটা হাসপাতাল ডেডিকেটেড করা হয়েছে, কিন্তু এভাবে দুই-একটা হাসপাতাল ডেডিকেটেড করে তো লাভ হবে না। ওখানে কিন্তু আমরা নতুন কিছু উপাদান দিচ্ছি না। সক্ষমতা হয়ত কাগজে কলমে আছে, কিন্তু বাস্তবতার নিরিখে করতে পারছে না।”

অধ্যাপক রশিদ-ই-মাহবুব মনে করেন, কোভিড-১৯ আক্রান্তদের সেবায় দেশের সব সরকারি হাসপাতালের পাশাপাশি আরও বেশি বেসরকারি হাসপাতালকে অন্তুর্ভুক্ত করতে হবে।

“এখানে কথাটা হচ্ছে প্রাইভেট সেক্টরকে ইনভলব করা, আরও কিছু প্রাইভেট হাসপাতালকে রিক্যুইজিশন দিয়ে নেওয়া। সেখানকার চিকিৎসক ও নার্সদের বেটার ওরিয়েন্টেড করা, সুরক্ষা দিয়ে চিকিৎসাটা যদি করা যায়। এছাড়া অক্সিজেন সাপ্লাই একটা ফ্যাক্টর আছে, সেটা যদি করা যায় তাহলে ভালো হবে। না পারলে যা ঘটছে, তাই ঘটবে।”

করোনাভাইরাসে মৃতদের দাফন হচ্ছে এখন রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে

আক্রান্তদের আইসোলেশন ও চিকিৎসায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়ার তাগাদা দেন অধ্যাপক রশীদ।

লকডাউন দিলে তার যথাযথ বাস্তবায়ন ছাড়া কোনো ফল আসবে না বলে সতর্ক করে তিনি বলেন, “লকডাউন দেওয়া, বাস্তবায়ন করা তো এক কথা না। এখন সেটা যদি জনবান্ধব করে করতে পারে তবে সাকসেসফুল হবে। সেটা ভবিষ্যৎই বলবে। তবে যদি জনগণের স্বার্থের বিপরীতে যায় তাহলে এটাও ফেইলিউর হতে পারে।”

কী করতে হবে?

করোনাভাইরাস সংক্রমণের বর্তমান গতিতে উদ্বিগ্ন আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মুশতাক হোসেন বলেন, “সারা বিশ্বে করোনাভাইরাসে রোগী শনাক্তের হার ৩৭ শতাংশ (পরীক্ষা বিবেচনায়), বাংলাদেশে সে হার ২০ বা ২১ শতাংশের আশপাশে রয়েছে। খুব বেশি পিছিয়ে নেই বাংলাদেশ। সংক্রমণ বাড়ছে দিন দিন।

“এখন যেটি করতে হবে, সক্রিয় রোগী শনাক্ত করে কমিউনিটি থেকে আলাদা করা। অ্যাকটিভ রোগীকে আইসোলেট করতে হবে, দ্রুত ট্রিটমেন্টের ব্যবস্থা করতে হবে। দুটো জিনিস মিলিয়ে সংক্রমণের হার নামাতে হবে।”

সংক্রমণের গ্রাফ ঊর্ধ্বমুখী হওয়ার পরে সেটি এমনিতে নেমে গিয়ে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাবে, এমন ধারণার সঙ্গে একমত নন মুশতাক হোসেন।

কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির পিএইচডি ডিগ্রিধারী এই গবেষক বলেন, “এই ভাইরাস কিন্তু আপনাআপনি পিকে উঠে নেমে যাবে, এটা মনে করার কোনো কারণ নাই।

“তখনই নেমে যাবে যখন আমরা ভাইরাসের সংক্রমণটা সক্রিয়ভাবে সামাজিক পর্যায়ে রোধ করতে পারব। এটার সাথে সিজনের কোনো সম্পর্ক নাই, এটার সাথে ভাইরাস দুর্বল হয়ে পড়ার কোনো সম্পর্ক নাই। এটা সে ধরনের ভাইরাস নয়।

“কোনো কোনো মানুষের মধ্যে ধারণা চলে এসেছে যে, এটা আর খুব একটা বাড়বে না। এ যে মানুষের মধ্যে নিশ্চিন্তের ভাব, কিন্তু এই ভাবনাটা হচ্ছে সবচেয়ে বিপজ্জনক।”

নমুনা পরীক্ষা বাড়িয়ে রোগী শনাক্ত করে আইসোলেশনে পাঠানোর উপর জোর দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা

দেশে করোনাভাইরাস নমুনা পরীক্ষাগারগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটি সাপ্তাহিক ছুটিতে বন্ধ না রেখে শিফট অনুযায়ী সার্বক্ষণিক খোলা রাখার পরামর্শ দেন তিনি।

এছাড়া নমুনা পরীক্ষা ছাড়াও রোগীর লক্ষণ-উপসর্গ দেখে চিকিৎসকরা সন্দেহভাজন রোগীর তালিকা তৈরি করে তা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে পাঠাতে পারেন বলে মনে করেন মুশতাক হোসেন।

“রোগীর সংখ্যা যে হারে বাড়ছে তাতে সব রোগীর পরীক্ষা করা হয়ত সম্ভব হবে না। তাই চিকিৎসকরা সন্দেহভাজন রোগীর তালিকা তৈরি করে তা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে পাঠাতে পারেন। তা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে বুলেটিনে প্রকাশ করতে হবে। তাহলে আমরা হয়ত আরও সহজে রোগতাত্ত্বিক প্রবণতা বুঝতে পারব।”

 এই পরিস্থিতিতে সংকট উত্তরণের একমাত্র পথ হিসেবে ‘কঠোর লকডাউন’ বাস্তবায়নের কথা ভাবছে সরকার।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কোভিড-১৯ বিষয়ক মিডিয়া সেলের আহ্বায়ক অতিরিক্ত সচিব হাবিবুর রহমান খান বলেন, “সংক্রমণ কমাতে এই মুহূর্তে ভাবনা হচ্ছে, রেড জোন, ইয়েলো জোনে ভাগ করে কঠোর লকডাউন বাস্তবায়ন করা। লকডাউন বাস্তবায়নের পথে আমরা অনেকগুলো সাব জোন করছি।

“এই প্রক্রিয়াটি বেশ জটিল। বিভিন্ন জায়গা থেকে নানা ধরনের পরামর্শ আসছে। আমরা সেগুলো সমন্বয় করে লকডাউন বাস্তবায়ন করব। এটাই সংক্রমণ কমানোর একমাত্র উপায় বলে ভাবছি আমরা।”

তবে এবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা এবং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের নিয়ে আলাদা একটি কমিটি গঠন করে ‘কঠোর লকডাউন’ বাস্তবায়নের পরামর্শ দিয়েছেন অধ্যাপক এ বি এম আবদুল্লাহ।